Published : 30 May 2025, 02:29 PM
চিত্রকলা নিয়ে অল্প বিস্তর আগ্রহ আছে এমন যেকোন একজন সাধারণ মানুষকে যদি লাতিন আমেরিকার কোনো নারী শিল্পীর নাম জিজ্ঞেস করা হয়, খুব সম্ভবত তিনি ফ্রিদা কাহলোর নামটিই বলবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ফ্রিদা সুরিয়ালিজম ও আত্মপ্রতিকৃতি শিল্পধারায় এক অমর নাম। ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেওয়ার পথে ফ্রিদা নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন।
বিশেষ করে নারী ও লাতিন আমেরিকান শিল্পী হওয়ার কারণে নিদারুণ উপেক্ষার শিকার হতে হয়েছে তাকে। যদিও ফ্রিদার শিল্পচর্চা সমকালে বিদ্যমান লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। কিন্তু অনেক লাতিন আমেরিকান নারী শিল্পী তেমন সৌভাগ্যবান ছিলেন না। লাতিন আমেরিকার শিল্পজগতে এমন অনেক নারী ছিলেন যাদের কাজ ছিল বিদ্রোহী মেজাজের; সমাজ-রাজনীতির বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ। শিল্পের মাধ্যমে নারীর অবস্থান পুনঃসংজ্ঞায়িত করার এক সাহসী প্রচেষ্টা। অথচ ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম প্রায় হারিয়ে গেছে।
শিল্প ইতিহাসবিদ এবং আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্পের কিউরেটর সেসিলিয়া ফাহার্দো-হিল , যিনি লাতিন আমেরিকান শিল্প নিয়ে কাজ করার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে Artsy-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের বলেছিলেন, - "শিল্পের ইতিহাসে যাঁরা প্রভাবশালী গল্প লেখার ক্ষমতা হাতে পেয়েছেন, তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে নারী এবং লাতিন আমেরিকায় তৈরি শিল্পকে উপেক্ষা করেছেন। এটি একধরনের বিচ্ছিন্নতা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।"
উল্লেখ্য ২০১৭ সালে "Radical Women: Latin American Art, 1960–1985"- শিরোনামে একটি প্রদর্শনী বড় পরিসরে আয়োজিত হয়েছিল। প্রদর্শনীটি প্রথমে লস অ্যাঞ্জেলেসের হ্যামার মিউজিয়ামে পরে ব্রুকলিন মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছে। কিউরেটর ছিলেন যৌথভাবে ফাহার্দো-হিল এবং আন্দ্রেয়া জিন্টা।
এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রদর্শনী যেখানে লাতিন আমেরিকান নারী শিল্পীদের কাজকে কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছে। তবে এটি নিছক একটি প্রদর্শনী ছিল না বরং শিল্পের ইতিহাসে নারীদের স্বীকৃতি ফিরিয়ে আনার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অংশ।
আজ আমরা সেইসব বিস্মৃত কয়েকজন বিপ্লবীর কথা বলব যারা শিল্পের মাধ্যমে সমাজের শেকল ভেঙেছেন অথচ যাদের নাম আমরা সেভাবে জানি না। যারা অনন্য শিল্পের মাধ্যমে বহু শিল্পীকে প্রভাবিত করেছেন। কিন্তু আজ অবধি তাদের পুরুষ সহকর্মীদের মতো পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পাননি।
তারসিলা দো আমারাল (১৮৮৬–১৯৭৩): ব্রাজিলের শিল্প-বিদ্রোহী
তারসিলা দো আমারাল ছিলেন ব্রাজিলের আধুনিকতাবাদী শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর কাজ ছিল ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার এক প্রচেষ্টা। তিনি "আবাপোরু" চিত্রকর্মের মাধ্যমে অ্যানথ্রোপোফাজিয়া আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, যা ইউরোপীয় শিল্পধারার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ব্রাজিলের নিজস্ব শিল্পধারা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
তারসিলা দো আমারাল ছিলেন ব্রাজিলের অন্যতম প্রধান আধুনিকতাবাদী শিল্পী, যিনি দেশটির চিত্রকলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর কাজ ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে আন্তর্জাতিক আধুনিক শিল্পের সাথে সংযুক্ত করেছে।
তারসিলা দো আমারাল ১৮৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের সাও পাওলো রাজ্যের কাপিভারি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ তাকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। শিল্পজীবন শুরু হয় ১৯১৬ সালে। সেসময় তিনি সাও পাওলোতে চিত্রকলা অধ্যয়ন শুরু করেন।
১৯২০ সালে তিনি প্যারিসে যান এবং সেখানে আন্দ্রে লোতে, ফার্নান্দ লেজার এবং আলবার্ট গ্লেইজেস-এর মতো শিল্পীদের সাথে প্রশিক্ষণ নেন। এই সময়ে তিনি কিউবিজম, ফিউচারিজম এবং এক্সপ্রেশনিজমের সাথে পরিচিত হন যা পরবর্তীতে তাঁর শিল্পশৈলীতে গভীর প্রভাব ফেলে।
আমারালের শিল্পশৈলীতে ব্রাজিলের স্থানীয় উপাদান এবং আন্তর্জাতিক আধুনিকতাবাদী ধারা একত্রিত হয়েছে। তিনি "গ্রুপো দোস সিঙ্কো" নামে পরিচিত একটি শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। ব্রাজিলের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই শিল্পগোষ্ঠী।
তারসিলা দো আমারালের শিল্পে নারী দেহের উপস্থিতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২৩ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম "আ নেগ্রা" আঁকেন। যেখানে একজন বৃহৎ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর বিমূর্ত রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। "A Negra" চিত্রকর্ম কৃষ্ণাঙ্গ ব্রাজিলের জাতিগত বৈচিত্র্য এবং উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। এটি জাতিগত ও রাজনৈতিকভাবে মুক্তির কথা বলে।
এই চিত্রকর্মে নারী দেহকে শক্তিশালী, আত্মনির্ভরশীল এবং ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চিত্রকর্মটি তাঁর শিল্পভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ যার মাধ্যমে ব্রাজিলের স্থানীয় সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈচিত্র্যকে তুলে ধরেছেন।
এই চিত্রকর্মটি যেভাবে আধুনিক শিল্পের আন্তর্জাতিক রূপকে কৃষ্ণাঙ্গ বিষয়বস্তুর সাথে মিশ্রিত করে উপস্থাপন করেছে তা ছিল একটি সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান। আঠারশো সালের শেষের দিকে তারসিলার জন্মের সময় ব্রাজিল ছিল দাসমুক্তির শেষ দেশগুলির মধ্যে একটি। চিত্রকর্মটি সম্ভবত ছোটবেলায় পরিচিত একজন দাসীর ছবির উপর ভিত্তি করে তৈরি। লক্ষ্য করলে বোঝা যায় কিভাবে তারসিলা এখানে নারীর বৈশিষ্ট্যগুলিকে অতিরঞ্জিত করেছে। আমরা তার অন্যান্য প্রধান চিত্রকর্মগুলিতে শরীরের এই বিকৃতি এবং অতিরঞ্জন দেখতে পাই। তারসিলা এই চিত্রকর্মের পটভূমিকে সহজ রঙের ধারায় উপস্থাপন করেছেন যা পৃথিবী এবং আকাশকে উদ্ভাসিত করে। ডানদিকে, তিনি একটি তির্যক সবুজ আকৃতি সন্নিবেশ করেছেন - একটি কলা গাছের বিমূর্ত পাতা, যা ব্রাজিলের ভূদৃশ্যের সর্বত্র পাওয়া যায়। এর সবকিছুই বিমূর্ত ভাবনার বাইরে গিয়ে শিল্পের মূল উপাদান—যেমন রং, আকার, গঠনকে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছেন যার ব্যাপক প্রভাব ১৯৪০ এর দশকে ব্রাজিলের শিল্পকলায় লক্ষ্য করা যায় ।
১৯২৮ সালে তারসিলা তার আরেক বিখ্যাত চিত্রকর্ম "আবাপোরু" আঁকেন। চিত্রকর্মটি ব্রাজিলের অ্যানথ্রোপোফাজিয়া (Anthropophagy) আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জোগায়। এই আন্দোলন ছিল ইউরোপীয় শিল্পধারার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ব্রাজিলের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়কে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা।
তারসিলা দো আমারালের চিত্রকর্মে ব্রাজিলের গ্রামীণ ও শহুরে জীবনযাত্রার এক অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়। তিনি তাঁর শিল্পে স্থানীয় সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর "Carnival in Madureira" চিত্রকর্মে ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের প্রাণবন্ত চিত্রায়ন দেখা যায়, যেখানে স্থানীয় মানুষের উচ্ছ্বাস ও আনন্দ ধরা পড়েছে। তাঁর শিল্পে স্থানীয় আদিবাসী সংস্কৃতি, প্রতীক এবং রঙের ব্যবহার দেখা যায়, যা ব্রাজিলের নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। ব্রাজিলের জীবনযাত্রা, নারী দেহের উপস্থিতি এবং নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে।
তারসিলা দো আমারালের শিল্পকর্ম নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হলে, এটি সরাসরি নারীবাদী আন্দোলনের অংশ না হলেও নারীর অবস্থান ও পরিচয়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। তাঁর কাজ ব্রাজিলিয়ান সমাজে নারীর ভূমিকা, জাতিগত বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরেছে।
তারসিলার শিল্পশৈলী অন্যান্য আধুনিকতাবাদী শিল্পীদের থেকে আলাদা কারণ তিনি ব্রাজিলের স্থানীয় উপাদানকে আন্তর্জাতিক আধুনিক শিল্পের সাথে সংযুক্ত করেছেন। তার চিত্রকর্মে কিউবিজম, ফিউচারিজম এবং এক্সপ্রেশনিজমের প্রভাব থাকলেও, তিনি এগুলোকে ব্রাজিলিয়ান সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে এক নতুন শিল্পধারা তৈরি করেছেন।
তারসিলা দো আমারালের শিল্পকর্ম তাঁর কাজ শুধুমাত্র ব্রাজিলের শিল্পজগতে নয়, আন্তর্জাতিক শিল্পজগতে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর চিত্রকর্ম আজও ব্রাজিলের জাতীয় পরিচয়ের প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হয়।
মারিয়া ইস্কিয়ের্দো (১৯০২–১৯৫৫): মেক্সিকোর বিস্মৃত বিপ্লবী
মারিয়া ইস্কিয়ের্দো মেক্সিকোর শিল্পজগতে এক অনন্য নাম। তিনি ছিলেন সেই নারী, যিনি পুরুষতান্ত্রিক শিল্পজগতে নিজের জায়গা তৈরি করেছিলেন। প্রথম মেক্সিকান নারী হিসেবে নিউইয়র্কে একক প্রদর্শনী করেছিলেন। তাঁর কাজ নারীর শক্তি, স্বাধীনতা ও সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরেছিল। অথচ দিয়েগো রিভেরা ও অন্যান্য পুরুষ শিল্পীদের ছায়ায় তাঁর নাম প্রায় হারিয়ে গেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে নিজের শিল্পের মাধ্যমে নারীর শক্তি, স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়কে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল এক সংগ্রামের ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি আঁচড় ছিল বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি।
১৯০২ সালে মেক্সিকোর হালিস্কো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন মারিয়া। শৈশব কেটেছে কঠোর ধর্মীয় পরিবেশে যেখানে নারীদের স্বাধীনতা ছিল সীমিত। মাত্র ১৪ বছর বয়সে এক সৈনিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই বিয়ের শৃঙ্খল তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। নিজের জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৭ সালে মেক্সিকো সিটির San Carlos Academy of Fine Arts-এ ভর্তি হন।
মারিয়া ইস্কিয়ের্দোর শিল্পজীবন ছিল এক কঠিন লড়াই। তার কাজ ছিল মেক্সিকোর ঐতিহ্য, নারীর শক্তি ও সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরার এক সাহসী প্রচেষ্টা। দিয়েগো রিভেরা, হোসে ক্লেমেন্তে ওরোস্কো এবং দাবিদ আলফারো সিকেইরোস-এর মতো বিখ্যাত পুরুষ শিল্পীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের শিল্পের মাধ্যমে নারীর অবস্থানকে তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি নিউইয়র্কের Art Center-এ প্রথম মেক্সিকান নারী শিল্পী হিসেবে একক প্রদর্শনী করেন।
মারিয়া ইস্কিয়ের্দোর শিল্প নারীবাদী আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল। চিত্রকর্মের মাধ্যমে নারীর শক্তি, স্বাধীনতা ও সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরেছিলেন। তার কাজ ছিল "The Allegory of Work" এবং "The Allegory of Liberty" এই দুইয়ের সমন্বয়। যার মধ্য দিয়ে তিনি নারীর সংগ্রাম ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
মারিয়া বিশ্বাস করতেন যে "নারীর ব্যক্তিগত জীবনই রাজনৈতিক", যা পরবর্তী নারীবাদী আন্দোলনের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে। তার শিল্পে নারীর আত্মপরিচয়, শক্তি ও স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
১৯৫৫ সালে একজন বিস্মৃত শিল্পী হিসেবে মারিয়া ইস্কিয়ের্দো মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিজের শিল্পের মাধ্যমে সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে নারীর শক্তিকে তুলে ধরেছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁকে ধীরে ধীরে শিল্পজগৎ থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর জীবন ও কাজ আজও নারীবাদী শিল্পের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে আছে ।
লিজিয়া ক্লার্ক (১৯২০–১৯৮৮): ব্রাজিলের শিল্প-মনস্তাত্ত্বিক
লিজিয়া ক্লার্ক সেই শিল্পী যিনি শিল্পকে শুধু ক্যানভাসে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করিয়েছেন। তাঁর "Bichos" সিরিজ ছিল ইন্টারঅ্যাকটিভ ভাস্কর্য যা দর্শকদের শিল্পের অংশ হতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিল্প শুধুমাত্র দেখার জন্য নয়, বরং অনুভব করার জন্য।
সিলিয়া সানচেস (জন্ম ১৯২৮): কিউবার বিমূর্ত বিপ্লবী
সিলিয়া সানচেস ছিলেন কিউবার বিমূর্ত শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ। তার সৃষ্টিকর্ম নারীর শরীরের বিমূর্ত রূপ যা শিল্পের মাধ্যমে নারীর শক্তিকে তুলে ধরেছিল। অথচ তার নাম আজও শিল্প ইতিহাসে সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
মারিসল (১৯৩০–২০১৬): ভেনেজুয়েলার বিদ্রোহী ভাস্কর
মারিসল ভাস্কর্যের মাধ্যমে নারীর সামাজিক অবস্থানকে ব্যঙ্গ করেছেন। তার কাজ পপ আর্টের সাথে নারীবাদী চিন্তার সংমিশ্রণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হাস্যকর দিকগুলোকে তাঁর শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন।
মার্তা মিনুহিন (জন্ম ১৯৪৩): আর্জেন্টিনার শিল্প-উন্মাদনা
মার্তা মিনুহিন শিল্পকে শুধুমাত্র ক্যানভাসে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের সাথে সংযুক্ত করেছেন। তার "The Parthenon of Books" ছিল এক ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম যেখানে নিষিদ্ধ বই দিয়ে একটি পার্থেনন তৈরি করা হয়েছিল। এটি আমাদের শেখায় জ্ঞান ও মুক্ত চিন্তা কখনোই দমন করে রাখা যায় না বরং তা বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার শিখরে বদলে যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্প শুধুমাত্র রঙ ও আকৃতির খেলা নয়। শিল্প হচ্ছে সমাজের প্রতিবাদের ভাষা।
বর্তমানে বুয়েনোস আইরেসে বসবাস ও কাজ করছেন। তার সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা ও পারফরম্যান্স শিল্প আজও আন্তর্জাতিক শিল্পজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে।
মিনুহিন একজন কনসেপ্টচুয়াল ও পারফরমেন্স শিল্পী হিসেবে সমাদৃত। ১৯৬০-এর দশকে নিজস্ব উদ্ভাবনী কাজের মাধ্যমে শিল্পের প্রচলিত সীমা ভাঙেন। রূপান্তরমূলক ধারণা ও হ্যাপেনিংস যেমন বিখ্যাত “La Menesunda,” দর্শকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে শিল্পকর্মকে জীবন্ত করে তোলেন। তার কাজের মূল উপাদান হিসেবে অংশগ্রহণ, অভিজ্ঞতা এবং রঙিন ইমপ্রেশনকে বিবেচনা করা হয়।
অনেক সময় তার সৃষ্টিশীল প্রদর্শনী ও ঘটনা শহরের রাস্তাঘাটের মতোই প্রাণবন্ত এবং চঞ্চল মনে হয়। শিল্পকে শুধু একটি ক্যানভাসে রঙের মিলন হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেনি বরং সামগ্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার মাধ্যমেও রূপান্তরিত করেছেন। তার কাজের ধারায় শিল্পকে জনচেতনায় উত্তেজনা ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়।
বর্তমান সময়েও মার্তা মিনুহিন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তার শিল্পকর্মের জগতকে নবজীবন দিয়ে চলেছেন। তিনি তার কার্যক্রম, ভাবনার উন্মেষ ও ক্রমাগত নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজন্মের শিল্পীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতিফলিত হচ্ছেন।
তেরেসা বুর্গা (১৯৩৫-২০২১) : পেরুর মাটিতে সৃষ্টির দীপ্তি
তেরেসা বুর্গা পেরুর মাটির গহন থেকে উদ্ভাসিত এক অনন্য শিল্পী। সৃজনশীলতাকে নতুন রূপে আবিষ্কারের অগাধ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রেরণার ছোঁয়া দিয়েছেন। ইকিতোস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব ছিল প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনের এক মাধুর্যময় অধ্যায় যেখানে বয়ে যেত স্বাধীন মন এবং বাস্তবতার রঙিন খেলা। লিমার পন্টিফিক্যাল ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটিতে চিত্রকলার অধ্যয়নে স্নাতক। দ্রুতই নিজেকে এক এগিয়ে চলা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত “Lima imaginada” প্রদর্শনীতে তার সৃষ্টিসম্ভার সূক্ষ্মতা ও সূর্যের আলোয় ভেজা রঙের খেলা দর্শকদের মুগ্ধ করে যা শহরের জীবনের নান্দনিকতা ও মুহূর্তের অনুভূতিকে অঞ্জলি স্বরূপ প্রকাশ করেছিল।
তারপর তিনি “Arte Nuevo” নামক সৃজনশীল গোষ্ঠীর একজন মেধাবী সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন । পপ আর্ট, অপ আর্ট ও অভিনব পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নবরূপ সৃষ্টির বাঁধন ভেঙ্গে ফেলেন। ফুল ব্রাইট অনুদানের আশীর্বাদে আমেরিকার School of the Art Institute of Chicago-এ ভর্তি হন। এখানে তিনি শিল্পকলা ও ধারণার নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করেন। তার কাজ আরও বুদ্ধিদীপ্ত ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ফিরে এসে তেরেসা বুর্গা পেরুর সমাজের নান্দনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে মাল্টিমিডিয়া ইনস্টলেশন ও কনসেপ্টচুয়াল আর্টের মাধ্যমে চিত্রিত করেন। তার “Autorretrato. Estructura. Informe, 9.6.1972” ও “Cuatro Mensajes” ইনস্টলেশনগুলোতে সমাজের জটিলতা, নারীর অবস্থা ও আধুনিকতার প্রশ্ন তুলে ধরা হয়। ১৯৮০-৮১ সালে “Perfil de la mujer peruana” প্রকল্পের মাধ্যমেও তিনি পেরুর নারীদের অন্তর্জাগরণ ও সংগ্রামের বহির্বিশ্বকে তুলে ধরেন।
পেরুর এই প্রতিভাবান শিল্পী মূলত একজন কনসেপচুয়াল আর্টিস্ট। গবেষণামূলক ও মিডিয়া-ভিত্তিক শিল্পকর্মের মাধ্যমে নারীদের অবস্থা ও সমাজের বিভিন্ন কাঠামোগত প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। তাঁর কাজ আন্তর্জাতিকভাবে এক প্রজ্ঞাবান আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃত হলেও তার শিল্পকর্ম দীর্ঘদিন পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পায়নি। তবে ২০১৭ থেকে শুরু হয়ে ২০১৯ পর্যন্ত নিউইয়র্ক এবং অন্যান্য প্রদর্শনীতে তার কাজের পুনরুজ্জীবন ঘটে যা তাকে আন্তর্জাতিক শিল্প ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে।
তেরেসা বুর্গা সাধারণ চিত্রকলার ধারণা থেকে সরে এসে বহুমুখী মিডিয়া ও তথ্যভিত্তিক উপাদানগুলিকে একত্রিত করেছেন। তার চিত্রকর্ম রঙ ও আকারের খেলার মাঝে সমাজের জটিল প্রথা ও দমনমূলক কাঠামোকে চিহ্নিত করে। নানান গাণিতিক ও তথ্যগত উপাদান একত্রে ফুটে ওঠে। দর্শকের চিন্তাকে জাগিয়ে তোলে। একদিকে শিল্পকর্মকে মর্মস্পর্শী করে, অন্যদিকে, সমাজের নানা প্রথাগত দিককে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তেরেসা বুর্গা মারা যাওয়ার পরে শিল্পপ্রেমী ও ইতিহাসবিদেরা তার সৃষ্টির অমরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার জীবন ও কাজ আজও অনেকে অনুপ্রেরণার উৎস মনে করেন। তার কাজ লাতিন আমেরিকার কনসেপচুয়াল আর্টকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছে।
এইসব শিল্পীরা নিজেদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে সমাজের শেকল ভেঙেছেন। তাদের কাজ ছিল বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, এবং নারীর শক্তির উদযাপন। অথচ ইতিহাস তাদের নামকে প্রায় মুছে ফেলতে চেয়েছে।
কিন্তু আমরা তাদের ভুলে যেতে পারি না। এই রেডিক্যাল নারী শিল্পীরা বিদ্রোহী, কিন্তু মৌলবাদী নন। নারীবাদী কিন্তু শুধুমাত্র নারীর অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তারা সমাজের গভীর সমস্যাগুলোকে চিত্রিত করেন এবং শিল্পের মাধ্যমে পরিবর্তনের ডাক দেন। তাদের কাজ আমাদের চোখ খুলে দেয় আমাদের চিন্তাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিল্প শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্য নয়—এটি বিদ্রোহের জন্যও।
তথ্যসূত্র
Apollo Magazine https://www.apollo-magazine.com/tarsila-do-amaral-the-mother-of-brazilian-modernism/
Frieze https://www.frieze.com/article/brazilian-modernism-feminism-disguise
WikiArt (https://www.wikiart.org/en/tarsila-do-amaral/
Britannica https://www.britannica.com/biography/Tarsila-do-Amaral
AWARE Women Artists https://awarewomenartists.com/en/artiste/tarsila-do-amaral
The Art Story https://www.theartstory.org/artist/izquierdo-maria/
Rock & Art https://www.rockandart.org/maria-izquierdo-art-and-double-oppression/
Wikipedia https://en.wikipedia.org/wiki/Teresa_Burga
The Art Newspaper https://www.theartnewspaper.com/2021/02/12/teresa-burga-trailblazing-peruvian-conceptualist-artist-has-died-aged-86
Artsy https://www.artsy.net/article/artsy-editorial-11-radical-latin-american-women-artists