Published : 14 May 2025, 12:40 PM
আমাকে জাপানের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলতঃ তিনটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্ততঃ সাতজন অধ্যাপকের সরাসরি সংস্পর্শে দীর্ঘ চারটি বছর কাটাতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমার শিক্ষকদের মূল্যায়ন নিম্নরূপ।
জাপানে শিক্ষক এবং ডাক্তারকে সেন্সেয় বলে সম্বোধন করা হয়। যতোদূর বুঝতে পেরেছি মানুষ ও জাতিগঠনে নিয়োজিত বলে সমাজে শিক্ষকের কদর খুব উচ্চে। একইভাবে মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখে বলে ডাক্তারের কদরও খুব বেশি। তাই এঁদের অতি শ্রদ্ধার সাথে সেন্সেয় বলে সম্বোধন করা হয়, শিক্ষককে আমরা সচরাচর অশ্রদ্ধা মাখা ‘মাস্টার’ বলে যেমন ডেকে থাকি সেই অর্থে মোটেই নয়। বাংলায় সেন্সেয়’র কাছাকাছি শব্দ গুরু বা ওস্তাদ।
প্রাচীন ও মুসলমান শাসিত ভারতবর্ষে ছাত্ররা দিনরাত ঋষি, গুরু বা ওস্তাদের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে থেকে বিদ্যালাভ করতো। ফলে ছাত্রের মেধাবিকাশই শুধু নয়, তাঁর দর্শন, জীবনাচার, চিন্তা-চেতনা এবং ব্যক্তিত্বেও সেই গুরু বা ওস্তাদের জীবনেরই প্রতিফলন ঘটতো। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রের কথা বিশেষ জানা নেই কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিক জাপানে সেন্সেয় অনেকটা সেই দায়িত্বই পালন করে থাকেন। শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু শিক্ষাদানের মাঝেই শেষ হয় না, ছাত্রের জন্য উপযুক্ত চাকুরি ও বিয়ের দায়িত্বও সেন্সেয় নিজ কাঁধে তুলে নেন।
প্রতিটি গবেষণাগার বা লেবোরেটরি, সংক্ষেপে ল্যাব এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি সাধারণতঃ পূর্ণ অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপকের সমপর্যায়ের হয়ে থাকেন। অধ্যাপকের অধীনে এক বা একাধিক সহযোগী এবং/অথবা সহকারী অধ্যাপক এবং/অথবা জোসু (আমাদের প্রভাষক সমপর্যায়ের ব্যক্তি) স্ব স্ব গবেষণা ও শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত থাকেন। এখানে ল্যাব মানে কক্ষ বোঝানো হচ্ছে না, ল্যাব মানে সেই প্রধান অধ্যাপকের অধীনে এক থেকে দশ বারোটি কক্ষ বিশিষ্ট গবেষণাগারের কথা বলা হচ্ছে। প্রতিটি কক্ষেরই পৃথক পৃথক নাম বা নম্বর থাকে। দায়িত্বরত অধ্যাপক এই ল্যাবের জমিদার, সম্রাট বা একাধিপতি। এক অর্থে তাঁর নির্দেশ বা ইচ্ছায় ল্যাবের প্রতিটি প্রাণি, আসবাব ও যন্ত্র প্রতিনিয়ত ওঠাবসা করে কোনো প্রতিবাদ বা দ্বিমত ছাড়াই।
গবেষণা অনুযায়ী ল্যাবের বিশেষ একটি নাম থাকলেও সেটি অধিক পরিচিত হতো অধ্যাপকের নামে। আমি পিএইচডি ডিগ্রির গবেষণা করেছি ‘বিসেইবুতসু কাগাকু’ বা ‘মাইক্রোবায়াল বায়োকেমিস্ট্রি’ বা ‘অণুজীব রসায়ন’ নামে পরিচিত বিশেষায়িত একটি ল্যাবে। কিন্তু সেটি ‘সোদা-ল্যাব’ নামেও সমধিক পরিচিত ছিল কারণ অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা ছিলেন এই ল্যাবের প্রধান প্রাণপুরুষ।
কোনো ল্যাব পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর একজন অধ্যাপকের ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা পছন্দ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় এক বা একাধিক সহকারী/সহযোগী অধ্যাপক এবং জোসু’র নিয়োগ দিয়ে থাকে। ল্যাবের অধঃস্তন এই শিক্ষকরা অধ্যাপকের পছন্দের গবেষণার বিশেষ বিশেষ দিক পরিচালনা করতেন। শুধু তাই নয়, অধ্যাপকের নির্দেশ ও ইচ্ছানুযায়ী ল্যাবের যন্ত্র ও আসবাবপত্র পছন্দ, কেনাকাটা, ছাত্র নির্বাচন, এবং প্রাত্যহিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অধ্যাপকের কাজ হচ্ছে দেশের এবং বিশ্বের আর কোথায় একই ধরনের গবেষণা হচ্ছে তার খোঁজখবর ও যোগাযোগ রাখা, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার, ও বেসরকারী দাতা সংস্থা থেকে গবেষণা সংক্রান্ত অর্থের ব্যবস্থা করা, এবং প্রয়োজনে শিক্ষক হিসেবে ক্লাশে বক্তৃতা দেয়া। অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা’র অধীনে পিএইচডি করার সময় আমাদের ল্যাবে ছাত্র ও গবেষকের সংখ্যা ছিল প্রায় কুড়ি জন। আমরা ছাত্ররা ভাগ হয়ে এক সহযোগী অধ্যাপক ও দুই জোসুর যে কোনো একজনের তত্বাবধানে প্রাত্যহিক গবেষণা করে যেতাম। তিনি প্রতি সপ্তাহ বা মাসে একবার তাঁর উর্ধতন অধ্যাপককে প্রতিটি ছাত্রের শিক্ষা, গবেষণা, আর্থিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা বা অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করতেন। প্রয়োজনে ছাত্রদের আলাদা করে ডেকে নিয়ে অধ্যাপক নিজে সমস্যা সমাধানে ব্রতী হতেন। মোট কথা, প্রতিদিন দেখা না হলেও একজন অধ্যাপক তাঁর প্রতিটি ছাত্রের নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ রাখতেন এবং নৈতিকভাবে ছাত্রের জীবনের জন্য দায়ী থাকতেন। যদিও আমি একজন জোসু’র সরাসরি তত্ত্বাধানে কর্মরত ছিলাম, বিদেশি ছাত্র হওয়ায় এবং অধ্যাপক সোদা’র ব্যক্তিগত ইচ্ছায় নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর কাছে আমার যাতায়ত ছিল অবারিত।
অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন ভ্রমণ সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত থাকতেন। হয়তো ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার কোনো বিজ্ঞান সম্মেলনে অথবা জাপানেরই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তা সত্ত্বেও ল্যাবে তাঁর অনুপস্থিতি কখনো অনুভব করিনি। ল্যাবে থাকাকালীন প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো দেশি বা বিদেশি অতিথি আপ্যায়ন করতেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কোনো ছাত্রকে ডেকে নিয়ে সেই অতিথিকে তাঁর বিশেষ গবেষণার বিষয়টি অবহিত করাতেন। তা শুনে এবং প্রীত হয়ে সেই অতিথি এই ল্যাবে অর্থের বরাদ্দ দিতেন অথবা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে নেজের লোক পাঠাতেন। বিদেশি অতিথি থাকলে আমার ডাকই পড়তো বেশি।
তাঁর ল্যাবে বিদেশ অথবা অন্য শহর থেকে নতুন ছাত্র এলে কে কোথায় কীভাবে থাকবে, অধ্যাপক সোদা নিজে তার তদারকি করতেন। কিয়োতোর এক আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে আমার দুই বছর থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আমি চার কামরার একটি ‘ম্যানসন’ ভাড়া নিতে যাচ্ছিলাম। ছাত্রাবাসের ভাড়া ছিল মাসে তিন হাজার ইয়েন। কিন্তু ম্যানসনের মাসিক ভাড়া আশি হাজার ইয়েন শুনে তিনি বললেন এ বড় অন্যায়, তা ছাড়া এতো বড় বাড়িতে আমার একা থাকাটা সমীচিন নয়। বললেন বাড়িটিতে তাঁর নবাগত ফরাসী ছাত্র প্যাট্রিক শোকা(ট)-এর সাথে যেন থাকি, তাহলে ভাড়াটি অর্ধেকে নেমে আসবে! সেই সময়ে শিক্ষা সমাপনে তাঁর আরেক ছাত্র চলে যাবার সময় জোসুর মাধ্যমে তাকে নির্দেশ দিলেন ওর রেফ্রিজারেটর এবং সোফাসেট যেন আমাকে দিয়ে দেয়।
কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুকুই ল্যাবে ইউনেস্কোর ফেলোশিপ করার সময় ল্যাবের দলের সাথে স্কি করতে গিয়েছিলাম। অসুস্থতা হেতু অধ্যাপক ফুকুই নিজে যেতে না পারায় দলনেতাকে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে আমি শুকরের মাংস খাই না, এবং মদ্যপানে অভ্যস্ত নই। রওনা হয়ে যাবার পর তিনি উপলব্ধি করলেন যে স্কি-রিসর্টে শুকরের ছাড়া অন্য মাংস সরবরাহ করা হয় না। পরদিনই মিসেস ফুকুই কুরিয়ারের মাধ্যমে আমার জন্য টিনজাত গরুর মাংস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
গবেষণা শেষে ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই কে কোন চাকুরিতে যাবে তা ঠিক করে রাখেন অধ্যাপকরা। একবার তকুশিমা বা তাকামাৎসু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক-শিক্ষকের লোভনীয় একটি পদ খালি হলো। দু বছর মাস্টার্স শেষ করে আমার সাথে দুই বছর পিএইচডিতে ঈর্ষণীয় সফল এক গবেষক ছাত্রকে অধ্যাপক সোদা তড়িঘড়ি করে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। পিএইচডি শেষ করতে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন ছাত্রের পাঁচ থেকে সাত বছর লেগে যেতো!
কোনো ছাত্রের বিয়ের প্রয়োজনে কনে নির্বাচন থেকে পাত্রের অভিভাবকত্বও অধ্যাপক-সেন্সেয়ই পালন করে থাকেন। পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হবার আড়াই বছরের মাথায় আমার অধ্যাপক সোদা সেন্সেয় আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, গবেষণায় তোমার অগ্রগতিতে আমি সন্তুষ্ট। এবার ডিগ্রি নেবার জন্য তুমি প্রস্তুত হও। আমি বললাম, কিন্তু সেন্সেয়, বাড়ি থেকে প্রচণ্ড চাপ থাকলেও গবেষণায় ব্যস্ত থাকার অজুহাতে এতোদিন আমি বিয়ে করি নাই। ডিগ্রিটি হাতে নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে বিয়ে করলে স্ত্রীর আর বিদেশ দেখা হবে না। এবার আমাকে যদি কিছুদিনের ছুটি দেন, তবে দেশে গিয়ে বিয়েটা সেরে স্ত্রীকে সাথে করে ফিরে আসতে পারি। তাহলে বৌটিও বিদেশ দেখার একটি সুযোগ পাবে।
তিনি বললেন তথাস্তু! দাও, কনের বায়োডাটা, ছবি দেখাও, ওর মা-বাবা, বংশের কুষ্টি দেখাও, আমি এখনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের সাথে যোগাযোগ করছি। বললাম, কাকে বিয়ে করবো সে তো ঠিক নেই। মা ও ভাইবোনেরা যাকে ঠিক করে রাখবেন, তাকেই আমি বিয়ে করবো। প্রত্যুত্তরে বললেন, ওদের বলো সম্ভাব্য কনেদের ছবিসহ বায়োডাটা পাঠিয়ে দিতে, আমি সেসব পরীক্ষা করে তোমার উপযুক্ত বৌ ঠিক করে দেবো। সময়াভাবের অজুহাত দেখিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে বিয়ে করার আগে তাঁর অনুমতি অবশ্যই নেবো। একমাসের মাঝে দেশে গিয়ে আমি করেছিলামও তাই। ঐতিহ্য রক্ষা করে তিনিও টেলিগ্রামে তাঁর সম্মতি ও অভিনন্দনের সাথে আশীর্বাদও করেছিলেন।
ল্যাবের সব সভ্য ও গবেষকদের ক্রীড়াও নির্ধারিত হয় অধ্যাপকের সখ বা পছন্দানুযায়ী। যৌবনকাল থেকেই অধ্যাপক ফুকুই ছিলেন দূরপ্লাল্লার স্কি-দৌড়বিদ। অধ্যাপনা-গবেষণা শুরুর পর তা পরিণত হয় সখে। তাঁর অধীনস্ত অধ্যাপক ও ছাত্রদেরও শিখে নিতে হয় স্কি করা, কেউ কেউ আগে থেকেই স্কি-ভক্ত থাকেন। অধ্যাপকসহ বছরে একবার ল্যাবের সবাই পূর্বনির্বাচিত কোনো স্কি-রিসোর্টে গিয়ে কাটিয়ে আসে সপ্তাহ খানেক। যৌবনে অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা ছিলেন পাথুরে-পর্বতারোহনকারী (রক-ক্লাইম্বিং)। পরবর্তীতে জাপান পর্বতারোহী দলের প্রধান হিসেবে হিমালয় অভিযানেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রতিবছর গ্রীষ্মে একদিনের জন্য হলেও সোদা-ল্যাবের সবাই একত্রে অনুচ্চ কোনো পর্বত চুড়ায় উঠে পিকনিক সেরে ফিরতে হতো। বেশ আনন্দদায়ক স্মৃতি হয়ে আছে আমার সেইসব পর্বতারোহনের অভিজ্ঞতা।
এভাবে চল্লিশ বছর আগের আধুনিক জাপানেও প্রাচীন ভারতের গুরু বা মুসলিম শাসিত ভারতের ওস্তাদের গুরু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন সেন্সেয় হিসেবে।