Published : 12 Jun 2025, 04:17 PM
কখনো কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গভীরভাবে দেখেছেন? শুধু চেহারা নয়, চোখের গভীরতা, সময়ের রেখা, অনুভূতির প্রকাশ—এ যেন এক রহস্য, এক অদ্ভুত বাস্তবতার খেলা।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্ম-প্রতিকৃতি। এটা শিল্পীদের পরিচয় এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের এক অনন্য উপায় বাতলে দিয়েছে। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন কেন এত শিল্পী তাদের নিজের প্রতিকৃতি আঁকার প্রতি আকৃষ্ট হন? বারবার এই আত্ম-প্রকাশের ধরনের কাছে ফিরে আসার জন্য তাদের আসলে কী অনুপ্রাণিত করে? আত্মপ্রতিকৃতি আমাদের অন্তরের অজানা রহস্য উন্মোচনের এক সৃজনশীল যাত্রা। সৃষ্টির প্রতিটি স্পর্শে যেমন প্রকৃতি নিজেকে নতুন করে প্রকাশ করে, তেমনি শিল্পীও তার মুখাবয়ব আঁকতে গিয়ে নিজের আবেগ বেদনা ও স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলেন। আমরা সেই আত্মপ্রতিকৃতির গল্প খুলে দেখব, যেখানে অতীতের ঐতিহাসিক ছবি থেকে শুরু করে আধুনিক দিনের সেলফির মতো সহজ গতির ছোঁয়া কিভাবে অনুভূত হয়।
ইতিহাসের পাতা খুলে দেখলে মনে হয় রেনেসাঁর শিল্পীদের হাতে আঁকা প্রতিচ্ছবি শুধু চিত্রকলা নয় তা ছিল একটা গভীর আত্মপরিচয়ের প্রকাশ। আলব্রেখট ড্যুরার কিংবা রেমব্রান্টের চিত্রিত আত্মপ্রতিকৃতি মূলত অন্তরের কাব্য। সেই প্রতিটি রেখা, একেকটি স্পর্শ যেন শিল্পীর নিজস্ব জীবনের কবিতা। তাঁর হৃদয়ের গভীরতা ও চেতনায় লুকানো স্বপ্ন একত্রে মিলেমিশে একটি অপরূপ ছবি উপস্থাপন করে।
আজকের যুগে, যখন প্রত্যেকেই মোবাইলের ক্যামেরা ক্লিকের মাধ্যমে নিজেকে দেখে, তখনও সেই আত্মপ্রতিকৃতির মূলমন্ত্র অপরিবর্তিত থেকে যায়। সেটি হলো -নিজেকে খুঁজে পাওয়া। কিন্তু ইতিহাস জানায়, পূর্বপুরুষরা যখন তুলির রঙে নিজের ভাবনাকে ধরে রাখতেন তখনও তাদের চোখে ছিলো স্বপ্ন, সংগ্রাম ও আনন্দের এক অদ্ভুত মিশেল। সেই শিল্পীরা কাটিয়ে উঠেছিলেন সমাজ ও সময়ের বাঁধা। বর্তমান সময়ে আমরাও আমাদের এক একটি সেলফির মাধ্যমে কি নিজের আত্মাকেই ঐ মুহূর্তে খুঁজে ফিরি?
আত্মপ্রতিকৃতি কি শুধু একটি ছবি হিসেবেই আমাদের কাছে ধরা দেয়? এটি একটি অভিজ্ঞতা এক আত্মবিশ্বাস, জীবনের এক সমাহার। বৃষ্টির জল যেমন মাটিকে সজীব করে ঠিক তেমনি শিল্পী তার মুখের প্রতিচ্ছবি আঁকার মাধ্যমে নিজের অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ করেন। কখনও তা রঙিন কখনও নিরব-স্থির আবার কখনও আঘাতের চিহ্নে ভরা। সব মিলিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সবাই একেকটি কাব্য। একেকটি সুরের প্রতিধ্বনি।
এই লেখাটির মূল এষণা কীভাবে বিভিন্ন সময়ের শিল্পীরা তাদের আত্মপ্রতিকৃতিতে জীবনের পরিবর্তন, মনের দ্বন্দ্ব এবং সৃজনশীলতার বহুমুখী রূপ তুলে ধরেছিলেন। কীভাবে তাদের প্রতিটি স্পর্শে বিদ্যমান ছিলো একটি অতলগামী গল্প। যে গল্পে আনন্দের ঝলক, কষ্টের সুর ও স্বপ্নের পরশ একত্রিত হয়ে এক চিরন্তন ছন্দে আবির্ভূত হয়। প্রতিটি প্রতিচ্ছবি নিজেকে প্রশ্ন করে—“আমি কে?” আমরা দেখতে পাই আত্মপ্রতিকৃতি নিজেকে দেখানোর মধ্যে দিয়ে নিজের অজানা দিক, অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভূতির গভীরতা জানার এক পথ খুলে দেয়। আজকের যুগের সেলফি ও অতীতের কবিতার মতো এই যাত্রায় আমরা খুঁজে পাবো সেই অমল ধ্রুব সত্য, যা বলে—প্রতিটি আত্মপ্রতিকৃতি একটি নতুন অধ্যায়। প্রতিটি ছবিতে লুকিয়ে থাকে জীবনের এক অবিনশ্বর গান।
আত্মপ্রতিকৃতি শিল্পের একটি গভীর এবং বহুস্তরীয় বিষয়। এটি শুধুমাত্র শিল্পীর নিজস্ব প্রতিচ্ছবি নয়। তার মানসিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক অবস্থানেরও প্রকাশ। একটি আত্মপ্রতিকৃতি হলো আত্ম-অনুসন্ধানের সর্বোচ্চ রূপ। শত শত বছর ধরে শিল্পীরা তাদের নিজস্ব প্রতিকৃতি আঁকছেন—কখনো বাস্তবতার সীমার মধ্যে, কখনোবা পরাবাস্তবতার রহস্যময়তার আড়ালে। এটি একাধারে ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন। কারণ চিত্রশিল্পী তার মুখচ্ছবি আঁকছেন বটে কিন্তু এর মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন।
শিল্পীর হাতের তুলির প্রতিটি আঁচড় একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়—আমি কে? আমি কীভাবে আমার অস্তিত্বকে প্রকাশ করব? আমার পরিচয় কি অন্যদের চোখে নাকি আমার নিজস্ব উপলব্ধিতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে শিল্পীরা তাদের আত্মপ্রতিকৃতিতে রঙ, আকার, অবয়বের মাধ্যমে সময়ের পরিবর্তন, অনুভূতির অনুপ্রবেশ, সমাজের প্রতিচ্ছবি—সবকিছুকে একসঙ্গে সংযুক্ত করেন।
মানুষের মনোজগতে আত্মপরিচয়ের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯০০-এর দশকের শুরুতে সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল ইয়ুং-এর মতো মনোবিজ্ঞানীরা আত্মপরিচয়ের দ্বান্দ্বিক প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ফ্রয়েড বলেছিলেন, ব্যক্তির চেতনা, অবচেতন মন, এবং সমাজের প্রভাব তার সত্তাকে তৈরি করে। আত্মপ্রতিকৃতি সেই রহস্যময় অবচেতন জগতের একটি প্রবেশদ্বার। শিল্পী তার রূপকে নিজের ভাবনাকে নিজেকে কীভাবে দেখে তা প্রকাশের চেষ্টা করেন। আত্মপ্রতিকৃতি তৈরি করার সময় মানব মস্তিষ্কের নিউরোলজিক্যাল প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন একজন শিল্পী নিজেকে আঁকেন, তখন তার প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং অকসিপিটাল লোব বিশেষভাবে সক্রিয় হয়, যা আত্মপরিচয় এবং চিত্রসংবেদনশীলতা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া, রঙের ব্যবহার, মুখের আকৃতি, আলোর প্রতিফলন এসবই মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে আবেগ, স্মৃতি, এবং উপলব্ধিকে উদ্দীপিত করে। একটি আত্মপ্রতিকৃতি এক টুকরো ছবিতে একটা জীবন ধরে রাখে। এটি শিল্পীর অস্তিত্বের আয়না অভিজ্ঞতার ধারক চেতনার প্রতিচ্ছবি। শিল্পী যখন তুলির আঁচড়ে নিজের মুখ তৈরি করেন তখন তিনি কি কেবলমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য তুলে ধরেন? না, তিনি সেটা করেন না। সেখানে তার গভীর ভাবনা অন্তর্জগৎ এবং সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিকেও তুলে ধরেন।
আত্মপ্রতিকৃতির ইতিহাস বহু পুরনো এবং সমৃদ্ধ যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। উল্লেখযোগ্য বিকাশের সূত্রপাত রেনেসাঁ থেকে শুরু হয়েছে। রেনেসাঁ যুগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি থেকে রেমব্রান্ট নিজেদের ছবি আঁকেন এক বিশেষ ধাঁচে। এই সময়ের আগে, শিল্পীরা প্রায়শই তাদের সৃষ্টিকর্মে নিজেদেরকে মুখ্য করে তুলে ধরতে দ্বিধা করতেন। তারা হয়তো কোনও ব্যস্ত জণমণ্ডলের দৃশ্যের পটভূমিতে একটি ছোট প্রতিরূপ অন্তর্ভুক্ত করে নিজেদের দেখাতেন বা আঁকতেন। কিন্তু খুব কমই তারা একটি স্বতন্ত্র আত্মপ্রতিকৃতি তৈরি করতেন।
আলব্রেখট ড্যুরার-এর Portrait of the Artist Holding a Thistle
জার্মান রেনেসাঁর শিল্পী আলব্রেখট ড্যুরার (Albrecht Dürer) আত্মপ্রতিকৃতির ধারাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রাক্কালে এই জার্মান শিল্পী আত্মপ্রতিকৃতির নিজস্ব ধারা নিয়ে আবির্ভূত হন। ড্যুরার তার মুখ এবং দেহের উপরের অংশের বিশদ চিত্র তৈরি করেছিলেন। যা শিল্পীদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত। ড্যুরারের আত্ম-প্রতিকৃতিতে যাত্রা শুরু হয়েছিল অল্প বয়সে। জার্মান রেনেসাঁর এই শিল্পগুরু মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম একটি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন। ২২ বছর বয়সে তিনি Portrait of the Artist Holding a Thistle আঁকেন। এটি তার প্রথমদিককার টিকে থাকা আত্মপ্রতিকৃতিগুলির মধ্যে একটি। খুব সম্ভবত, চিত্রশিল্পী হিসেবে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শেষ করার পরপরই তিনি এটি এঁকেছিলেন। এখানে নিজেকে একজন যুবক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তার ডান হাত একটি থিসল ধরে আছে, যার বিভিন্ন সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে। থিসল এক ধরণের উদ্ভিদ যার ফুলগুলো একত্রিত হয়ে ছাতার মতো দেখায়। এর কিছু ঔষধি গুনাগুণের জন্য উদ্ভিদটি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এবং এটিকে কামোদ্দীপক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সময়ের শিল্পে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এটি আনুগত্যের প্রতীক হতে পারে অথবা ব্যক্তিগত দুঃখকষ্টের বিষয় হতে পারে। কিংবা জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিকে বুঝাতে পারে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে শিল্পী এই চিত্রকর্মটি তার বাগদত্তা স্ত্রী অ্যাগনেস ফ্রে-এর জন্য উপহার হিসেবে তৈরি করেছিলেন। শীঘ্রই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হতে পারে থিসলটি বিশ্বস্ততার প্রতীক। আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী, ডাঁটা ফুলটি খ্রিস্টের যন্ত্রণাকালে তাঁর মাথায় পরানো কাঁটার মুকুটের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, যা এই কাজে আরও গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ যোগ করে। এছাড়াও তার “Self-Portrait at the Age of Twenty-Eight” (১৫০০) চিত্রকর্মটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ছবিতে তিনি নিজেকে যিশু খ্রিস্টের মতো উপস্থাপন করেছেন—গভীর চোখ, দীর্ঘ চুল, এবং একটি রহস্যময় অভিব্যক্তি। এক আধ্যাত্মিক প্রতিচিত্র। এ যেন তার শিল্পীসত্তার একধরনের আত্ম-উপলব্ধি। ড্যুরারের আত্মপ্রতিকৃতি ছিল তার আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। এজন্যই তিনি বলেছিলেন, "I, Albrecht Dürer of Nuremberg portrayed myself in appropriate colors aged twenty-eight years."
ড্যুরারের যুগান্তকারী সৃষ্টিকর্মের পর রেনেসাঁর সময় আত্মপ্রতিকৃতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৪শ থেকে ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত এই সময়কালটি ইউরোপে সাংস্কৃতিক পুনর্জন্মের সময় ছিল, যেখানে মানুষ শিল্প, মানবতাবাদ এবং স্বতন্ত্র পরিচয় অন্বেষণে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই সময়ে আয়না শিল্পে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে শিল্পীরা তাদের নিজস্ব প্রতিচ্ছবি আরো স্পষ্ট দেখতে পান। ফলে আয়নায় দেখা নিজেদের সাদৃশ্য তাদের চিত্রকর্মে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারটি সহজ হয়ে ওঠে। নিজের প্রতি এই মনোযোগটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্তর ইতালির অন্যতম উদ্ভাবনী শিল্পী হিসেবে বিবেচিত ইতালীয় চিত্রশিল্পী পারমিগিয়ানিনোর কাজে। তাঁর Self-Portrait in a Convex Mirror (1524) দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই চিত্রকর্মটির অনুসরণে পরবর্তীকালে মার্কিন কবি জন এ্যাশবেরি তার এক কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন। এই চিত্রকর্মে পারমিগিয়ানিনো একটি উত্তল দর্পনে নিজেকে এঁকেছিলেন যেখানে একটি বিকৃত অথচ অন্তরঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেছিল। এই প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জটি তার দক্ষতা এবং একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রদর্শন করে। কাজটি একজন শিল্পীর বাস্তবতা এবং শৈল্পিক প্রকাশের সীমানা লঙ্ঘন করে আত্ম-প্রতিকৃতি ব্যবহার করার সবচেয়ে উদাহরণগুলির মধ্যে একটি।
পারমিগিয়ানিনো-এর Self-Portrait in a Convex Mirror
পারমিগিয়ানিনো কেবল উত্তল আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করেননি যা দেখেছিলেন তা সাবধানে পুনর্নির্মাণও করেছিলেন। রেনেসাঁর সময় আয়নার ক্রমবর্ধমান সহজলভ্যতার কারণেই আত্ম-প্রতিকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই উত্থান ঘটেছিল। এর আগে, শিল্পীদের তাদের প্রতিচ্ছবি ধারণ করার জন্য তাদের স্মৃতি বা স্কেচের উপর নির্ভর করতে হত। তবে, ঘরবাড়ি এবং স্টুডিওতে আয়নাগুলি আরও সাধারণ ও সহজলভ্য হয়ে ওঠার সাথে সাথে শিল্পীরা তাদের প্রতিচ্ছবি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন। এবং আরও নির্ভুলতার সাথে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি পুনরায় আঁকতেন। এই নতুন সহজলভ্যতার ফলে পারমিগিয়ানিনোর মতো শিল্পীরা তাদের পরিচয় ও আবেগকে আরও গভীরভাবে অন্বেষণ করতে সক্ষম হন। এটি বৈচিত্র্যময় এবং অভিব্যক্তিপূর্ণ আত্মপ্রতিকৃতিতে অবদান রাখার মাধ্যমে শিল্প ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
রেমব্রান্ট-এর Self-Portrait, 1660
ডাচ স্বর্ন যুগের আলো ও ছায়ার খেলার এক ওস্তাদ আঁকিয়ে রেমব্রান্ট আত্মপ্রতিকৃতির ক্ষেত্রে এক অনন্য নাম। রেমব্রান্ট তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজের পরিবর্তনকে আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। তার শিল্পে আলো এবং ছায়ার ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা তার মানসিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি প্রায় ৯০টির বেশি আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন। চিত্রকর্মগুলি শিল্পীর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের চেহারার পরিবর্তন, আবেগের গভীরতা, এবং অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। রেমব্রান্টের “Self-Portrait, 1660” ছবিতে দেখা যায় এক পরিণত শিল্পী, যার চোখে অভিজ্ঞতার ছাপ। তার চিত্রকর্মে আমরা দেখি চিয়ারোস্কুরো (Chiaroscuro) নামক আলোর কৌশল, অর্থাৎ উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল বর্ণের সমাবেশ। এই কৌশল তার আবেগকে আরও গভীরভাবে প্রকাশ করেছে। রেমব্রান্টের সৃষ্টিকর্মে আলো আঁধারের এই খেলা পরবর্তীতে যা 'রেমব্রান্ট লাইটিং' হিসেবে পরিচিতি পায়। চিত্রশিল্প ছাড়িয়ে 'রেমব্রান্ট লাইটিং'-এর ধারণা বিস্তার লাভ করে আলোকচিত্রশিল্প এবং চলচ্চিত্রেও। রেমব্রান্টের মতে "Without atmosphere, a painting is nothing." আত্মপ্রতিকৃতি ছিল তার অভিজ্ঞতার প্রতিবিম্ব।
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ-এর Self-Portrait with Bandaged Ear
আরেক ডাচ পোস্ট ইমপ্রেসনিস্ট আর্টিস্ট ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ (Vincent van Gogh) যন্ত্রণার রঙে এঁকেছেন আত্মপ্রতিকৃতি। ভ্যান গঘ নিজের মানসিক যন্ত্রণাকে আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে তার Self-Portrait with Bandaged Ear (১৮৮৯) চিত্রকর্মে। এখানে তার কাটা কান দেখা যায়; এটি শুধু শারীরিক চিত্র নয়, বরং তার মানসিক অস্থিরতার এক গভীর প্রতিফলন। এই শিল্পী জীবনের শেষ পর্যায়ে বহু আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন। আত্মপ্রতিকৃতিগুলোতে আমরা দেখি গভীর আবেগ, বিক্ষিপ্ত তুলির আঁচড়, এবং রঙের মাধ্যমে তার মানসিক অবস্থার প্রকাশ। বিজ্ঞান বলে, মানসিক যন্ত্রণার সময় মানুষের মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল প্রসেসিং পরিবর্তিত হয়—ভ্যান গঘের চিত্রকর্ম সেই পরিবর্তন স্পষ্ট। ভ্যান গঘ বলেছিলেন "I put my heart and soul into my work, and have lost my mind in the process." আত্মপ্রতিকৃতি ছিল তার মানসিক দ্বন্দ্বের দলিল।
গুস্তাভ কুরবে-এর The Desperate Man
ফরাসি শিল্পী গুস্তাভ কুরবে (Gustave Courbet) আত্মপ্রতিকৃতিতে নাটকীয়তা এনেছিলেন। কুরবে তার “The Desperate Man” (১৮৪৩) আত্মপ্রতিকৃতিতে এক ধরনের নাটকীয়তা দেখা যায়। এই ছবিতে তার চোখ বিস্মিত, হাত মাথার কাছে, যেন তিনি কোনো গভীর সংকটে আছেন। এটি যেন একধরনের আত্ম-অনুভূতির বিস্ফোরণ। কুরবের অভিমত ছিল "Painting is the representation of visible forms." আত্মপ্রতিকৃতি ছিল তার আবেগের প্রকাশ।
আলব্রেখট ড্যুরার আত্মবিশ্বাসের প্রতিচিত্র এঁকেছেন, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ যন্ত্রণার রঙে নিজেকে প্রকাশ করেছেন, রেমব্রান্ট আলো ও ছায়ার মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলেছেন, আর গুস্তাভ কুরবে নাটকীয়তার মাধ্যমে নিজের আবেগকে প্রকাশ করেছেন।
এটাই আত্মপ্রতিকৃতি— এক জীবন দর্শন। যেন এক ধরনের কবিতা যেখানে তুলির আঁচড়ে শিল্পীরা নিজেদের অস্তিত্বকে লিখে রাখেন। একটি গভীর আত্ম-অনুসন্ধান। এক রহস্য যাত্রা। আধুনিক যুগের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে আমরা দেখতে পাই তিনজন শিল্পী—দালি, পিকাসো, কাহলো—তাদের তুলির মাধ্যমে এই রহস্যের উত্তর খুঁজেছেন। কিন্তু উত্তর কখনোই একরকম হয়নি। এ যেন দস্তয়েভস্কির সেই বিখ্যাত বাক্যের মতো: “Man is a mystery. It must be solved." সালভাদর দালি, পাবলো পিকাসো ও ফ্রিদা কাহলো—তিনজনই ছিলেন নিজস্বতাকে চিত্রকর্মে ধরে রাখার ও প্রকাশ করায় পারঙ্গম। তাঁদের আত্মপ্রতিকৃতিতে পরাবাস্তববাদ মিশে গিয়ে বাস্তবতার সীমানা ভেঙ্গে ফেলেছেন। প্রিয় পাঠক চলুন, তাদের আত্মপ্রতিকৃতির গল্পে প্রবেশ করা যাক।
আত্মপ্রতিকৃতি হল সেই আয়না, যেখানে শিল্পীর অন্তর্জগত প্রতিফলিত হয়। কিন্তু যদি সেই আয়না বিকৃত হয়ে যায়? যদি বাস্তবতার সীমানা ভেঙে গিয়ে চিত্রকর্ম হয়ে ওঠে এক স্বপ্ন, এক বিভ্রম? এটাই পরাবাস্তববাদ। সালভাদর দালি, পাবলো পিকাসো ও ফ্রিদা কাহলো—তাদের আত্মপ্রতিকৃতির সঙ্গে পরাবাস্তববাদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। রঙের খেলায় সময়ের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা, চেতনাকে ভেঙে নতুনভাবে গঠন করা। পরাবাস্তববাদ শুধুমাত্র একটি শিল্পধারা নয়, একটি বিপ্লব। ১৯২০-এর দশকে আঁদ্রে ব্রেতোঁ পরাবাস্তববাদী ম্যানিফেস্টোতে লিখেছিলেন, "Surrealism is based on the belief in the superior reality of dreams." এর অর্থ হলো—বাস্তবতা যা আমাদের চোখে ধরা দেয়, সেটাই একমাত্র সত্য নয়। এর গভীরে আছে স্বপ্ন, অবচেতন, অনুভূতির এক রহস্যময় জগত। পরাবাস্তববাদে শিল্পীরা সেই জগতের সন্ধান করেছেন। মানুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি যে এটি সাধারণের মধ্যে অসাধারণকে খুঁজে নিতে পারে। পরাবাস্তববাদ এই মানসিক প্রবণতাকে ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব মস্তিষ্কের অবচেতন অংশ—লিম্বিক সিস্টেম পরাবাস্তব চিত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে। সালভাদর দালি, পিকাসো এবং কাহলো—তাদের আত্মপ্রতিকৃতি মানব মস্তিষ্কের রহস্যময় কাজের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। পরাবাস্তববাদ আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—আমরা যা দেখি, সেটাই কি সত্য? আমাদের অস্তিত্ব কি শুধুমাত্র বাস্তবতার সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ? সালভাদর দালি স্বপ্নের দ্বার উন্মোচন করেছেন, পিকাসো কাঠামো ভেঙেছেন, আর ফ্রিদা কাহলো ব্যথাকে তুলির আঁচড়ে রূপ দিয়েছেন। পরাবাস্তববাদ চেতনার আয়নায় শিল্পীসত্তার খোঁজ নিজের আত্মার খোঁজ করেছেন । আমাদের বাস্তবতার উর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে চেতনার ভিন্ন এক স্তরে প্রবেশ করিয়েছেন।
একটি আত্মপ্রতিকৃতি আমাদের একটি গল্প বলে। যে গল্পে রঙ, ফর্ম, অবয়ব সব মিলিয়ে শিল্পীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়। যখন শিল্পী নিজের মুখ আঁকেন, তখন তার জীবন, তার যন্ত্রণা ও পরিবর্তনকে একসাথে তুলে ধরেন। পরাবাস্তববাদ এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শিল্পীর অবচেতন চিন্তা ও স্বপ্নের জগতকে মুক্তভাবে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও কার্ল ইয়ুং বলেছিলেন, মানুষের অবচেতন মন এক রহস্যময় ক্ষেত্র, যেখানে স্মৃতি, ইচ্ছা, ভয় ও আকাঙ্ক্ষা একসঙ্গে বসবাস করে। পরাবাস্তববাদ সেই অবচেতন জগতকে তুলির ছোঁয়ায় দৃশ্যমান করে তোলে।
সালভাদর দালি-এর soft Self-Portrait with Grilled Bacon
সালভাদর দালির আত্মপ্রতিকৃতিতে বাস্তবতা ও স্বপ্নের ছায়া মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দালির আত্মপ্রতিকৃতি কখনোই সাধারণ হয়নি। তার ছবিগুলো যেন একটি ঘোরের মধ্যে তৈরি। তার বিখ্যাত Soft Self-Portrait with Grilled Bacon—এই চিত্রকর্মে তার মুখ যেন গলে যাচ্ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে অস্তিত্বের সংকটে। তার চিত্রে সময় তরলের মতো বাস্তবতা যেন ভেঙে যাচ্ছে। এ এক পরাবাস্তব স্বপ্নের জগত। দালির আত্মপ্রতিকৃতি ছিল তার অস্তিত্বের নিরব প্রতিবাদ। তাই তো বলতে দ্বিধা করেন নি "I don't do drugs. I am drugs." তার প্রতিচ্ছবির মাঝে নিজের পাগলামি, সৃজনশীলতা, এবং আত্মপরিচয়ের গোলকধাঁধার মাঝে হারিয়ে গেছেন। এ এক স্বপ্নের দ্বান্দ্বিকতা। বিজ্ঞান বলে, মানুষের মস্তিষ্ক অবচেতন চিন্তাকে চিত্রিত করার ক্ষমতা রাখে। দালি সেই অবচেতনকে বাস্তব করে তুলেছেন। দালি বলেছিলেন "A true artist is not one who is inspired, but one who inspires others." তাঁর ছবিগুলোতে বস্তুর অবস্থান যেন একটি স্বপ্নের ভেতর বাঁকাচোরা হয়ে গেছে। এটি মস্তিষ্কের প্যারিডোলিয়া নামক প্রবণতার সাথে সম্পর্কিত, যেখানে আমরা অপ্রচলিত আকৃতির মধ্যে পরিচিত ছবি খুঁজে পাই।
পাবলো পিকাসোর সর্বশেষ আত্মপ্রতিকৃতি
এবার আসা যাক পাবলো পিকাসোর রঙিন ব্যঞ্জনায়। পাবলো পিকাসো রঙের মধ্য দিয়ে নিজস্বতার উন্মোচন করেছেন। পিকাসোর আত্মপ্রতিকৃতি এক ধরনের বিবর্তন। তিনি সময়ের সাথে বদলেছেন তুলির ধরন। পরিবর্তন করেছেন নিজের দর্শন। যখন তরুণ ছিলেন আত্মপ্রতিকৃতি ছিল বাস্তববাদী—স্পষ্টভাবে নিজের মুখ এঁকেছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই মুখ ভাঙতে শুরু করলো; জ্যামিতিক হয়ে গেল, রঙ বদলালো। তাঁর “Self-Portrait, 1901” থেকে শুরু করে “Self-Portrait, 1972” পর্যন্ত যদি দেখি, আমরা পাবো এক চিত্রশিল্পীর ধাপে ধাপে পরিবর্তনের গল্প। প্রথমে রঙিন, শেষের দিকে যেন মৃত্যুর ছায়া গ্রাস করেছে। পিকাসো বলেছিলেন "Art is a lie that makes us realize truth." তার আত্মপ্রতিকৃতি সেই মিথ্যা যা সময়ের সত্যকে প্রকাশ করে। একইভাবে ভেঙে ফেলে বাস্তবতার কাঠামো। পিকাসো সরাসরি পরাবাস্তববাদী ছিলেন না। কিন্তু তার শিল্পের অনেক দিক এই দর্শনের সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে তার আত্মপ্রতিকৃতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সেই রূপান্তর দেখতে পাই। প্রথমে ছিলেন বাস্তববাদী পরে কিউবিজমের মাধ্যমে চেহারাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছেন। কিউবিজমও এক ধরনের পরাবাস্তবতা। এটি বাস্তবতার প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিউবিজম নিউরোলজির সাথে সম্পর্কযুক্ত। মানব মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল প্রসেসিং পিকাসোর ছবিগুলোর মতো জ্যামিতিক কাঠামো ব্যবহার করে চেহারা চিনতে পারে। পিকাসোর চিত্রকর্ম পরাবাস্তবতার মতই চেতনার গহীনে প্রবেশ করেছিল।
ফ্রিদা কাহলো’র Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird
অপরদিকে, মেক্সিকান আর্টিস্ট ফ্রিদা কাহলোর আত্মপ্রতিকৃতি মানে নিজের গভীরে ডুব দেওয়া। কাহলো আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে নিজের যন্ত্রণা, ভালোবাসা, এবং পরিচয়ের প্রশ্নকে সামনে এনেছেন। তাঁর ছবিতে নিজের মুখ এঁকে নিজের ব্যথাকে তুলির রঙে ঢেলে দিয়েছেন। এই শিল্পীর বিখ্যাত “Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird”—এখানে তার গলায় কাঁটা, মুখ কঠিন, চোখে যেন শোকের সাগর। ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতি মানে তার নারীত্বের লড়াই। সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব ও যন্ত্রণার প্রতিচিত্র। মনে পড়ে যায় ফ্রিদার বিখ্যাত উক্তি "I paint self-portraits because I am so often alone, because I am the person I know best." ফ্রিদা কাহলো আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে অবচেতনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আত্মপ্রতিকৃতিগুলো সরাসরি পরাবাস্তববাদী মনে হলেও নিজেকে এই ধারার শিল্পী হিসেবে স্বীকার করেননি। তবে“Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird” ও “The Two Fridas” সহ আরো অনেক চিত্রকর্ম পরাবাস্তববাদী থিম বহন করে। যেখানে তার যন্ত্রণা ও মানসিক দ্বন্দ্বকে পরাবাস্তব রূপ দিয়েছেন। বিজ্ঞান বলে, ট্রমার ফলে মানুষের স্মৃতি ও চেতনা পরিবর্তিত হয়। ফ্রিদার শিল্প সেই পরিবর্তনের উদাহরণ। রঙ, প্রতীক, মুখের অভিব্যক্তি সবকিছু এক ধরনের গভীর মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার প্রকাশ। আত্মপ্রতিকৃতি ফ্রিদার জন্য ছিল এক ধরনের মুক্তি। নিজের কষ্টের এক নিরব সঙ্গী।
এই তিন শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি তাদের জীবন, যন্ত্রণা, পরিবর্তন এবং সৃজনশীলতার প্রতীক। তারা নিজেদের প্রশ্ন করেছেন উত্তর খুঁজেছেন। নিজেদের সবচেয়ে ভালোভাবে জানার চেষ্টা করেছেন। অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশ করেছেন। ফ্রিদা কাহলোর যন্ত্রণা, দালির পাগলামি, পিকাসোর পরিবর্তন সব মিলিয়ে আত্মপ্রতিকৃতি হলো একটি শিল্পীর নিজস্ব কবিতা। এক আত্ম-অনুসন্ধানের যাত্রা, যেখানে শিল্পী নিজের মুখ আঁকেন, কিন্তু দর্শক দেখে তার অস্তিত্বের গল্প।
বিশ্বসাহিত্যের লেখকরাও আত্মপরিচয়ের বিষয়ে বহুবার কথা বলেছেন। দালি, পিকাসো, কাহলো তাদের তুলির মাধ্যমে যা করেছেন, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, সিলভিয়া প্লাথ, ও পাবলো নেরুদা তা করেছেন শব্দের মাধ্যমে। ফ্রিদার ব্যথাকে বোঝানোর জন্য নেরুদার এই পঙক্তি যেন উপযুক্ত "You can cut all the flowers but you cannot keep spring from coming."
একইভাবে পিকাসোর আত্মপরিচয়ের পরিবর্তন দস্তয়েভস্কির এই কথার প্রতিধ্বনি "Taking a new step, uttering a new word, is what people fear most."
অপরদিকে, দালির আত্মপ্রতিকৃতির বিস্ময়বোধ বোর্হেসের এই শব্দগুলোর ভেতরে লুকিয়ে আছে "I have always imagined that paradise will be a kind of library."
তুলির আঁচড়ে আত্মপ্রতিকৃতি লেখা হয়, আর শব্দের মাধ্যমে আত্মপরিচয়ের গল্প বলা হয়। সালভাদর দালি, পাবলো পিকাসো ও ফ্রিদা কাহলো ছাড়াও পরবর্তীকালে বহু শিল্পী আত্মপ্রতিকৃতির মাধ্যমে নিজেদের শিল্পীসত্তাকে অমর করে তুলেছেন। তাদের তুলির আঁচড়ে লিখেছেন নিজেদের বেঁচে থাকার ইতিহাস।
আধুনিক যুগে, আত্মপ্রতিকৃতি ফটোগ্রাফি এবং ডিজিটাল শিল্পেও স্থান করে নিয়েছে। ইন্টারনেট যুগে সেলফি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যা এক ধরনের আধুনিক আত্মপ্রতিকৃতি। কিন্তু এর মধ্যেও রয়েছে আত্মপরিচয়ের একটি গভীর প্রশ্ন—মানুষ নিজেকে কীভাবে দেখছে, এবং অন্যরা তাকে কীভাবে গ্রহণ করছে? আত্মপ্রতিকৃতির ধারাবিহকতায় সেলফি সময়ের আয়নায় আত্ম-উপলব্ধির বিবর্তন। আমরা প্রতিদিন অসংখ্য সেলফি তুলি—মুহূর্তের সাক্ষ্য রেখে, নিজের চেহারার পরিবর্তন দেখি, বা সামাজিক মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করি। কিন্তু এই আধুনিক প্রবণতার কি কোনো ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে? যদি আমরা অতীতের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো সেলফি কোনো হঠাৎ সৃষ্টি নয়—এর পূর্বসূরি হচ্ছে আত্মপ্রতিকৃতি (Self-Portrait), যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পীদের দ্বারা চর্চিত। প্রশ্ন হচ্ছে—আত্মপ্রতিকৃতি কি শুধুই পূর্ববর্তী যুগের সেলফি, নাকি এটি এক বিশেষ শিল্পরীতি যা আধুনিক সেলফির তুলনায় এক গভীরতর এবং মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রকাশ করে?
১৮৩৯ সালে রবার্ট কর্নেলিয়াস-এর তোলা প্রথম সেলফি। এটি তুলতে সময় লেগেছিল ১৫ মিনিট।
সেলফির আগমন মূলত প্রযুক্তির আয়নায় নতুন আত্ম-প্রকাশ। সেলফির মূল উৎস ফটোগ্রাফি। আত্মপ্রতিকৃতি যেখানে শিল্পীদের তুলির রেখায় সৃষ্টি হতো সেখানে সেলফি তৈরি হয় ক্যামেরার এক ক্লিকে। বিশ্বের প্রথম সেলফি ১৮৩৯ সালে রবার্ট কর্নেলিয়াস (Robert Cornelius) তুলেছিলেন। নিজেই তার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তুলেছিলেন যা ইতিহাসের প্রথম স্ব-চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। সেলফি স্মার্টফোনের উদ্ভাবনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের উত্থান মানুষের মধ্যে নিজেকে উপস্থাপন করার প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সেলফি আজকের সমাজে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ আত্মপরিচয় গঠন এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। সেলফি ও আত্মপ্রতিকৃতিকে বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্বের আলোকে তুলনা করলে দেখা যায় আত্মপ্রতিকৃতি শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য নয়, এটি শিল্পীর মনের গভীরতম অনুভূতির প্রতিচিত্র। অন্যদিকে, সেলফি তাৎক্ষণিক আনন্দ বা সামাজিক মাধ্যমে সাড়া পাওয়ার উদ্দেশ্যে তোলা হয়। আত্মপ্রতিকৃতিতে সময়ের পরিবর্তন আবেগের দ্বন্দ্ব এবং সৃষ্টিশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেলফি সাধারণত সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা এবং পরিচিতি নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি একধরনের নিজেকে দেখানোর সংস্কৃতি। এক্ষেত্রে সৌন্দর্য, ফিল্টার, এবং আলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় জানা যায়, যখন আমরা নিজের ছবি দেখি বা তুলি তখন আমাদের মস্তিষ্কের “ভিজ্যুয়াল কোর্টেক্স” ও “রিওয়ার্ড সিস্টেম” সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আত্মপ্রতিকৃতি মস্তিষ্কের গভীর পর্যায়ের চিন্তাশক্তিকে উদ্দীপিত করে। অন্যদিকে সেলফি মূলত তাৎক্ষণিক আনন্দ প্রদান করে যা “ডোপামিন রিওয়ার্ড সিস্টেম” সক্রিয় করে। এ থেকে বোঝা যায়, আত্মপ্রতিকৃতি ব্যক্তিগত অনুভূতি ও আত্মপরিচয়কে বোঝার একটি উপায় যেখানে সেলফি মুহূর্তের আবেগকে প্রকাশ করে। সেকালের আত্মপ্রতিকৃতি বনাম একালের সেলফি এভাবে বিবেচনা না করে এটিকে ভাবতে পারি শিল্প ও প্রযুক্তির সংযোগ হিসেবে। কেননা সেলফি এবং আত্মপ্রতিকৃতি উভয়ই স্ব-পরিচয় প্রকাশের এক মাধ্যম। তবে আত্মপ্রতিকৃতি ছিল শিল্পীদের মনের গভীর অনুসন্ধান। আর সেলফি হলো সামাজিক সংযোগ ও স্ব-উপস্থাপনের প্রয়াস। আধুনিক সেলফির মাধ্যমে মানুষ নিজেদের প্রতিদিনের অনুভূতি প্রকাশ করছে কিন্তু আত্মপ্রতিকৃতি ছিল সময়ের আয়নায় চেতনার গভীরতাকে ধরে রাখা।
তথ্যসূত্র
https://mymodernmet.com/famous-self-portraits/
https://www.arthistoryproject.com/subjects/self-portrait/
https://danslegris.com/blogs/journal/self-portraits-in-art-why-artists-choose-themselves-as-subjects
https://www.frontiersin.org/journals/psychology/articles/10.3389/fpsyg.2017.00731/full
Salvador Dalí’s Literary Self-portrait https://scholars.unh.edu/lang_facpub/1/
Surrealist Self-Portrait Research Paper https://aithor.com/essay-examples/salvador-dali-surrealist-self-portrait-research-paper
https://www.fridakahlo.org/self-portrait-with-thorn-necklace-and-hummin
https://bangla.bdnews24.com/arts/21764