Published : 03 Jun 2025, 07:05 PM
আপনি আমাদের দেশের একজন অগ্রগণ্য অনুবাদক। অনুবাদের জগতে কীভাবে এলেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : অনেকের মতো আমারও লেখালেখি শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে। মনে পড়ে কলেজে পড়াকালীন একটা ছোটগল্প লিখে রাজশাহী বোর্ডের প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরষ্কারও পেয়েছিলাম| পড়াশোনা যা করতাম হয়তো দেখা গেল কোনো বিদেশি সাহিত্য পড়লাম, খুব ভালো লাগল, তখন অন্যদের সঙ্গে ভালোলাগাটা শেয়ার করতে ইচ্ছে হতো। ওই ইচ্ছেটা থেকেই আসলে ধীরে ধীরে অনুবাদ করতে শুরু করা। অনুবাদের ক্ষেত্রে বিদেশি চিরায়ত সাহিত্যগুলোর ব্যাপারে আমার আগ্রহ বেশি, যা হয়তো আমাদের এখানকার পাঠকরা অন্য ভাষা না জানায় বা তাতে দুর্বল বলে পড়তে পারেননি।
আপনার বিশেষ বিশেষ অনুবাদ, যেমন গালিভার্স ট্রাভেলস …
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : গালিভারস ট্রাভেলস আমার আগে এখানে কেউ অনুবাদ করেনি। সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে হয়েছিলো, কিন্তু সেটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তারপর চিনুয়া আচেবে, যোশেফ ক্যাম্পবেলের মিথের শক্তি, মার্কেসের পেয়ারার সুবাস, আকুতাগাওয়ার রাসোমন। আকুতাগাওয়ার “রাসোমন” মূলত বিখ্যাত হয়েছিল কুরোশাওয়ার রাসোমন সিনেমাটার জন্য। আকিরা কুরোশাওয়া তো রাসোমন মূলত দুটো গল্প এক করে বানিয়েছিলনে-- “রাসোমন” আর “বাঁশবনে খুন”।
হ্যাঁ, দুটো গল্প মিলিয়ে বানিয়েছিলেন। ৫০-এর শুরুর দিকে কুরোশাওয়ার এই রাসোমন সিনেমাটি কিন্তু আমাদের এখানেও সাড়া ফেলেছিল। বন্ধুবান্ধব বা পাঠকরা কখনও মৌলিক লেখালেখির ব্যাপারে আপনাকে আগ্রহী হতে বলেনি?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : তারা সবসময়ই মৌলিক লেখার ব্যাপারে বলে। অনুবাদের ব্যাপারে তাদের কথা হল-- অনুবাদ করে কী লাভ? পরের ধনে পোদ্দারি কেন? কিন্তু আমি মনে করি, সবাই আসলে পরের ধন নিয়েই কাজ করছে। যারা সৃজনশীল কিছু করছে তারাও তো আসলে নিজের মতো করে অন্যদের চিন্তাভাবনা রি-প্রোডিউস করছে। পৃথিবীতে মৌলিক বলে তো কিছু নেই। Everything is given; সেটাকে যে যার মতে করে নিচ্ছে। যার যার মতো করে নেওয়া—এখানেই যেটুকু সৃজনশীলতা। এছাড়াও আমার বিশ্বাস অনুবাদ মূলত একটি সৃজনশীল কাজ। একটি ভিন্ন সংস্কৃতির লেখা আরেকটি সংস্কৃতির ভাষায় রূপান্তর করতে গেলে সৃষ্টিশীল হতে হয় বৈ কি।
এ প্রসঙ্গে গদার, জাঁ লুক গদারের একটা কথা ছিল--Everything is the translation of something else’
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : অবশ্যই। সবকিছুই অনুবাদ, মূল বলে কিছু নেই, একমাত্র প্রকৃতি ছাড়া। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন--subject matter অর্থাৎ, মূল বিষয়টা হল পানির মতো, সেটাকে কে কী আকার দিচ্ছে, বা কী আকৃতির পুকুর কাটছে সেটাই আমরা খেয়াল করি। আসলে সৃজনশীলতা বলতে কিছু নেই। আছে সর্বত্রই—মানব সমাজে, বিশ্বব্রহ্মান্ডে সর্বত্রই—রূপান্তর, মেটামরফসিস, নবরূপে বিন্যাস|
অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনি কোন ধরনের অনুবাদকে আদর্শ বলে মনে করেন? Literal translation নাকি transcreation?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : Literal Translation বলতে কিছু নেই। যেমন বোরহেস বলেন, Literal translation is not literary. জন্মসনদ, বিয়ের সার্টিফিকেট, মেডিক্যাল রিপোর্ট, ডিগ্রি সার্টিফিকেট ইত্যাদিও শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত সাহিত্যের আক্ষরিক অনুবাদ তো একেবারেই অসম্ভব। আক্ষরিক অনুবাদ বলতে তাই কিছু নেই। এতে কোনো অর্থই তৈরি হয় না কারণ একটা সম্পূর্ণ অন্য সংস্কৃতির অন্য পরিপার্শ্বের বিষয়কে আমি হুবহু আরেকটা সংস্কৃতির মধ্যে বসাতে পারি না। মৌমাছিরা যদি আস্ত ফুল তুলে এনে মৌচাকে সাজায় তো তাতে কার কি লাভ? সেন্স ফর সেন্স আর ওয়ার্ড ফর ওয়ার্ড-এর বাহাস আড়াই হাজার বছর আগের সেই হোরেস সিসেরো থেকে শুরু হয়ে বহুকাল চলেছে। এখন এ নিয়ে আর কেউ তর্ক করে না। অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাষার কথা মাথায় রাখতে হয়। যে পড়বে সে যেন বুঝতে পারে --সেকথা সব সময় মনে রাখি। দুই সংস্কৃতিতে নানা গড়মিল থাকে। সে ক্ষেত্রে আমি লক্ষ্য ভাষায় equivalence খুঁজি, নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে উৎস ভাষাকে কোনোভাবে সম্পর্কিত করা যায় কিনা খুঁজি। Equivalence না পেলে একদম অচেনা, অজানা Alien-এর মতো ব্যাপারটাকে লক্ষ্য ভাষায় পাঠকদের মেজাজের যতটা কাছাকাছি আনা যায় সেই চেষ্টা করি।
Equivalence খোঁজাটা কি অনেকটা ‘দেশীয়করণ’-এর মতো?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : কিছুটা তো বটেই। ইংরেজিতে অনেক বাকবিধি আছে যার ইকুইভ্যালেন্ট বচন বাংলাতেও আছে। যেমন ধরুন ইংরেজি Fools rush where angels fear to treadকে যদি আক্ষরিক অর্থে অনুবাদ করি, তাতে যেমন শোনাবে তার চেয়ে যদি বলি হাতি ঘোড়া গেল তল, ভেড়ায় বলে কতো জল, তাহলে তা বাংলা পাঠককে সরাসরি উৎস সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করবে।
বিষ্ণু দে যখন এলিয়টকে অনুবাদ করেন, তখন আমরা দেখি যে উনি লন্ডন ব্রিজকে হাওড়া ব্রিজ বলছেন, ওয়েস্টার্ন কিছু মিথ বা চরিত্রকে হিন্দু পুরাণের সঙ্গে সম্পর্কিত করে উপস্থাপন করছেন-- এটার ব্যাপারে কী মনে হয়?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : উনি ওভাবে হয়তো একটা Transcreation করতে চেয়েছেন। বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী ও তরঙ্গীনিতে গ্রিক অ্যাগামেমননকে উনি নাম দিচ্ছেন অগ্নিমাণিক্য, ইফিজেনাইয়াকে বলছেন ফেনভঙ্গিনী, নামগুলোকে কাছাকাছি রেখে পাল্টে দিয়ে একেবারে গ্রিক মডেলে নাটকটি লিখেছেন; এটা অন্য ধরনের Creation, ঠিক Translation নয়। জীবনানন্দ দাশ যখন ইয়েটস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন—‘হায় চিল সোনালী ডানার চিল’-- দুটো কবিতায় কত মিল আবার বিস্তর পার্থক্য, তখন পুরোপুরি নতুন একটা কবিতার জন্ম হয়। অক্তাভিও পাজ কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে এভাবে বলেছেন যে, Poetry is not lost in translation, rather a new poem is born. তিনি বলছেন, দু’জন কবি--যে অনুবাদ করছে আর যার লেখাটি অনূদিত হচ্ছে--অনুবাদের ভেতর দিয়ে তারা একই বিন্দু থেকে মূলত দু দিকে দু মুখী, বিপরীত দুই যাত্রাপথের সূচনা করছে। ফলে নতুন এক কবিতা জন্ম নিচ্ছে। সেজন্য অনুবাদ একটি নতুন সৃষ্টি বৈকি।
এটা যেন এক Paradox: সৃজন মানেই অনুবাদ কিংবা অনুবাদ মানেই সৃজন। একই সঙ্গে Creation, আবার পুরোপুরি Creation নয় —এমন কি?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : তা বলতে পারনে। প্যারাডক্সই বলুন, কি ডায়্যালক্টিকস বলুন, কি ডাইকোটমিই বলুন, সৃষ্টির পদ্ধতি তো এটাই। দুই বিপরীতের মিথস্ক্রিয়ায় তৃতীয় কিছু।
এমন কোনো Text, যেমন ধরুন কমলকুমার মজমুদারের অন্তর্জলী যাত্রা; তার শব্দ, বাক্য গঠন, ভাষা এমন যে অনুবাদ করা যায় না, তো সে রকম বিদেশি কোনো সাহিত্য যদি আপনি অনুবাদ করতে চান সেক্ষেত্রে কী করবেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : কমলকুমার মজুমদার মোটেও অনুবাদবান্ধব নন। তবে কেউ ইংরেজিতে চেষ্টা করেছেনে কি না আমার জানা নইে। তবে ইংরেজি ভাষা যেমন শক্তিশালী তাতে ইংরেজিতে মাতৃভাষাতুল্য দখল কারো থাকলে তিনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। জীবনানন্দ দাশের লেখাও কিন্তু অনুবাদ করা কঠিন। হয়তো রূপসী বাংলার কবিতাগুলো সহজ, যেমন ‘বেড়াল’ কবিতাটা, কিন্তু বেশিরভাগ কবিতাই কঠিন। যেমন বলছিলাম, কিছু কিছু লেখা থাকে Translation friendly, কিন্তু যেসব লেখা একেবারেই অনুবাদবান্ধব নয় সেগুলোকে দু’ভাবে অনুবাদ করা যায়-- হয় যেভাবে আছে সেভাবেই আনবেন যেটা লক্ষ্য ভাষায় বোধগম্য নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে টিকা-টিপ্পনি প্রচুর ব্যবহার করে স্পষ্টতা তৈরি করতে হয়। তবে পাঠকের রিসার্চে আগ্রহ না থাকলে পাঠক এগুলো নেবেন না। আরেকটা উপায় হচ্ছে মূল Text -এর ছায়া অবলম্বনে অনুবাদ করা, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যাতে সে অনুবাদ মূলের সঙ্গে পুরোপুরি প্রতারণা না করে। Translator -কে একই সঙ্গে কিন্তু Traitorও বলা হয়। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় সর্বোচ্চ মাত্রায় faithful ও beautiful দুটোই থাকার চেষ্টা করা উচতি।
আমাদের এখানে অনুবাদের বিষয়টি কিন্তু বেশ পুরনো। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ডন কিহোতে-এর মতো উপন্যাসও অনূদিত হয়েছে। তারও আগে পদ্মাবতীর অনুবাদ হয়েছে, রামায়ন মহাভারত তো অনূদিত হয়েছিলই; দেখা যাচ্ছে অনুবাদের দীর্ঘ একটা ঐতিহ্য আমাদের আছে। বাংলা ভাষায় আপনার আদর্শের অনুবাদক কারা?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : অনুবাদ যে আমি খুব বেশি পড়েছি তা নয়। ছোটবেলায় আমাদের বাসায় একটা লাইব্রেরি ছিল। দস্তয়ভস্কির লাঞ্ছিত যারা উপন্যাসটা পড়েছিলাম। সেটা পড়ে আমি মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর পার্ল বাকের মাদার হরিরঞ্জন দাশগুপ্তর করা অনুবাদ, তারা কেউ পেশাদার অনুবাদক ছিলেন না, আমার মতোই পড়ে হয়তো ভালো লেগেছে তাই অনুবাদ করেছেন। পার্ল বাক-এর গুড আর্থ পড়েছিলাম সেসময়। কার অনুবাদ মনে নইে। হতে পারে পুষ্পময়ী বসুর। তারপর সে সময় টলস্টয়ের কিছু অনুবাদ পড়ি যেমন-- Death of Ivan Ilych। এগুলো পড়ে হয়তো অজ্ঞাতেই অনুবাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তবে অনুবাদক হিসেবে আমার কোনো রোল মডেল নেই।
আপনি মিখাইল শলোখভের প্রথম জীবনের গল্প অনুবাদ করেছেন। এর পেছনে কি কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গ্রামে পালিয়ে বেড়াবার দিনগুলোতে শলোখভের Early Stories বইটি কি ভাবে যেন আমার কাছে ছিল। সে সময় দু একটা গল্প অনুবাদ করার পর মনে হল পুরোটাই তো করা যায়; তাই করে ফেললাম, শলোখভ যে আমার খুব প্রিয় লেখক তেমনটিও নয়, কিন্তু তার লেখা অনুবাদবান্ধব যদিও তাঁর প্রধান লেখাগুলো আমি অনুবাদ করিনি; সেগুলো বেশ বড়। প্রথম জীবনের লেখা গল্পগুলো বেশ ভালো লেগেছিল। ওগুলো বলশেভিক বিপ্লবের পরপর লেখা, আমাদের এখানেও তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, দুটো সময়ের যেন কিছু মিল পেলাম, সেটাও অনুবাদের কারণ হিসেবে হয়তো কাজ করেছে।
জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্রাভেলস-এর কোন বিষয়টি আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল যে এতো পুরনো একটা বই অনুবাদে হাত দিলেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : তিক্ত, ক্ষুরধার স্যাটায়ার। তিনি সমাজকে, সমাজে বসবাসকারী মানুষকে যেভাবে দেখেছেন আমাদের সমাজের সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের সেই সমাজের প্রচুর মিল। ফ্যান্টাসির রূপকে মোড়া এই স্যাটায়ার। এ ধরনের কাজ আমাদের এখানে বেশি বেশি হওয়া প্রয়োজন। মনে পড়ে গালিভারস ট্রাভেলস আমি ২-৩ বছর ধরে অনুবাদ করেছিলাম সেই ৭০’এর মাঝামাঝি।
কয়কে বছর আগে আপনার অনুবাদে Golden Bough বইটি প্রকাশিত হয়েছে। এটি একটি বিশাল কাজ। এই বই অনুবাদে আগ্রহী হলেন কিভাবে?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : আমার মনে হলো সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের মাইলফলক এই ইংরেজি বইটির বাংলায় অনুবাদ হওয়া উচিত। মূল বই ১২ ভল্যুমের; ফ্রেজারই এটাকে সংক্ষিপ্ত করে ৮৫০-৯০০ পৃষ্ঠার মধ্যে এনে এক খণ্ডে ছেপেছেন। প্রথমে তিনি দু ভল্যুমে ছাপেন ১৮৯২ সালে। পরে আরও ১০ ভল্যুম যোগ করে দ্বাদশ খণ্ডের এই বই প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। এটা লিখে ফ্রেজার সাহেব নাইট উপাধিও পান। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও আচার আয়োজনে মিল দেখাতে গিয়ে তিনি একই ধরনের রিচুয়ালের উদাহরণ এনেছেন বারবার। আমার মনে হয় তিনি আসলে জাতিতে জাতিতে পার্থক্য না দেখিয়ে বরং কত মিল তাই দেখতে চেয়েছেন বেশি। অদ্ভুত সব প্রেজুডিস, বিশ্বাস, কল্পনা থেকে মানুষ যে কত বিচিত্র রকমের আচরণ করতে পারে তা সত্যি দেখার মত। এটা পড়লে বোঝা যায় কী বিচিত্র বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জাদু বিশ্বাস, ধর্ম ও বিজ্ঞান সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয় কেউ যদি খোলা মনে এই বইটি পড়ে, ধর্ম বিশ্বাসে সে হয়তো কট্টর পন্থা থেকে সরে এসে হবে অনেক উদারপন্থি। এটা শুরু করেছিলাম বহু বছর আগে, সম্ভবত ১৯৯৫ সালে, ছাপা হলো ২০১৬ তে। তবে নিয়মিত করতে পারলে দু তিন বছরেই শেষ করা যেত।
বাংলা ভাষায় জেমস জয়েসের বড় উপন্যাসগুলোর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ হয়নি...
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : শুনেছি ইউলিসিস করছিলেন একজন, প্রয়াত জাকারিয়া সিরাজী, কিন্তু শেষ করেছিলেন কি না জানি না। বর্তমানে আরেকজন স্বনামধন্য অনুবাদক, আবদুস সেলিম, ইউলিসিস অনুবাদ করছেন। জেমস জয়েস খুব কঠিন, প্রায় Untranslatable। জানি না কটি ভাষায় Ulysses বা Finnegans Wake অনূদিত হয়েছে।
শেক্সপিয়র তবু পড়া যায়, তার কিছু সার্থক অনুবাদ আছে। উৎপল দত্তের একটা অনুবাদ A Midsummer Night’s Dream (চৈতি রাতের স্বপ্ন) বেশ চমৎকার হয়েছে। সুধাংশুরঞ্জন ঘোষের করা শেক্সপিয়র সমগ্র বেরিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগেই। বাংলায় শেক্সপিয়র বহুকাল ধরেই অনূদিত হচ্ছে। গিরীশ ঘোষের অনুবাদও আছে, সম্ভবত ম্যাকবেথ। রবীন্দ্রনাথও ম্যাকবেথ ধরেছিলেন। শেক্সপিয়রের সনেটগুলো হয়েছে-- জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী করেছেন। তবে খুব সার্থকভাবে সনেট অনুবাদ হয়েছে সেলিম সারওয়ারের হাতে। তিনি এত বিশ্বস্ত থেকে ছন্দ ঠিক রেখে কাজটা করেছেন- প্রায় অবিশ্বাস্য।
রবীন্দ্রনাথের অনেক পরিচয়ের একটা এই যে, তিনি অনুবাদও করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : রবীন্দ্রনাথ আসলে বেশি Creative বলে তিনি Original Text-এর প্রতি শতভাগ বিশ্বস্ত থাকতে পারেননি কখনো। তার কাজ মূলত কিছুটা ছায়া অবলম্বন টাইপের। তবে টি এস এলিয়টের ‘জার্নি অব দ্য ম্যাজাই’-এর অনুবাদ “শিশুতীর্থ” কবিতাটি কিন্তু খুবই মূলানুগ। শেলীর ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’-এর সঙ্গে ‘বর্ষশেষ’ কবিতার অনেক মিল রয়েছে। এছাড়া ইংরেজিতেও তিনি অনেক অনুবাদ করেছেন— Hundred Poems of Kabir এবং নিজের গীতাঞ্জলি যা হোক, রবীন্দ্রনাথ নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন যে অনুবাদ করে নিজের কবিতার তিনি বরং ক্ষতিই করেছেন। হাল্লাম টেনিসনের একটি প্রবন্ধে পড়লাম যে তিনি বলছেন, রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ও খ্যাতি যে ইউরোপে ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল সে জন্য রবীন্দ্রনাথের নিজের করা অনুবাদই দায়ী। টেনিসন গীতাঞ্জলি থেকে কবিতা নিয়ে পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছেন যে অনুবাদটা এরকম না হয়ে কী রকম হলে আরও শক্তিশালী ও মূলের অনুসারী হতো। সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আসলে সফল অনুবাদক নন। লেখক কর্তৃক অনূদিত হওয়ায় তা আরও মূলানুগ ভেবে ইউরোপের অজস্র পাঠক রবীন্দ্রনাথের ভুল মূল্যায়ন করেছেন। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্র অনুবাদ আত্মঘাতী হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তা জানতেন।
সস্ত্রীক অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিরায়ত সাহিত্য যা আপনি এখনও অনুবাদ করেননি, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আছে?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : দোন কিহোতে করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শুনেছি কলকাতা থেকে এর একটি অনুবাদ বেশ কবছর আগে বেরিয়েছে। সেজন্য উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। এক সময় মনে করতাম অনুবাদের অনুবাদ করলে মূল টেক্সট থেকে অনেকটাই সরে যেতে হয়। তা সত্ত্বেও আকুতাগাওয়ার রাসোমন, মার্কেসের পেয়ারার সুবাস, কাজানজাকিসের জোরবা দ্য গ্রিক, রিপোর্ট টু গ্রেকো, রুশোর স্বীকারোক্তি করেছি ইংরেজি থেকে কারণ আমার পক্ষে জাপানি, স্প্যানিশ, গ্রিক, এবং ফরাসি ভাষা শিখে ওই সব সেরা লেখকদের অনুবাদ করা সম্ভব নয়। তবে আমার বিশ্বাস ইংরেজি অনুবাদ যদি বিশ্বস্ত হয়ে থাকে তাহলে সেখান থেকে করা একটি বিশ্বস্ত বাংলা অনুবাদ মূল বই থেকে খুব বেশি সরে যায় না।
ইংরেজিতে যদি অন্য ভাষা থেকে মূলানুগ অনুবাদ হয়, সে ক্ষেত্রে ইংরেজি থেকে অনুবাদের ব্যাপারে কী মত আপনার?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : এই যে বললাম, হ্যাঁ সে ক্ষেত্রে করা যায়-- যেমন কাজানজাকিসের লেখা। তিনি তো গ্রিক ভাষায় লিখতেন। তার লেখা কিমোন ফ্রায়ার ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন বহু বছর তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে। তার অডিসির মর্ডান সিক্যুয়েল, বিশাল একটা কাজ। অসাধারণ অনুবাদ এবং মূলানুগ কারণ তিনি একটু একটু করে অনুবাদ করতেন আর তা নিয়ে কবির সঙ্গে আলোচনা করতেন। এভাবে চার বছর ধরে তিনি কাজটি করেন। এ ধরনের মূলানুগ কাজ থেকে তৃতীয় একটি ভাষায় অনুবাদ করা যায় বৈ কি।
সামনে আপনার কী পরিকল্পনা?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : কাজানজাকিসের অডিসি করছি ইংরেজি থেকে। দেখা যাক কী দাঁড়ায়।
আমাদের এখানকার অনুবাদ নিয়ে কিছু বলুন।
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : ইদানীং তো অনুবাদ হচ্ছে প্রচুর, অনেকেই বেশ সাবলীল ভাষায় অনুবাদ করছেন। জানি না তাদের অনুবাদ কতটা মূলানুগ কারণ অনূদিত বই সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে মূল টেক্সটের সঙ্গে কিছুটা হলেও তুলনা করে বলতে হয়। ইদানীং তো বাইরের যে কোনো জনপ্রিয় লেখা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এখানে অনুবাদ হচ্ছে-- সেটা ভালো বিষয়। কিন্তু গুণগত মানের ব্যাপারে আপসহীন থাকতে হবে। ঝরঝরে অনুবাদের নামে সহজকরণের পক্ষে আমি নই। মূলের গুরুত্ব ও ওজন বজায় রাখতে হবে। পাঠকের বোধগম্যতার অজুহাতে হাল্কা করে দেয়া যাবে না।
অনুবাদের কাজ দীর্ঘদিন ধরে হলেও এর মর্যাদা সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা সবকিছুতেই কিছুটা নেতিবাচক, তাই অনুবাদককে হেয় করার প্রবণতা আমাদের একটু বেশি যে, এরা তো পরের ধনে পোদ্দারি করে। কিংবা এদের কাজ তো মৌলিক কিছু নয়। এই ধারণা ঘুঁচে যাবে বলে আমি মনে করি। শিল্প হিসেবে, সৃজনশীল কাজ হিসেবে অনুবাদ মর্যাদা পাবে এবং হয়তো একটি স্বতন্ত্র জনরা হিসেবেও, যেখানে অন্য সব জনরার স্রোত এসে মেলে এমন এক সাগর-জনরা, আমব্রেলা জনরা হিসেবেও পরিচিত হতে পারে। অনুবাদের তত্ত্ব, যেমন একটি তত্ত্ব পলিসিস্টেমস থিওরি, যেখানে অনুবাদের সব থিওরির স্থান হয়, অনুবাদের জন্য গ্রন্থ বাছাই থেকে শুরু করে অনুবাদকের মনস্তত্ত্ব, প্রকাশনা, সম্পাদনা, রিভিউ ইত্যাদিও এই থিওরির আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত, সেরকম পলিসিস্টেমস জনরা হিসেবে অনুবাদ শিল্প কথাসাহিত্য, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধর মতো একটি স্বতন্ত্র জনরার মর্যাদা পেতে পারে যেখানে সব আঙ্গিকই আরেকটি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে স্থান পায়।
সপরিবারে অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
একটা ব্যাপার কি লক্ষ্য করেছেন? বেশিরভাগ বেসরকারি পুরস্কারের ক্ষেত্রে কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধে পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও অনুবাদে নাই...
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : না, আছে। বাংলা অনুবাদ ফাউন্ডশেন সম্ভবত ২০২০ সাল থেকে বছর তিনেক নিয়মিত অনুবাদে একজন বিশিষ্ট অনুবাদককে আজীবন সম্মাননা এবং বর্ষ সেরা অনুবাদ গ্রন্থ পুরস্কার দিয়েছে। রাজনৈতিক কারণে দু বছর বাদ গেছে। এ ছাড়া কোনো কোনো কাগজ বর্ষ সেরা বইয়ের পুরস্কারে অনুবাদকেও রেখেছে। যৌথভাবে সম্ভবত গবেষণা ও প্রবন্ধ ক্যাটাগরিতে। আসলে সারা বিশ্বেই অনুবাদ এতোদিন কিছুটা বিমাতাসুলভ আচরণ পেয়ে এসেছে। একটা একাডেমিক বিষয় হিসেবে অনুবাদের যাত্রা বেশি দিনের নয়—গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে। এ সময়ের আগে অনুবাদের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তেমন মর্যাদা ছিল না। অনুবাদ দু’হাজার বছর আগেও হয়েছে-- হোরেস, সিসেরো, সেনেকা তাদেরও অনুবাদের ব্যাপারে মন্তব্য পাওয়া যায়-- অনুবাদ কেমন হবে, না হবে, পরবর্তী সময় সেন্ট জেরোমির যে বাইবেল যেটাকে Vulgate বাইবেল বলে-- ওটা তো বহু বছর, কয়েকশ’ বছর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের শাসন করেছে। বাইবেলের অনুবাদ একটা বিশাল ব্যাপার। এর ইতিহাসও প্রাচীন। আর জেনে অবাক হবেন যে বাইবেলই একমাত্র গ্রন্থ যার বিভিন্ন অংশ চার হাজারেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা প্রায় ছ’ হাজার । ১৬১১-তে যে Authentic বাইবেল তৈরি করা হলো রাজা জেমসের সময়ে, অনেকে বলেন ওটাতে শেক্সপিয়র, বেকন, এবং university witsদরে কেউ কেউ নিয়োজিত হয়েছিলেন। রাজা জেমস বিভিন্ন স্কলার নিয়োগ করেছিলেন। এই Authentic বাইবেলের অনুবাদ তো আজ পর্যন্ত অপূর্ব, অসাধারণ। এবং আজও সেই অনূদিত বাইবেল খ্রিস্টানদের মনোজগত শাসন করছে।
আচেবেকে নিয়ে আপনি থিসিস করেছেন এবং যে-লেখকের সর্বাধিক রচনা আপনি অনুবাদ করেছেন তিনি আচেবে। আচেবের প্রতি আপনার পক্ষপাতের কারণ কী?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : চিনুয়া আচেবে একজন বিশ্বমানের লেখক এবং আধুনিক আফ্রিকার সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর সেরা উপন্যাস Arrow of God অনুবাদ করে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। এ ছাড়া আর যে-দুটি বই অনুবাদ করেছি, A Man of the People এবং ছোটগল্প সংকলন Girls at War, তারা নিশ্চয়ই গুণেমানে তাঁর প্রথম উপন্যাস Things Fall Apart এবং Arrow of God-এর সমপর্যায়ের নয়। আচেবের কিছু কবিতা অনুবাদ করে তাঁর গল্প সংকলন মেয়েদের যুদ্ধ-এর ভূমিকায় জুড়ে দিয়েছি। আচেবে আমার পিএইচ ডি গবেষণার অন্যতম বিষয় ছিলেন বলে যে তাঁর প্রতি পক্ষপাতিত্ব—ব্যাপারটা তেমন নয়। আসলে কোনো কোনো লেখকের শৈলী এমন যে তা অনুবাদবান্ধব। আচেবেকে আমার সে ধরনের একজন বলে মনে হয়।
ইউরোপীয় লেখকদের কলাকৈবল্যবাদকে আচেবে ডিওডোরাইজড ডগশিট (Art for art’s sake is just another piece of deodorized dog shit) বলে অভিহিত করেছেন? এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : আচেবে আগাগোড়া একজন উপনিবেশিকতা-বিরোধী, কলাকৈবল্যবাদ-বিরোধী এবং লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতার সপক্ষের একজন লেখক। এ ধরনের লেখক যে আর্ট ফর আর্টস সেক জাতীয় মতবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া কোনো কাজই অর্থবহ নয়। লেখককে শারীরিকভাবে বেঁচে থাকতে হলে যেহেতু সমাজের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেজন্য বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের প্রতি তাঁর একটা দায় তো থাকেই। এজন্য যে-শিল্পকর্ম মানুষকে অগ্রাহ্য করে কিংবা ভেতরের কদর্য রূপ ঢাকতে কেবল লেফাফা দুরস্ত হয়ে থাকে, তাকেই আচেবে বলছেন ডিওডোরাইজড ডগশিট, অনেকটা স্বর্ণপাত্রে পুরীষ পরিবেষণ।
আচেবের ইংরেজি আর ইংরেজ কিংবা মার্কিন লেখকদের ইংরেজির মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য লক্ষ্য করেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে আচেবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। তাঁর মতে ইংরেজি দিয়েই তিনি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লিখতে চান যেমন কি না শেক্সপীয়রের নাটকে ক্যালিবান ঔপনিবেশিক ভাষাতে দখলদার শ্বেতাঙ্গ প্রসপেরোকে অভিশাপ দিচ্ছে। তবে আচেবে বলছেন যে তিনি ইংরেজিতেই লিখবেন, কিন্তু ইংরেজের মতো করে নয়। তিনি নিজস্ব ইংরেজিতে লিখেছেন। Morning Yet on Creation Day প্রবন্ধ সংকলনের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে যেমন, “Africa and Her Writers,” “The African Writer and the English Language,” “Colonialist Criticism,” “Thoughts on the African Novel” ইত্যাদিতে তিনি তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। শিল্পচর্চায় তাঁর মূলমন্ত্রই হলো “Art is, and was always, in the service of man.”
তাঁর জননেতা উপন্যাস অনুবাদ করার সময় আপনি আমাদের দেশের শাসকদের শোষণ ও সম্পদ লোপাট ইত্যাদি পরিস্থিতির সাথে মিল লক্ষ্য করেই অনুবাদে উৎসাহী হয়েছিলেন কি?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : একেবারে। জননেতা বা A Man of the Peopleএ আমাদের তো বটেই, তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দেশের সঙ্গে নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রচুর মিল আছে বলে এই উপন্যাস অনুবাদ করেছি।
আমাদের দেশের রাজনীতি ও জনগণের মনোজগতে ধর্মের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে গোল্ডেন বাউ-এর মতো গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : ধর্মের প্রভাব না বলে আমি বলি ধর্মের ভড়ং বাড়ছে। ধর্মীয় ব্যাপারে এতো বেশি ভণ্ডামি আর কোনো দেশে হয় কি না জানি না। গোল্ডেন বাউ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিচিত্র সব লোকবিশ্বাস, কৃত্য, ধর্মাচার ইত্যাদি নিয়ে লেখা সাংস্কৃতিক নৃবিদ্যার এক মাইলফলক গ্রন্থ। আমার বিশ্বাস এই বই খোলা মনে পড়লে পাঠকের মনে এক ধরনের উদারনৈতিক বিস্ময় সৃষ্টি হতে পারে। তখন ধর্মীয় গোঁড়ামি, কিংবা “আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ”—এমন বিশ্বাস থেকে পাঠক মুক্ত হয়ে সভ্যতার আদিকাল থেকে প্রচলিত মানুষের নানা ধরনের কৃত্যাচারের প্রতি একটি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি অর্জন করতে পারে। এ ধরনের দৃষ্টি লালন করলে যে কেউ ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে অবস্থান করে একজন স্বাভাবিক মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
চিরায়ত বা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর অনুবাদ সমাজ ও সংস্কৃতিতে কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : ধ্রুপদী বা চিরায়ত গ্রন্থ সাধারণত জীবন সম্পর্কে এমন ধারণার সৃষ্টি করে যা উদারনৈতিক, যাতে থাকে অপার বিস্ময় এবং যা পাঠে মানুষ মননে কল্পনায় একজন সমৃদ্ধতর, উন্নততর ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। এই সব বই সেরা মননের সৃষ্টি। পাঠক যদি এইসব সেরা মানুষের উন্নত চিন্তাভাবনার জগতে প্রবেশ করে তাঁদের সৃষ্টি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে তাহলে সে যে একজন উন্নত মনের মানুষে পরিণত হবে তা এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। এখন, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা যদি সমাজে বাড়ে তাহলে তো আশা করাই যায় যে সমষ্টি-অস্তিত্ব একটি উন্নত পর্যায়ে উপনীত হবে এবং মানুষ উন্নততর বৌদ্ধিক জীবন যাপন করবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও মানুষের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত করার ক্ষেত্রে অনুবাদের কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : অনুবাদ ছাড়া আমাদের বৌদ্ধিক জীবন অচল। আমরা সব সময় সব কিছু নিজের মতো করে অনুবাদ করেই বুঝতে পারি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শুরু থেকেই অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করা উচিত ছিলো। একজন মানুষ খুব ভালোমতো একটা কি দুটো ভাষার চার দক্ষতা—শোনা, বলা, পড়া, লেখা-- আয়ত্ত করতে পারে। আর আমরাও তো বহু ভাষাভাষী জাতি নই। আমাদের দেশে শুরু থেকেই মাতৃভাষায় পাঠদান চালু করা উচিত ছিল। এটি করতে গেলে প্রয়োজন হতো সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তক বাংলায় অনুবাদ করা। সেটা হয়নি, এবং আমাদের কোনো ভাষানীতিও নেই বলে আজ পড়াশোনার এই দৈন্য দশা। অথচ বলশেভিক বিপ্লবের পর কিংবা চীনের বিপ্লবের পর ওদের সরকার ভাষা ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলো।
আপনি মূলত সাহিত্যবিষয়ক বই-ই অনুবাদ করেছেন বেশি। কিন্তু গত বছর আপনি রুশোর স্বীকারোক্তি নামক বিশাল আয়তনের বইটি অনুবাদ করেছেন। রুশোতে আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : কল্পনাপ্রসূত লেখা যেমন কথাসাহিত্য যেখানে মানুষের চলাফেরা থাকে, প্রেম থাকে, প্রকৃতির চমৎকার বর্ণনা থাকে এসব অনুবাদ করতে আমার ভালো লাগে। অবশ্য এর বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই অনুবাদ করেছি যেমন মিথের শক্তি, গোল্ডেন বাউ, পেয়ারার সুবাস, গালিভারের ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি। রুশোর আত্মজীবনীতে, কাজানজাকিসের আত্মজীবনীতে প্রচুর সাহিত্যিক উপকরণ রয়েছে। রুশো আমাদের এখানে মূলত তাঁর সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের জন্য পরিচিত হলেও, তাঁর দু তিনটে রোমান্টিক উপন্যাসও আছে। বস্তুত অষ্টাদশ শতকে ইংরেজি সাহিত্যে যখন নব্য ক্লাসিক্যাল যুগ সে সময় ফ্রান্সে রুশো রোমান্টিক উপন্যাস লিখছেন। এজন্য রুশোকে ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের অগ্রদূত বলা চলে। রুশো অনুবাদে আগ্রহী হই কারণ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয় আমি যেন দন কিহোতে এবং/ অথবা রুশোর কনফেসান্স অনুবাদ করি। আমার ইচ্ছা ছিলো সের্ভান্তেস করা; কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানি যে ওইটা কলকাতা থেকে অনেক দিন আগেই বেরিয়েছে। এজন্য উৎসাহ হারিয়ে রুশোতে মন দিই। জানতাম সম্পূর্ণ রুশো কেউ বাংলায় অনুবাদ করে নি। এবং যেহেতু তা ধ্রুপদী সাহিত্য পদবাচ্য, সেজন্য বছর চারেক সময় নিয়ে করে ফেললাম।
আজকাল তো গুগল, চ্যাটজিপিটি, এআই, এমনকি কণ্ঠস্বর শুনে শুনেও লক্ষ্য ভাষায় অনুবাদের জন্য নানা রকম অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে অনুবাদের মানকে কি প্রত্যাশিত মাত্রায় উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : কণ্ঠমুদ্রণে আমার বরং সায়ই আছে, কিন্তু এ আই কিংবা চ্যাট জিপিটির মাধ্যমে লেখা কিংবা লেখা সম্পাদনা করা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা চ্যাটজিপিটি জাতীয় আবিস্কার মানুষের সৃজনশীল ভাবনাচিন্তা কেড়ে নিয়ে তাঁকে একজন অসৎ মানুষে পরিণত করছে। এসব আবিষ্কারের ফলে মানুষের সৃষ্টিশীলতার অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে বলেই আমার ধারণা। একটা কিছু অনুবাদ করে সেটা যদি সম্পাদনার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে তা বহুলাংশেই পরিবর্তিত হবে। অবশ্য বড় প্রকাশকরা প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করিয়ে নেয় এবং খুব বেশি পরিবর্তনের প্রয়োজন না হলে সম্পাদক যেভাবে বলেন, লেখক তা মেনে নেন। এভাবে চিন্তা করলে হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে লেখক নিজেই নিজের লেখা সম্পাদনা করতে পারেন। এ ব্যাপারটি পুরোপুরি নির্ভর করে লেখকের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান জ্ঞান, সততা ইত্যাদির ওপর। কিন্তু পুরো একটা উপন্যাস বা কবিতা বা গল্প, প্রবন্ধ, নাটক বা গবেষণার কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে লিখিয়ে প্রকাশ করা রীতিমতো দণ্ডনীয় অপরাধ। আমার আশঙ্কা এআই লেখক কবি সাহিত্যিকদের সৃজনশীলতা কেবল ধ্বংসই করবে না, ভুয়া লেখকের সংখ্যাও বৃদ্ধি করবে। বিজ্ঞান ও শিল্পকলার জগতে সৃষ্টি হবে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা।
মাঝেমধ্যেই আপনি উপন্যাস বা গল্পের ভিতরে থাকা গ্রাম্যগীত বা লোককবিতাগুলোকে অনুপ্রাস বজায় রেখে, চমৎকার ছন্দ ও মাত্রা বজায় রেখে অনুবাদ করেন। তার মধ্যে গ্রাম্য বুলিও যুক্ত হয় যাতে করে মূলের আবহটা পাঠক অনুভব করতে পারে। এসব অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা ব্যবহার করেন। কেন করেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : কবিতা আমার সমিল ছন্দে পড়তেই ভালো লাগে। এজন্য মূলের সঙ্গে বেশি আপোস না করতে হলে আমি অমিল ছড়া বা পদ্য বা কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে তাতে সমিল ছন্দ জুড়ে দিই। রুশো, ফ্রেজার, কাজানজাকিস, ক্যাম্পবেল এঁদের বইয়ের অনেক কবিতাই আমি মিল রেখে করেছি।
আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার তখনই করি যখন দেখি তাতে চরিত্রের সামাজিক অবস্থান কিছুটা হলেও ফুটে ওঠে। রাস্তার ছোকরাদের কিংবা শ্রেণিচরিত্র বিচারে যাদের আমরা বলি নিম্নবিত্তের মানুষ, তাঁদের মুখের বুলিতে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করলে মনে হয় যেন চরিত্রটা পোশাকি হয়ে যাচ্ছে। তাঁকে তাঁর সামাজিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করতেই তাঁর বুলিতে নন স্ট্যান্ডার্ড ভাষা ব্যবহার করি। তবে এই কাজটিও যে সব সময় এক নিয়মে করি তেমনটি নয়। পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী এদের কথায় হেরফের ঘটে। একজন মানুষ তা সে যে প্রেক্ষিত থেকেই আসুক, সে কি সব সময় টানা একইরকম ভাষায় কথা বলে? রাগে দুঃখে শোকে আনন্দে তাঁর মুখের বুলি, তাঁর প্রকাশভঙ্গি পাল্টায় বটে।
শিকাগোর ডাউন টাউনের রাস্তার কালো ছেলেদের মুখে—খিস্তি খেউর যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী, তো তাঁদের মুখে ভদ্রলোকের প্রমিত বাংলা কেমন শোনাবে? নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনুবাদককে কাজ করতে হয়। চরিত্রের সামাজিক প্রেক্ষিত অনুযায়ী তাঁর মুখের ভাষাকে একটু অন্যরকম করার চেষ্টায় অপ্রমিত ভাষা (কোনো বিশেষ অঞ্চলের নয়) ব্যবহার সেই সীমাবদ্ধতা কিছুটা কাটাবার প্রয়াস আরকি।
ইংরেজ নন এমন লেখক যারা ইংরেজিতে লিখছেন, তাঁদের উপন্যাসের যে পটভূমি সেটা ইংরেজ ভূখণ্ডের বাইরে, এবং তাঁদের ভাষাও নয় ইংরেজি; এসত্ত্বেও তাঁদের কথাসাহিত্যের চরিত্রগুলোর মুখে যখন ইংরেজি জুড়ে দেওয়া হয় তখন তাদের অস্বাভাবিক মনে হয় না কেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : আমিও মাঝে মাঝে অবাক হই এই ভেবে যে আচেবে, সোয়েঙ্কা, সালমান রুশদী এরকম যারা ইরেজিতে লিখে নিজেদের দেশের ভিন্ন ভাষাভাষী চরিত্রের মুখে ইংরেজি সংলাপ জুড়ে দিচ্ছেন, তাদের ওই সব চরিত্রের কথা অস্বাভাবিক শোনায় না কেন? অথচ বাংলা উপন্যাসে খোদ বাঙালি চরিত্রের মুখেও কখনো কখনো তাদরে সংলাপ আড়ষ্ট, অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম শোনায়। আচেবে, রুশদী এই অবস্থার উত্তরণ ঘটান হয়তো প্রচুর স্থানীয় ভাষার শব্দ ব্যবহার করে কাহিনির বাতাবরণকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। আচেবে তো তাঁর ব্যবহৃত ইগবো শব্দের কোন গ্লসারিও দেন না। তাঁর যুক্তি হলো পাঠক ঘটনা প্রবাহের অনুঙ্গে একাধিকবার ব্যবহৃত ওই সব শব্দের অর্থ অচিরেই বুঝতে পারবেন। স্থানীয় চরিত্রের মুখে ইংরেজি যে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না তাঁর আরো একটি কারণ হতে পারে এই যে পাঠক মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই পড়তে বসেন যে তিনি ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস পড়ছেন এবং সেজন্য চরিত্রগুলো ইংরেজিতে কথা বলবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এজন্য গ্রামের চরিত্রগুলোর মুখে ইংরেজি বুলি দিলেও পাঠক ভুলেই যান যে সেটা আসলে অনুবাদ করে দেওয়া হচ্ছে। চরিত্রের আঞ্চলিকতা বৈশিষ্ট্য ইংরেজিতেও যদি ফুটে ওঠে তো পাঠকের কাছে তা স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে। এজন্যই মনে হয় এইসব ইংরেজি না জানা চরিত্রের মুখে ইংরেজি বুলি আর আঞ্চলিক ভাষার ভেদ ঘুঁচে তারা ভাষার বাধা অতিক্রম করে সর্বজনীন চরিত্রে রূপান্তরিত হয়। এভাবে চরিত্র নির্মাণ করতে গেলে বলাই বাহুল্য ঔপন্যাসিককে খুবই মেধাবী হতে হয়।
জোসেফ কনরাড সম্পর্কে উপনিবেশ-বিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে আচেবের যে আপত্তি তা সাহিত্যিক মানদণ্ডে কতোটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : আচেবের সব উপন্যাসই নাইজেরিয়ায় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব নিয়ে লেখা। প্রথম তিনটে উপন্যাসেই পাই ইংরেজ শাসকদের আগমন এবং তার ফলে সনাতন ইগবো সমাজে সৃষ্ট অস্থিরতার কাহিনি। আর পরের দুটিতে স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপোড়েন, নব্য দেশী শাসকদের দুর্নীতি, লুটপাট, আর অপশাসনের চিত্র। এজন্য একজন দায়িত্বশীল লেখক হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই আচেবে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী। এখন যে-লেখায় বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ যৌক্তিক মনে করে চমৎকার শৈল্পিক অনুসঙ্গে পরিবেশন করা হচ্ছে, তা কি আপনি নেবেন? এটা অনেকটা কি সেই স্বর্ণপাত্রে পুরীষ কিংবা সোনার পেয়ালায় গরল পরিবেশনের মতো হয়ে গেল না? সে ক্ষেত্রে আপনি কি পাত্র সমেত পুরীষ ছুঁড়ে ফেলবেন না? আসলে একটা শিল্পকর্ম গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এক যোগে প্রসঙ্গ ও প্রকরণ নিয়ে। একটা থেকে অন্যটা আলাদা করে নয়। যেমন কাজানজাকিস বলেছেন, মানুষ যেমন দেহ ও আত্মা একত্র হয়েই জন্মে একে অন্য থেকে পৃথক হয়ে নয়, প্রসঙ্গ ও প্রকরণের সম্পর্কও সেরকমই। তবে আমি বলি প্রসঙ্গই নির্ধারণ করে প্রকরণ। এজন্য আচেবের কনরাড বিরোধিতা, বিশেষ করে হার্ট অফ ডার্কনেস নিয়ে, আমি শতভাগ যৌক্তিক বলে মনে করি।
এবার একটা দলছুট প্রশ্ন করি। সেটা হলো, কোনো লেখককে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বিচার করবো—রাজনৈতিক, নাকি সাহিত্যিক? যেমন ধরুন, কিপলিং ছিলেন বোরহেসের খুব প্রিয় লেখকদের একজন, এবং সেটা একেবারেই সাহিত্যিক কারণে। কিন্তু কিপলিংকে রবীন্দ্রনাথ অপছন্দ করেছেন প্রধানত তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এ ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা এর আগের প্রশ্নোত্তরেই দেওয়া হয়েছে। তবু বলি সাহিত্যিককে রাজনৈতিক থেকে পৃথক না করাই উচিত কারণ আমার বক্তব্য যদি রাজনীতি হয় এবং তা যদি আমি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে শিল্পানুসঙ্গে প্রকাশ করতে পারি তাতেই একটা উন্নত শিল্প জন্ম নেয় যেখানে রাজনীতি আর শিল্পে কোনও বিরোধ বা স্বাতন্ত্র্য নেই। কিপলিং ভারতে ইংরেজ শাসনের যৌক্তিকতা বেশ নগ্নভাবেই প্রকাশ করেছেন বলে রবীন্দ্রনাথ তা পছন্দ করেননি। রবীন্দ্রনাথের মতো আধ্যাত্মবাদপুষ্ট কবিও কিন্ত ঊনবিংশ শতকের কলাকৈবল্যবাদী ফরাসি লেখক থিওফিল গতিয়েরের উপন্যাস মাদমাজেল দ্য মোপা পড়ে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন কারণ তাতে ঠাসা কেবলই নারীদেহের সৌন্দর্য আর যৌনতার বিবরণ। বিষয়বস্তু, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকাশভঙ্গি, উদ্দেশ্য এসব নিয়েই তৈরি হয় একটি শিল্পকর্ম। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজপ্রীতি ছিল যথেষ্ট, কিন্তু তা বলে তিনি ভারতে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ পছন্দ করতেন এমন নজীর নেই। সেজন্য বলবো কিপলিংকে অপছন্দ করাটা তাঁর জন্য স্বাভাবিকই বটে।
আপনি একবার কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন যে অনুবাদ করতে গিয়ে আপনি skopos theory অনুসরণ করেন। অন্যদিকে আরেক ধরণের অনুবাদ আছে যা অনুসরণ করে archaism বা Foreignization theory। বাংলা ভাষায় কি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদকে এ ধরণের (Foreignization theory) অনুবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? এই skopos theory এবং Foreignization theory সম্পর্কে কিছু বলুন; এবং আপনার পক্ষপাতিত্ব কেন স্কোপোস থিওরির প্রতি সেটাও জানতে চাই।
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : স্কোপোস থিওরিতে অনুবাদের উদ্দেশ্যকে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে ধরা হয়। স্কোপোস একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ উদ্দেশ্য। আপনি যে অনুবাদ করছেন তার উদ্দেশ্য কী? নিশ্চয় টারগেট পাঠকের কাছে পৌঁছানো। সেজন্য অনুবাদ এমনভাবে করতে হবে যেন যাদের জন্য করছেন তারা পড়ে বুঝতে পারে। এজন্য লক্ষ্য ভাষায় যতটা সম্ভব পাঠকের বোধগম্য করে অনুবাদ করতে হবে। এ ধরণের অনুবাদ মানে কিন্তু এমন নয় যে উৎস টেক্সট থেকে দূরে সরে যেতে হবে। এই তত্ত্বেরই চরম আকারকে বলতে পারেন ডোমেস্টিকেসন বা একেবারে আত্মীকরণ। একে অবশ্য আমি অনুবাদ না বলে রূপান্তর বা ভাবানুবাদ জাতীয় কিছু বলবো। এরকমই আরেকটি মজার তত্ত্ব আছে যাকে বলে ব্রাজিলিয়ান ক্যানিবালিজম। অষ্টাদশ শতকে ব্রাজিলে এক পর্তুগিজ মিশনারী সাহেবকে কিছু মানুষখেকো আদিবাসী মেরে জ্বাল দিয়ে খেয়ে ফেলেছিলো। তারা তো সাদা মানুষের শক্তিমত্তা দেখেছে; ওদের ধারণা হলো একজন সাদা মানুষকে যদি আস্ত মেরে খেয়ে ফেলা যায় তাহলে তার শক্তিমত্তার অনেকটাই তারা নিজেদের শরীরে নিয়ে আসতে পারবে। আদিম মানুষের এমন ভাবনাচিন্তার কথা ফ্রেজার সাহেব কিন্তু গোল্ডেন বাউ বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। এ থেকে গত শতকের দ্বিতীয় দশকে Anthropophagic বা ক্যানিবাল মেনিফেস্টো লেখেন ব্রাজিলের কবি অসওয়াল্ড দ্য আন্ড্রেড। অনুবাদ সংক্রান্ত এঁদের বক্তব্য ছিলো সূত্র-টেক্সটকে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করেই লক্ষ্য-টেক্সট শক্তিশালী হতে পারে। অন্যদিকে আরকাইজম বা ফরেনাইজেসন তত্ত্বে বলে মূল টেক্সটকে এমনভাবে অনুবাদ করতে হবে যেন সেটা পড়ে পাঠক সব সময়ই মনে করেন যে তিনি একটি অনুবাদই পড়ছেন। এই পদ্ধতিতে হোমার অনুবাদ করেছিলেন ভিক্টরিয়ান যুগের কবি উইলিয়াম মরিস। তিনি হোমারের যুগকে অবিকল সেভাবেই উপস্থাপন করতে গিয়ে লক্ষ্য-পাঠকের কাছে অনুবাদকে অপাঠ্য করে তুলেছিলেন। তবে বিশিষ্ট অনুবাদক প্রয়াত মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদ করতে গিয়ে আরকাইজম তত্ত্ব অনুসরণ করতেন বলে আমার মনে হয় না। তিনি সম্ভবত সরাসরি স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করতেন না। তার বাক্যবন্ধে মাঝে মাঝে ইংরেজি বাক্যগঠন রীতি প্রকাশ পেলেও তা অগ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের এখানে অনেকেই অন্ধের মত অনুবাদ করেন; কেন করেন, কী ভাবে করেন, তাঁদের ভাষিক দর্শন—ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের কিছুমাত্র ভাবনা চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আপনি কী বলেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : এখানে প্রচুর অনুবাদ হচ্ছে। তবে ইংরেজি থেকেই বেশি হচ্ছে। আমরা যেহেতু বহু ভাষাভাষী জাতি নই, সেজন্য ইংরেজির ওপরই নির্ভরশীলতা বেশি। অনেকে সরাসরি স্প্যানিশ, রাশান, উর্দু, ফারসি থেকেও করছেন, তবে তাঁদের সংখ্যা নেহায়েতই কম। একজন মানুষের পক্ষে একাধিক ভাষা সমান দক্ষতায় আয়ত্ত করা একরকম অসম্ভব। সেজন্য লক্ষ্য ভাষায় একেবারে মাতৃভাষাতুল্য দখল রাখতেই হবে। আর সূত্র ভাষায় সামন্য ঘাটতি থাকলেও তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আকার ইঙ্গিত ব্যাঞ্জনা অবশ্যই বুঝতে হবে, অর্থাৎ পঠন দক্ষতায় ঘাটতি থাকা চলবে না। যে কোনো ভাষা শিখতে যে চারটি দক্ষতা প্রয়োজন—শোনা, বলা, পড়া, লেখা—এদের শেষ দুটিতে, উৎস ভাষায় পড়া, আর লক্ষ্য ভাষায় লেখায়, অনুবাদকের সর্বোচ্চ দক্ষতা থাকতে হয়।
সাহিত্য বিষয়ক অনুবাদ যেমন আপনি অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেন, প্রবন্ধও কি আপনি সেরকম স্বেচ্ছায় লেখেন নাকি বেশিরভাগ সময় অনুরুদ্ধ হয়ে লেখেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : সাহিত্য বিষয়ক বলতে যদি ফিকশন বোঝান তো হ্যাঁ, কল্পনাজাত গদ্য সাহিত্য যেমন গল্প উপন্যাস অনুবাদ করতে ভালো লাগে। কিন্তু আমার তো জোরবা, কালোছেলে, দেবতার ধনুর্বাণ, জননেতা, রাসোমন, মেয়েদের যুদ্ধ ছাড়া অন্য অনুবাদ্গুলো বলতে পারেন মোটামুটি ননফিকশনাল প্রোজ। তবে সংলাপে লেখা মিথের শক্তি, পেয়ারার সুবাস ইত্যাদিও অনুবাদ করতে ভালো লেগেছে। আর নিজের লেখা প্রবন্ধর কথা জিজ্ঞেস করলে বলি আমার ভূমিকাগুলোই তো এক একটা প্রবন্ধ। এছাড়া গালিভারের ভ্রমণকাহিনী একটি রূপক গ্রন্থ। একেবারে নির্ভেজাল প্রবন্ধ অর্থাৎ চিন্তাশীল বা গবেষণাধর্মী লেখা বলতে যা বোঝায় সেরকম অনুবাদ আমার কম কিংবা নেই বললেই চলে। অনুরুদ্ধ হয়ে সংস্কৃতি পত্রিকায় বহুকাল আগে একটা দুটো অনুবাদ করে থাকতে পারি, কিন্তু এই সংস্কৃতি পত্রিকাতেই আমার নিজের কয়েকটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। গোল্ডেন বাউ কিংবা রুশোর স্বীকারোক্তি কিংবা কাজানজাকিসের আত্মজীবনীতে প্রচুর ফিকশনাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রবন্ধ সাহিত্যের মান সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : বাংলা সাহিত্যের চার প্রধান আঙ্গিকের ভেতর প্রবন্ধ সাহিত্যকে সবচেয়ে দুর্বল বলে মনে হয়। একটা উন্নত মানের প্রবন্ধ লিখতে যথেষ্ট মননশীলতা, গবেষণাধর্মী মনোবৃত্তি ইত্যাদি দরকার। তবে জাতি হিসেবে আমরা খুব মননশীল সেকথা হয়তো জোর গলায় বলা যাবে না। যদিও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র জ্ঞানবিজ্ঞানের ১৬টি বিষয়ে গত ২০০ বছরে বাঙালির চিন্তাভাবনা নিয়ে ২০৮ খণ্ডের এক বিশাল প্রকাশনা কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে প্রায় আশিভাগ কাজ শেষও করেছেন। তবু বলবো বাঙালিদের, বিশেষ করে বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙালিদের মননশীলতার ইতিহাস মোটামুটি দরিদ্রই। আসলে প্রবন্ধ লিখতে যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয়, চিন্তাভাবনায় যে যুক্তিতর্ক গবেষণার পরিচয় দিতে হয় তা আমাদের দুএক পুরুষের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এখানকার প্রথম জেনারেশনের চিন্তা গবেষণায় যারা নিয়োজিত হয়েছিলেন—কাজী আব্দুল ওদুদ, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, এস ওয়াজেদ আলি, সুফি মোতাহের হোসেন, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের হাতে প্রবন্ধ সাহিত্যের সূচনা হয়। অথচ ইংরেজি কিংবা ফরাসি সাহিত্যে প্রবন্ধের সূচনা হয় ষোড়শ শতকে। ইংরেজরা এদেশ দখলের আগে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান চার প্রধান আঙ্গিকের কোনোটারই অস্তিত্ব ছিলো না। উপরন্তু মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অনীহা দেখালে তারা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে। এছাড়া ১৯৭১ সালে স্বাধীন হবার পর গত চুয়ান্ন বছরে আর্থিক ও ভৌত কাঠামোয় কিছুটা উন্নতি হলেও অযোগ্য, অদূরদর্শী ও অনৈতিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের ফলে সাংস্কৃতিক, নৈতিক, ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে আমরা একটি দরিদ্র ও অপাংক্তেয় জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছি। একটা অসুস্থ রাজনীতি স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের মাথার ওপর চেপে বসে আছে। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ একটা সনেটে লিখেছেন The world is too much with us. সেরকম আমার বলতে ইচ্ছে হয়, Politics is too much with us. মননশীল এবং গবেষণাধর্মী রচনার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা কোনো কিছুই অনুকূল নয়।
আপনি তো বিভিন্ন সময় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। উপরন্তু অনুবাদ বইগুলোর ভূমিকা তো আছেই যেগুলো আয়তনে যেমন দীর্ঘ, তেমনি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ও রচনার প্রসাদগুণে সুপাঠ্য। আপনি এখন পর্যন্ত প্রবন্ধের বই করলেন না কেন?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : প্রবন্ধের বই একটা দুটো তো বের করাই যায়। সেভাবে কখনো তাগিদ বোধ করিনি। এই তাগিদটা খুব জরুরি, যে কোনো কাজেই। এবং এটা ভেতর থেকে আসতে হয়। গত পঞ্চাশ বছরে কোথায় কি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সে সব জোগাড় করে কিছুটা সম্পাদনা করে একটা প্রবন্ধ সংকলন হয়তো বের করবো।
দেশে বিদেশে আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক, প্রিয় কবি, প্রিয় প্রাবন্ধিক, এবং সাহিত্যতাত্ত্বিক কারা?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : আমার পছন্দ বলুন কি প্রবণতা, ঝোঁক যাই বলুন তা ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি। ইউরোপ, যুক্তরাস্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকার প্রতিষ্ঠিত যাঁদের লেখা পড়েছি সবাই কম বেশি আমার প্রিয়। তবে আমার একাডেমিক কার্যক্রমের বাইরে বিশেষ কোনো প্রাবন্ধিক এবং সাহিত্যতাত্ত্বিক আমাকে সেভাবে আগ্রহী করেননি, বিশেষ করে উত্তরাধুনিক সাহিত্যতাত্ত্বিকদের সহজ করে না বলার কিংবা বলতে না পারার প্রবণতা, কিংবা চিন্তার জটাজালে জড়িয়ে বক্তব্যকে দুর্বোধ্যতর করে তোলার প্রবল উৎসাহ আমার পছন্দের নয়।
বাংলাভাষায় কারা আপনার প্রিয় অনুবাদক?
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস : বিশেষভাবে প্রিয় অনুবাদক হয়তো নেই, তবে অনুবাদের একনিষ্ঠ কর্মীদের আমি শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। আপনি নিজেও নিরলসভাবে ল্যাটিন অ্যামেরিকান সাহিত্যের নানা দিক উন্মোচন করছেন এবং খ্যাতি স্বীকৃতির পরোয়া না করে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন, এমনটিই আমার পছন্দের। এখানে বাংলা ট্রানস্লেশন ফাউন্ডেশন কয়েক বছর থেকে পাঞ্জেরী প্রকাশনার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। এই সংগঠনটি বিদেশি ভাষা থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে বিদেশি ভাষায় অনূদিত বর্ষসেরা বই এবং সেই সঙ্গে একজন অনুবাদককে আজীবন সম্মাননা দেবার সঙ্গে বার্ষিক একটি অনুবাদ পত্রিকা যুক্তস্বর প্রকাশ করে থাকে। এ ছাড়া বাংলা একাডেমিও অনুবাদ পত্রিকা নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করছে। দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে এইসব কার্যক্রম ব্যাহত হলেও অনুবাদের কাজ থেমে নেই। কিছু তরুণ প্রকাশক যেমন নটিলাস, উজান খুব গুরুত্ব দিয়ে অনুবাদের বই ছাপছেন। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকজন কবি ও লেখকের এবং বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার একজন ঔপন্যাসিকের পাচার হওয়া উপন্যাস প্রকাশ করে উজান প্রকাশনী আমাদের সামনে নতুন এক জগত উন্মোচন করেছেন। এভাবে কিছু কিছু ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান অনুবাদশিল্পকে বেশ কার্যকরভাবে উৎসাহিত করছেন। এজন্য বলি অনুবাদ শিল্প নিয়ে যারা কাজ করেন সবাই আমার খুব কাছের মানুষ, soul mate। তাঁদের সঙ্গে নিকট আত্মীয়তা অনুভব করি।
আর্টস-এ প্রকাশিত খালিকুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে লেখা:
অনুবাদের সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত খালিকুজ্জামান ইলিয়াস