Published : 09 Jun 2025, 09:33 AM
একালে আমরা বলি কুরবানি ঈদ। সেকালে বলতাম বকরি ঈদ। সেকাল বলতে বলছি- আমাদের শৈশব-কৈশোরের কথা। সেসময় যে গরু কুরবানি হতো না, তেমনটা নয়। তদুপরি দিনটিকে বলা হতো বকরি ঈদ। সেসময় গরু কুরবানি হতো সীমিত পরিসরে। ব্যাপক পরিসরে বকরি কুরবানির মাধ্যমে দিনটি উদযাপিত হতো। এর পেছনে ছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ। ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে প্রকাশ্যে গরু কুরবানি অনেকটা নিরুৎসাহিত করা হতো। শুধু কুরবানির ক্ষেত্রেই নয়, অন্য সময়েও গরুর মাংসের বিক্রিবাট্টা অনেকটা আড়ালে আবডালে করার নির্দেশনা ছিল। আমরা যে শহরে বেড়ে উঠেছি, সেই শহরের একপ্রান্তে প্রতি সপ্তাহে দুটি হাট বসত। এসব হাটে বকরির মাংস প্রকাশ্যে বিক্রয়ের অনুমতি থাকলেও গরুর মাংস হাটের মূল অঙ্গনে প্রকাশ্যে বিক্রির অনুমতি ছিল না। গরুর মাংস বিক্রি হতো হাট থেকে অনেকটাই দূরে- এক প্রবেশ পথের পাশে। সেই মাংসও ঝুলিয়ে রেখে চাহিদা অনুযায়ী কেটে কেটে বিক্রি করা হতো না। বিক্রি হতো ভাগা হিসাবে। সলিড মাংস, হাড় ও কলিজা একত্রে মিশিয়ে ভাগা হিসেবে বিক্রি হতো। এ ধরনের প্রতি ভাগার পরিমাণ হতো এক সের। ১৯৬৯ সনে এর মূল্য ছিল ১.৫০ টাকা। হাটবার ছাড়াও অফ ডে ব্যতিরেকে সপ্তাহের ছয়দিন গরুর মাংস বিক্রি হতো চারিদিকে দেয়াল ঘেরা স্লটার হাউজে। সেখানে মাঝে মাঝে শুকরের মাংসও বিক্রি হতো। এই স্লটার হাউজটি ছিল অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে। রেল বাজারের এক প্রান্তে। অন্য সম্প্রদায় তথা হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনুভূতির প্রতি খেয়াল রাখতেই এ ধরনের ব্যবস্থা অনুসৃত হতো। শহরে এ ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও গ্রামের অবস্থা কেমন ছিল, তা সম্যক জানি না। তবে, গ্রামের হাটেও অনেকটা দূরবর্তী স্থানে গরুর মাংস বিক্রি হতে দেখেছি।
আমাদের প্রজন্মের আগে আমাদের বাবাদের প্রজন্মে গরু নিয়ে ছিল এন্তার বিতর্ক। সেসময় আসামসহ অবিভক্ত বাংলা শাসিত হতো প্রায় ৬৮ হাজার জমিদারের দ্বারা। এ সমস্ত জমিদারের ৬০ হাজারই ছিল হিন্দু। যাদের কাছে গরু ছিল দেবতা হিসেবে পূজনীয়। এদের মধ্যে অনেকে আবার ছিল অনেকটা কট্টর প্রকৃতির। তাদের জমিদারিতে গো হত্যা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ তার অন্যথা করলে তার বিরুদ্ধে রীতিমতো মামলা ঠুকে দেয়া হতো, জরিমানা করা হতো। এমনকি গোরুর মাংস নদীর পানিতে ধৌতকরণের ক্ষেত্রেও ছিল নানাবিধ বিধি-নিষেধ। জানা যায়, বিগত শতাব্দীর তৃতীয় দশকে জনৈক মুসলমান প্রজা ডাকাতিয়া নদীতে গরুর মাংস ধৌত করায় স্থানীয় জমিদার কর্তৃক তার বিরুদ্ধে চাঁদপুর মহকুমা আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলায় অতপর আসামির বিরুদ্ধে মাননীয় হাকিম কর্তৃক ৫০ টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়। মুখ্যত হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে গঠিত সার্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির স্পর্শকাতর প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছিল এই গরু। এক সম্প্রদায় যাকে দেবতা হিসেবে পূজ্য মনে করত; অন্য সম্প্রদায়ের কাছে তা ছিল খাদ্য হিসেবে সুভোগ্য। এ নিয়ে সংঘাত লেগেই ছিল। এ ধরনের এক অনানুকূল পরিবেশে নিরীহ মুসলিম প্রজাকূল; বিশেষত যারা ছিলেন নির্বিরোধী-শান্তিপ্রিয় তারা এহেন বিতর্ক পরিহারকল্পে গরুর পরিবর্তে বকরি কুরবানি দিতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। তাছাড়া আর্থিক সংগতির দিকটিও ছিল প্রণিধানযোগ্য। এই দরিদ্র বাঙলায় আস্ত গরু কুরবানি দেয়ার সামর্থ ক-জনারই বা ছিল!
বিগত শতাব্দীর গোড়ার দিকে (১৯২৬) বাঙলার জনগনের আর্থিক অবস্থাও ছিল অত্যন্ত করুণ। এর একটি করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল ব্রিটিশ লেবার পার্টির উদ্যোগে। তাতে বলা হয়- হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এ অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী দুই দিনে একবার খাবার খেতে পারত। পরিস্থিতি এতটাই বিপর্যয়কর ছিল যে পণ্ডিত নেহেরু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন; একটি ইঁদুর প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার খেয়ে থাকে, বাঙলার সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর বরাতেও সেটুকু খাবার জোটে না। এর নতিজা দেখা গিয়েছিল গড় আয়ুর ক্ষেত্রে। সেসময় বাঙালি জনগোষ্ঠীর গড় আয়ু ছিল মাত্র সাড়ে ২৪ বছর। লেবার পার্টির একই রিপোর্টে বলা হয়েছিল; বাঙলার গ্রামাঞ্চলে ২০০ কৃষক পরিবারের মাত্র ১ টিতে ধানের গোলা দৃশ্যমান ছিল। এছাড়া সাধারণ কৃষকরা অধিক ফসল ফলিয়ে যে সম্পদ আয় করত, তা-ও নানা কায়দায় জমিদার জোতদাররা হাতিয়ে নিত। কোনো কোনো জমিদারিতে সাধারণ প্রজা তথা কৃষককুলের নিকট হতে ৩৬ ধরনের বাড়তি কর তথা আবওয়াব আদায় করা হতো।
এ ধরনের এক নেতিবাচক পরিস্থিতিতে কতজনের পক্ষে আস্ত একটা গরু কুরবানি দেয়া সম্ভব ছিল, তা সহজেও অনুমেয়। ফলত আর্থিক দিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সমর্থবানরা ধর্মীয় কর্তব্য পালনার্থে কুরবানির পশু হিসেবে বকরিকেই বেছে নিত। সে নিরিখে এই ঈদকে তারা বকরি ঈদ হিসাবে অভিহিত করত।
এখন দিন বদলে গেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখন শত বছর আগের তুলনায় শতগুণ বেড়ে গেছে। কুরবানি এখন রীতিমতো এক বনেদি উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় নিরিখে পশু কুরবানি ফরজ তথা বাধ্যতামূলক নয় কিন্তু ওয়াজিব। ধর্মীয় নির্দেশনায় বলা হয়েছে- কেউ যদি ফরজ বা ওয়াজিব পরিত্যাগ করে তাহলে গুনাহগার হবে আর তা অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে। তবে কোনো কোনো ধর্মজ্ঞ এ দুটি শব্দের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাদের কারও কারও মতে, ফরজ থেকে ওয়াজিব তুলনামূলকভাবে কম মর্যাদার। কেউ ফরজ অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে কিন্তু ওয়াজিব অস্বীকার করলে কাফির হবে না বরং ফাসিক হবে। এতে বোঝা যায় কুরবানি পরিহার করা সমীচীন নয়। এতে ঈমান ধাক্কা খাবে, বিপর্যস্ত হবে।
প্রকাশ থাকে যে, আব্রাহামিক ধর্মগুলো যে সময়-কালে ও যে সব স্থানে প্রবর্তিত হয়েছিল, সেসব স্থানে সেই সময়টিতে বিরাজ করছিল মুখ্যত পশুকেন্দ্রিক অর্থনীতির সমাজ। কওমের অর্থনীতির ভিত ছিল পশুপালন। যে কারণে দেখা যায় নবিদের অনেকেই ছিলেন মেষপালক। শেষ নিয়ে আবর্তিত তাদের জীবনের অনেক অনুষঙ্গ। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবকালে মক্কাতেও সেসময় যারা ধনবান ছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন বিপুলসংখ্যক পশু সম্পদের মালিক। খোদ নবি করিম (সা.) এর চাচা আবু তালেবও ছিলেন দুই শত উটের মালিক। সে সময় পশুর সাথে ছিল মালিক তথা গৃহস্থগণের আত্মিক সম্পর্ক, ছিল এক মায়ার বাঁধন। যে কারণে স্রষ্টার নামে উৎসর্গের প্রশ্নে সবচেয়ে প্রিয় পশুটিকে কুরবানি দিতে বলা হয়েছে।
এখন অনেকে বকরি কুরবানি দিয়ে থাকে। অনেকে আস্ত গরু কুরবানি দেয়, অনেকে আবার আর্থিক সংগতির নিরিখে ভাগায় কুরবানি দেয়। কেউ কেউ ইদানিং উটও কুরবানি দিয়ে থাকে। এসমস্ত উৎসর্গিকৃত পশুর সাথে কুরবানিদাতার কোনো আত্মিক বা মমতার সম্পর্ক নেই। এখন প্রিয় পশুকে উৎসর্গ করার চল অনেকটাই নাই হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামাঞ্চলের কেউ কেউ পালিত প্রিয় পশু কুরবানি দিলেও বাস্তবতার কারণে শহরাঞ্চলে সেই চল শূন্যের পর্যায়ে। শহরের লোকেরা সামর্থ অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে ক্রয়কৃত পশুই কুরবানি দিয়ে থাকে। এ নিয়ে চলে এক অবান্তর প্রতিযোগিতা। যার যত টাকা, তার পশুর আকারও তেমনি বিশাল। এক্ষেত্রে প্রিয় পশুর প্রশ্নটি অনেকটা উহ্য হয়ে পড়ে। পশু ক্রয়ের প্রতিযোগিতা এখন এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এক ছাগলের মূল্যকে কেন্দ্র করে একজন আমলাকে আজ জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আলোকপাত করছি। প্রতিবছর বৈশ্বিক পর্যায়ে কুরবানি প্রথা প্রতিপালিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কুরবানির প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে দেশে নানা তরিকা অবলম্বিত হয়। আমরা যেমন প্রতি বাড়িতে রাস্তা ঘাটে পশু জবেহ করে থাকি, সর্বত্র তা একই ভাবে করা হয় না। পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়াও আরব দেশগুলোতেও যত্রতত্র পশু জবেহ অনুমোদিত নয়। নির্দিষ্ট স্থানে এ কাজ করতে হয়। মুসলিম প্রধান দেশ; মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও আমাদের চেয়ে ব্যতিক্রম পন্থায় কুরবানির পশু জবেহ ও প্রসেস করা হয়ে থাকে। সাত বছর আগে এক কুরবানির ঈদে বেড়াতে গিয়েছিলাম মালয়েশিয়ার লঙ্কাউ (লঙ্কাবি) দ্বীপে। এদিন শহরের কোথাও কুরবানি হতে না দেখে অনেকটা অবাক হয়েছিলাম। কৌতূহল নিবারণের জন্য গাইড মি. হামজাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়; তারা কুরবানির জন্য স্থানীয় মসজিদে টাকা জমা দেয়, তারপর পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো মসজিদ কমিটির উদ্যোগেই সম্পন্ন করা হয়। কুরবানিদাতা শুধু তার অংশের মাংসটুকু মসজিদ থেকে নিয়ে আসে। যে কেউ তাদের দেশে যেখানে সেখানে ইচ্ছে মাফিক পশু জবেহ করতে পারে না।
ফরিদের ঘটনা দিয়ে এ লেখার ইতি টানছি। আমাদের একটা গরু ছিল। মূলত দুধ প্রাপ্তির আশায় বাবা সেই গরু কিনেছিলেন। এক সময় গরুটি একটি দামড়া বাছুর জন্ম দিলে। তার লালন পালনের দায়িত্ব নেয় ছোট ভাই ফরিদ। বাছুরটিকে আমরা সকলেই খুব আদর করতাম। সে ফ্রি স্টাইলে ঘরের ভেতরে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে। কখনোবা রান্নাঘরে আম্মার পাশে বসে কুটা তরকারির উচ্ছিষ্ট খেতে খেতে আড্ডা দিত। দেখতে দেখতে একদিন বাছুরটি যৌবনে উপনীত হয়। ফরিদ তাকে আদর করে লালু নামে ডাকত। টানাটানির সংসারে বাবা এক ঈদে ধর্ম রক্ষার্থে লালুকে কুরবানি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত ফরিদ কখনো মেনে নেয়নি। তদুপরি তার কান্নাকাটি সেই উদ্যোগ ঠেকাতে পারেনি। ঈদের দিন যথারীতি লালুকে স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা হয়। ফরিদ সেদিন এ বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারেনি। সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। রাতেও সে বাসায় ফেরেনি। পরবর্তী সময়ে কোনোদিন সে লালুর এক টুকরো মাংসও স্পর্শ করেনি। মাসাধিক কাল সে ছিল শোকাহত। দেখতে দেখতে আমাদের বকরি ঈদ আজ কুরবানি ঈদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেই উৎসর্গের বোধ কি সেভাবে শানিত হয়েছে? এখন কুরবানি ঈদের সময় গরুর সাথে সমান্তরাল হারে বিক্রি হয় মাংস সংরক্ষণের ফ্রিজ।