Published : 07 Jun 2025, 12:29 AM
ইসলামকে দ্বীন হিসেবে, এক পবিত্র পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখা হলে, একটি সর্বজনীন ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি হিসেবে তা প্রকাশিত হয় যা পার্থিব সম্পর্কের প্রতি গভীরভাবে নিরপেক্ষ বা উদাসীন না থেকে, স্রষ্টার কাছে মানুষকে দায়বদ্ধ করে। এই দায়বদ্ধতা ধর্মের নির্যাসকে বিশুদ্ধ করে তোলে যার ফলে ইসলামের দুনিয়াদারি সর্বজনীন ও শাশ্বত রূপে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। এর ফলে সকল মানুষের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি ও সেবামাহাত্ম্য প্রকাশমান হয়। ইসলামকে শুধু আইন বা মতবাদ হিসেবে দেখলেই চলে না, বরং এটিকে একটি মর্মার্থ পদ্ধতি ( signification system) হিসেবেও দেখা উচিত যাতে থাকে প্রতীক এবং চিহ্ন রূপে অনেক অর্থময়তার বিষয়, যা অবশেষে হয়ে ওঠে মানবিক ডিসকোর্স। অনুশীলিত ইসলামকে বলা যায় অর্থময়তার ও মূল্যবোধের এমন এক ট্যাপেস্ট্রি যার দ্বারা মানুষ পরস্পর যোগাযোগ করতে পারে, যা বাস্তবতা ও তার সামাজিক অর্থময়তার ওপর বিস্তারলাভ করে। এখানে ‘‘যোগাযোগ’’ শব্দটি একটি চৌম্বক শব্দ যা মিলনের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়।
ইসলামি ফিকহশাস্ত্রবিদরা জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকে বলে থাকেন, ইসলামে ইখতিলাফ বা বহুত্ববাদের সুযোগ রয়েছে। স্রষ্টার প্রকাশিত বাক্য, রাসুলকে অনুসরণ, গোষ্ঠীর সাধারণ ঐকমত্য এবং মানুষের যুক্তির দিগন্তায়নের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে জ্ঞানতাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটি হলো পরম সত্য, দ্বিতীয়টি পরিবর্তনশীল চক্রাকার মানবযুক্তি। দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে ধরতে চায় কিন্তু পারা সম্ভব হয় না, কিন্তু প্রচেষ্টা থাকে অব্যাহত। ফলে চিন্তা বা ব্যাখ্যা আপতিক হয় যার পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি ও মাজহাবের জন্ম হতে থাকে। যেহেতু স্থানকালের ভিন্নতার কারণে চিন্তার পরম হওয়া অসম্ভব, তাই এই ভিন্নতা প্রাকৃতিক। সুতরাং একে ভ্রান্তি বলার সুযোগ নেই। তা-ই ইসতেহাদ আর মুসতাহিদ, এ দুটির পারস্পরিক একটি অন্বয় সৃষ্টি করার মাধ্যমে চিন্তার গতিশীলতাকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে যার চর্চা আরও প্রসারিত হওয়া উচিত। পৃথিবীতে ইসলামের প্রধান মোকাবিলাটা অন্য ধর্মের সঙ্গে নয়, মানুষের বা অন্য ধর্মের প্রতি হিংসা বা অসূয়া প্রদর্শনে নয়, বরং ইসলামের অভিযোজনের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে বৃদ্ধি করাই প্রধান মোকাবিলা। সুতরাং নিজের সঙ্গে নিজের মোকাবিলাটা জরুরি; পরিবর্তনের সংস্কৃতিকে আহবান করা এবং জারি রাখা একান্ত আবশ্যক। এর মর্মার্থ হলো, সাংস্কৃতিক ইসলামের অন্তঃশক্তিকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব যা সমঝোতা ও উপযোজনকে বিস্তৃত করে তুলবে এবং ইহজাগতিক মানববান্ধবতাকে উদ্ভাসিত করবে; এবং এটাই ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্য, কারণ ইসলাম প্রধানত মানবজাতির জন্য একটি আদর্শিক বন্দোবস্ত আনতে চায় যার মধ্যে সকল মানুষের মুক্তির সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে।
ইসলামের যে আধ্যাত্মিকতা, যা আচরণের ওপরে অবস্থান করে, যা অন্তরাভিনিবেশের মাধ্যমে আসে, যা ধর্মের ‘‘অবজেক্টিভ’’ বা বহিরাশ্রয়ী বিষয়াদিকে অতিক্রম করে ‘‘সাবজেক্টিভ’’ বা আত্মগত ও অন্তরাশ্রয়ী অংশকে উন্নত করে, তা-ই ইসলামের ‘‘পোয়েটিকস’’ বা সৃষ্টিশীল মুখর স্বাধীনতা যা সৌন্দর্য, জ্ঞান, কল্পনাপ্রতিভা এবং সংবেদী অনুভব থেকে জন্মলাভ করে। এটাই যে-কোনোকিছুকে গতিশীল দার্শনিকবিভা দেয়। তাছাড়া ইসলাম শুধু আইন নয়, সংস্কৃতিও; তা-ই ইসলাম শুধু ইসলাম নয়, ইসলামিকেইট(islamicate) । ইসলামিকেইট মানে ইসলামকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক-সামাজিক-বৌদ্ধিক বিবেচনায় ইসলামের যে ভৌত ও অভৌত বহুত্ববাদী সৌন্দর্যায়ন, সেটাই। অর্থাৎ, ইসলাম=ধর্ম হলে ইসলামিকেইট=সংস্কৃতি=সেক্যুলার। এখানে ইসলামের বস্তুগত সৌন্দর্য সেক্যুলার, কারণ তা সবাইকেই, এমনকি অমুসলমানদেরও, তার নিজের অংশভাক্ করে নিজের মতো করে। এখানে রাজনৈতিক ইসলাম নেই, রয়েছে আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক ইসলাম, মানুষই যার শুরু ও শেষ কথা। আমার মনে হয়, ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার যে দায়িত্ব মুসলমানদের রয়েছে তার রূপ সেক্যুলার, কারণ দায়্যি যখন কাউকে দাওয়াত দেবেন তখন তিনি সেই ব্যক্তির মধ্যে সম্ভাবনাকে মান্য করেই দাওয়াত দেবেন, আর এই সম্ভাবনার কারণে পুরো ব্যাপারটাই সেক্যুলার একটি রূপ ধারণ করে; কারণ একজন অমুসলিমের ইসলামের দাওয়াত গ্রহণের সম্ভাবনা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, সুতরাং সম্ভাবনাময় একজনকে ইসলামের দাওয়াত দিতে গেলে সাম্প্রদায়িকভাবে তা করা যাবে না, ঘৃণা ছড়ানো যাবে না; অর্থাৎ দাওয়াতটিকেও হতে হবে আন্তরিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক। ‘‘ইসলাম’’ শব্দটির সাধারণ ব্যবহার থেকে এটা স্বীকার করি যে ধর্মটি সম্প্রসারিত হচ্ছে, আর যখন তা ঘটছে তখন সত্যিকারভাবে আমরা মুসলিমদের কথাই বলে থাকি---যা তারা ভাবে, বলে, এবং করে থাকে আর কীভাবে তারা অমুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। কীভাবে মোসলমানরা তাদের নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে দেখে এবং সে-অনুযায়ী কাজ করে তার চেয়েও অন্যরা একে কীভাবে দেখে, সেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অমুসলিম সমাজের সঙ্গে মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব ইসলাম কীভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কাজ করে, এর নমনীয়তা ও বহুমুখী মানববান্ধব রূপ। আর যখন আমরা এই মিথস্ক্রিয়াগুলোর দিকে তাকাই তখন আমরা দেখতে পাই যে ধর্মীয় মতবাদগুলো প্রায় কখনওই মুখ্য কোনোকিছু নয়, বরং জাতিগত ও সম্প্রদায়গত বিষয়ই প্রধান হয়ে ওঠে। ইসলাম রাজনৈতিক পরিবেশকে পরিবর্তিত করেছিল আবার পরিবেশের দ্বারা পরিবর্তিতও হয়েছিল। ইসলামি সাম্রাজ্য জাতিগত জনসংখ্যা, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি বিবেচনায় বিশ্বজনীন একটি রূপ লাভ করেছিল এবং এই ফিউশন প্রক্রিয়ায় আদানপ্রদানের মাধ্যমে একটি অনন্যতা অর্জন করেছিল যা প্রাথমিকভাবে ইসলামি হলেও শেষাবধি বহুত্ববাদী। ফলে এই একত্রীকরণ শরিয়াকে নিয়েও একটি অভিন্ন সভ্যতার পত্তন করেছিল যা সকল মানুষের অংশগ্রহণকে স্বতঃস্ফূর্তরূপ দিয়েছিল। এভাবে একটি জাতিগত চিন্তা থেকে বৈশ্বিক চিন্তার দিকে ইসলামের উত্তরণ ঘটেছিল। এবং এর দ্বারা শুধু আরব শ্রেষ্ঠত্বের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে ইসলাম একটি বিশ্বশ্রেষ্ঠত্বের অংশীদার হয়ে উঠেছিল।
দুই.
আমি এমন-এক সামাজিক পরিবেশে বড়ো হয়েছি যেখানে এই সাংস্কৃতিক ইসলামের রূপকেই দেখেছি আমি, কারণ এটাই আমার অনুসন্ধান ছিল। শুধু দেখেছি বললে অসম্পূর্ণ হবে, আমি এই রূপে মুগ্ধও হয়েছি। একজন মুসলিম না হয়েও তাতে আমার অধিকার রয়েছে বলেই আমি মনে করি। পৃথিবীর একজন প্রজা (সাবজেক্ট) হয়ে তার সব শুভত্বেই আমার বিশেষ অংশীদারত্ব রয়েছে বলে আমি বিশ্বস করি। আমার মনে হয়, প্রতিটি ন্যায়ই আমাদের, প্রতিটি সৎকর্মই আমাদের, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে। একইভাবে প্রতিটি অন্যায়, অবিচারই আমাদের বিরুদ্ধের।
ইসলামের এই সাংস্কৃতিক রূপের একটি প্রধান ও বিশেষ সৌন্দর্য হলো আমাদের ঈদ উদ্যাপন। আমরা মুখিয়ে থাকতাম কবে আসবে ঈদ আর আমরা মুসলিম-অমুসলিম বন্ধুরা একসঙ্গে খাব, আড্ডা দেব, খেলব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গায়ে গা লাগিয়ে বসব, ঘন দুধ আর বেশি চিনি দিয়ে চা খাব, একটা সিগারেটে সবাই মিলে টেনে বেড়াব। এটা ছিল আমাদের যূথবদ্ধ মানসিক অভিযান।
আমি ধর্মের সাংস্কৃতিক দিগন্তের কথাটাই বলছি যেখানে সর্বমানবের অংশগ্রহণ সম্ভব। সব ধর্মেরই দুটি দিক রয়েছে: একটি তার আচারিক দিক, আর অন্যটি তার সাংস্কৃতিক দিক। আচারিক দিকটা স্বতন্ত্র ও ধর্মানুসারীনির্ভর, ওই ধর্মানুসারীদের ছাড়া অন্যদের সেখানে থাকার সুযোগ নেই; এটা আচরণের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সাংস্কৃতিক দিকটা উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক, যেখানে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের আমন্ত্রণ ও অধিকার থাকে। এটা আন্তঃধর্মীয় মিলনেরও জায়গা। আমি তো এটা দেখেই বড়ো হয়েছিলাম, তাতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। যে জীবনটা কাটিয়ে এসেছি তাতে বিভেদ যে ছিল না তা নয়, কিন্তু দিনশেষে তা প্রধান হয়ে ওঠেনি, আচরণটা কষ্টের হয়ে ওঠেনি। যদি তা-ই হতো তবে তা কী করে এখন স্মৃতি হয়ে তার মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে!
ইসলামের ফাউন্ডেশনালিজম বা প্যারাডিগমেটিক বাতাবরণটির সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে পরিচিত নই, বা স্বাভাবিক কারণেই তার মেটান্যারেটিভটিও আমার অনেকটাই অধরা, কিন্তু ইসলামের সিনট্যাগমেটিক রূপটির সঙ্গে আমি পরিচিত, আত্মস্থ। এটা সম্ভব হয়েছে আমার মুসলিম বন্ধুদের কারণে যারা নিজেরাই একটা ডিসকোর্স, যারা আমাকে ‘‘আদার’’ না ভেবে ‘‘আত্ম’’ই ভেবে থাকে। আমরা তো এভাবেই আত্ম ও পরকে পরস্পর বিনিময় করে বেঁচে থাকতে পারি। এই দ্বৈততা (বাইনারি) বিরুদ্ধতায় (অপজিশন) না গিয়ে একটি সমন্বয়ের প্রতীকজ্ঞান হয়ে আমাদেরকে দীপ করে তুলতে পারে। এটাও এক ইহজাগতিক পরিত্রাণভাবনা যা দ্বারা আমরা দুনিয়াদারির বর্তমানতাকে মান্যতা দিয়ে একটি অনন্ত প্রস্থানের পথকে শিরোধার্য করতে পারি। পারি না!