Published : 15 Jun 2025, 03:12 PM
সত্যজিৎ রায়—এই নামটির সাথে পরিচিত না এমন সাহিত্য ও সিনেমাপ্রেমী বাঙালি কি খুঁজে পাওয়া যাবে? আমাদের সবার প্রিয় ফেলুদার রচয়িতা তিনি। অপু ও দুর্গাকে বড় পর্দায় তো তিনিই তুলে ধরেছেন। আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন প্রফেসর শঙ্কুর মত বিজ্ঞানী। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে দেখিয়েছেন স্বৈরাচারী শাসকের পরিণতি। কালজয়ী সব সিনেমা বানিয়েছেন। লিখেছেন চমৎকার সব গল্প। এঁকেছেন দারুণ সব ছবি। করেছেন বিভিন্ন বইয়ের অসাধারণ সব প্রচ্ছদ। তিনি ছবি আঁকতেন কাগজে-কলমে। তিনি ছবি আঁকতেন ক্যামেরায়। তাঁর সিনেমায় স্থান পেত মানুষের জীবন ও খুঁটিনাটি। তিনি ছিলেন এক চমৎকার গল্পকথক যার প্রমাণ আমরা পাই তাঁর রচিত ‘একেই বলে শুটিং’ বইটিতে—কি সুন্দর করেই না তিনি সিনেমা বানানোর দিনগুলোর কথা বলে গেছেন। চলচ্চিত্র প্রাবন্ধিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য বলেন,
"তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একজন মানুষ এবং তাঁর সেই সম্পূর্ণতাকে পাওয়া যায় তাঁর ছবিগুলোতে। সব বিষয়ে তাঁর অসামান্য একটা দখল ছিল। তিনি মিউজিক জানতেন, এডিটিং জানতেন, স্ক্রিপটিং জানতেন, ডিরেকশন তো জানতেনই। ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি জানতেন। এই যে একটা ছবিকে সম্পূর্ণ নিজের মত করে করা -ছবি তৈরির সবদিকে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেলে দেওয়া- এটা বিরল।"
১৯২১ সালের ২রা মে কলকাতার বিখ্যাত রায় পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন এক স্বনামধন্য শিশুসাহিত্যিক। বাবা সুকুমার রায়ও কম যান নি। তিনি ছিলেন বাংলাসাহিত্যের সেরা ননসেন্স ঘরানার লেখক এবং শিশুসাহিত্যিক—তাঁর রচিত ‘পাগলা দাশু’ ও ‘আবোল তাবোল’-এর কোনো তুলনা নেই বললেই চলে। সত্যজিতের মা ছিলেন সুপ্রভা দেবী। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে মায়ের সান্নিধ্যেই বড় হন তিনি। সুপ্রভা দেবী সত্যজিতের জীবনে এক বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন। চলচ্চিত্র প্রাবন্ধিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য সত্যজিতের বাল্যকাল ও মায়ের অনুপ্রেরণা বিষয়ে বলেছেন,
"সেই ছেলেটি সারাক্ষণ নানা দিক থেকে সমানে তৈরি করেছেন নিজেকে। শুধু পড়াশোনায় নয়, গানবাজনা, ছবি আঁকায় নিজেকে দক্ষ করে তোলা- এরকম একটা অর্গানাইজড বয়হুড (সুশৃঙ্খল বাল্যকাল) ভাবা যায় না।"
তিনি আরোও বলেন,
"এর মধ্যে ওঁনার বড় একটা অনুপ্রেরণা ছিলেন মা সুপ্রভা দেবী। মা ছেলের এই সম্পর্কের দিকটা পরে সত্যজিৎ রায় অনেকটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর 'অপরাজিত' ছবিতে।"
সত্যজিত রায়ের পড়াশোনা অর্থনীতি ও চারুকলায়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক পাস করেন। এরপর, শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি যে শুধু সিনেমা বানিয়েছেন বা লেখালেখি করেছেন তা কিন্তু নয়; তিনি বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পীও ছিলেন। ‘সিগনেট প্রেস’-এ থাকাকালীন তিনি অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। এর মধ্যে যেসব বইয়ের নাম না বললেই নয় তা হল: জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ ও ‘রূপসী বাংলা’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’, জিম করবেটের ‘ম্যানইটার্স অব কুমায়ুন ‘ এবং জওহরলাল নেহেরুর 'ডিসকভারি অফ ইণ্ডিয়া'। এছাড়া তিনি কালজয়ী ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র শিশুতোষ সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেপু’ তেও কাজ করেছিলেন এবং সেই সময়টায় তিনি এ বইটি দ্বারা খুব প্রভাবিত হন যার প্রদর্শন আমরা দেখতে পাই তাঁর নির্মিত সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’তে যা তিনি বিভূতিভূষণের উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করেই নির্মান করেছিলেন। ‘আম আঁটির ভেপু’র প্রচ্ছদের পাশাপাশি এর ভেতরের ছবিগুলোও তিনি এঁকেছিলেন এবং পরবর্তীকালে দৃশ্য হিসেবে সেই ছবিগুলোই সিনেমাটিতে ব্যবহার করেছিলেন।
১৯৫০ দশকের শুরুর দিকে কাজের সুবাদে তিনি লন্ডন সফরে যান এবং এ সফরটি ছিল তাঁর জন্য খুবই ফলপ্রসূ। এ সম্বন্ধে কলকাতায় সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপিকা ও চলচ্চিত্র সমালোচক সুনেত্রা ঘটক বিবিসি বাংলাকে বলেন,
"তখন তিনি জাহাজে করে বিদেশ যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় ডি.জে.কিমার ও সিগনেট প্রেসের 'আম আঁটির ভেঁপু' বইটির প্রচ্ছদ ও ইলাসট্রেশনের কাজটা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। ওটা যখন করছেন, তখনই, আমার যেটা মনে হয়, ওঁনার ছবি করার একটা কথা মাথায় এসে থাকতে পারে। তখন তিনি পাতায় পাতায় ছবি আঁকছেন। ভিস্যুয়ালগুলো ভাবছেন।"
সেসময় তিনি প্রায় ৯৯ টির মত সিনেমা দেখেন এবং এর মধ্যে ইতালীয় সিনেমা ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল এবং এ সিনেমাটি দেখার পরেই তিনি একজন চলচ্চিত্রকার হবার সিদ্ধান্ত নেন। লন্ডনে যাবার পথেই তিনি 'আম আঁটির ভেঁপু'র ছবির কাজ শেষ করেন এবং জাহাজে করে দেশে ফেরার পথে 'পথের পাঁচালি'র স্ক্রিপ্ট তৈরি করে ফেলেন।
‘পথের পাঁচালী’ ই ছিল সত্যজিত নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র যা ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায়। এটি ছিল ‘অপু ত্রয়ী’র প্রথম পর্ব। ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র অপুকে কেন্দ্র করে বানানো সত্যজিতের তিনটি সিনেমাকে একসাথে ‘অপু ত্রয়ী’ বলা হয়। যার প্রথম পর্ব ‘পথের পাঁচালী’ তে আমরা অপু ও তার দিদি দুর্গার শৈশব, দ্বিতীয় পর্বে অপুর কৈশোর যা ‘অপরাজিত’ নামেই পরিচিত এবং তৃতীয় পর্বে অপুর বড়বেলা, বিয়ে, ও সংসার পর্ব দেখি যেটা ‘অপুর সংসার’ নামে পরিচিত। ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমাটি ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, এবং ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল পুরস্কার অন্যতম। এছাড়া বিবিসির সর্বকালের সেরা ১০০ বিদেশী ভাষার সিনেমার তালিকায়ও ‘পথের পাঁচালী’ নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
‘অপু ত্রয়ী’র পাশাপাশি, বিভূতিভুষণের ‘অশণি সংকেত’ উপন্যাসটিকেও চলচ্চিত্রে রূপ দেন তিনি। সিনেমাটি ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় এবং বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারে ভূষিত হয়।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের ভয়াবহতা কিভাবে বাংলা অঞ্চলে প্রভাব ফেলেছিল তা উঠে এসেছে ‘অশণি সংকেত’ উপন্যাসে। সেসময় বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যা তৎকালীন গ্রামীণ বাংলার মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছিল এক ভয়াবহ পরিবর্তন। উপন্যাসের এই বিষয়টি সত্যজিৎকে প্রভাবিত করেছিল এবং সেই কথাই তিনি বলেছিলেন ১৯৭৩ সালে বার্লিন উৎসব থেকে ফেরার সময় লন্ডনে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন,
“যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এমন একটা জায়গায় এমন কতগুলো লোকের উপর, যারা সেই যুদ্ধের থেকে বহু দূরে রয়েছে এবং তার (যুদ্ধের) কারণ কিছু বুঝতেও পারছে না, অথচ তারা (যুদ্ধের প্রভাব) দেখছে.....এই জিনিসটাই আমার কাছে বেশ আশ্চর্য লেগেছিল।”
এই সিনেমার একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা এবং সিনেমাতে তাঁকে নেওয়ার বিষয়ে সত্যজিৎ রায় বলেন যে তিনি এই চরিত্রের জন্য একজন নতুন মুখ খুঁজছিলেন এবং সেইসময় চিত্রালী নামক এক বাংলাদেশী চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকায় ববিতার ছবি দেখে তাকে ডাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন,
“তখন আমার মনে হলে হয়তো একে একবার দেখা চলতে পারে।....তারপর স্ক্রিন টেস্টে তিনি উৎরে গেলেন…………
পাটটা তাকে দিয়ে দিলাম এবং তিনি খুব ভালো অভিনয় করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।”
মানিকবাবু(সত্যজিৎ রায় কে তাঁর কাছের মানুষরা ‘মানিক’ বলে ডাকতেন) যে শুধু বিভূতিভূষণের কাহিনী অবলম্বনে সিনেমা বানিয়েছেন তা নয়, প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর চতুর্থ সিনেমা ‘জলসাঘর’। ১৯৫৮ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায় এবং সিনেমাটি তাঁকে আবারো ভুবনব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। এই সিনেমার জন্য তিনি আবারো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন।
কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্প ‘অবতরণিকা’ অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করেন ‘মহানগর’ যা ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়। ১৯৬৪ সালে ‘মহানগর’ সিনেমাটির জন্য বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি সেরা পরিচালকের খেতাব পান।
১৯৬৮ সালে ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের সৃষ্টি কালজয়ী দুটি চরিত্র গুপী ও বাঘার গল্প অবলম্বনে সত্যজিত রায় নির্মাণ করেন গুপী গাইন বাঘা বাইন। এটি তাঁর সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ‘হীরক রাজার দেশ’ সিনেমাটির জন্য তিনি খুব প্রশংসিত হন। এটা সত্যজিতের অন্যতম দর্শকপ্রিয় সিনেমাগুলোর একটি। এটা একটা রূপক সিনেমা যেখানে তিনি স্বৈরশ্বাসকের পরিণতি তুলে ধরেন। এটি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিরিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র যা ১৯৮০ সালে মুক্তি পায়। এছাড়া, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসের অবলম্বনে এই নামেই একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে বানানো এসব সিনেমা ছাড়াও তিনি নির্মাণ করেছিলেন আরো কিছু অনন্য সব সিনেমা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘চারুলতা’, ‘নায়ক’, ‘আগন্তুক’, ‘জন অরণ্য’ প্রভৃতি।
সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় মোট ৩২ টি কাহিনীচিত্র ও ৪ টি তথ্যচিত্র নির্মান করেছেন। ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গণ্য হয়েছেন। সেইসাথে অর্জন করেছেন ভুবনজোড়া খ্যাতি। ১৯৯২ সালে বিখ্যাত এই চলচ্চিত্র পরিচালক সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে একাডেমি(অস্কার) পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও তাঁর ঝুলিতে আছে অনেকগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পেয়েছেন ভারতরত্ন ও পদ্মভূষণ।
বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম ভালোবেসে এবং তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি যেমন নির্মাণ করেছিলেন অসাধারণ সব সিনেমা, তেমনি তাঁর নিজের সাহিত্যকর্মের ঝুলিও কিন্তু কম পরিপূর্ণ নয়। বাংলা সাহিত্যের দুটি জনপ্রিয় চরিত্রের রচয়িতা তিনি—ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কু। সত্যজিৎ রায়কে যারা চেনেন, তাঁরা ফেলুদাকেও চেনেন। সত্যজিৎ রায় রচিত একটি গোয়েন্দা চরিত্র হল ফেলুদা ওরফে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। ফেলুদাকে বাংলা সাহিত্যের এক তুখড় জনপ্রিয় গোয়েন্দা হিসেবে মানা হয়। বয়স তার প্রায় সাতাশ, লম্বায় সে ছ ফুট এবং সিগারেট হিসেবে তার পছন্দ চারমিনার। তার নিবাস বালিগঞ্জ, কলকাতা। যোগব্যায়াম, সিনেমা, ও গানে তার আগ্রহ। এবং সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বিভিন্ন রহস্যে। ফেলুদার সাথে সঙ্গী হিসেবে থাকে তার খুড়তুতো ভাই তোপসে। পাঠক ছাড়া এই তোপসেই ফেলুদার সবচেয়ে বড় ভক্ত। তোপসে ছাড়াও ফেলুদার আরেকজন সঙ্গী আছে। নাম লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু, পেশায় তিনি রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক। একজন রহস্য সমাধান করেন এবং আরেকজন অদ্ভুত সব রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি রচনা করেন যার প্রতিটিই খুব বিক্রি হয়—দারুণ একটা জুটি। ১৯৬৫ সালে একটি ছোট গল্পের মাধ্যমে ফেলুদা চরিত্রটির জন্ম। প্রখর বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী এই ফেলুদা এবং গায়ের জোরও কম নয়। বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ শক্তি, ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে সে বিভিন্ন রহস্যের কিনারা করেন এবং কখনো যদি কোনো মারপিটের সম্মুখীন হন তো তার মোকাবেলাও করতে জানেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ফেলুদা কাহিনি হল: ‘বাদশাহী আংটি’, ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘রয়াল বেঙ্গল রহস্য’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘গোলকধাম রহস্য’, ‘নেপোলিয়নের চিঠি’, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’, ‘লন্ডনে ফেলুদা’, ‘রবার্টসনের রুবি’ ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায় নিজের ফেলুদাকাহিনি ‘সোনার কেল্লা’ নিয়ে ১৯৭৪ সালে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। এবং ১৯৭৯ সালে আরেকটি ফেলুদা কাহিনি নিয়ে নির্মাণ করেন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’।
প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু—সত্যজিৎ রায় রচিত বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় একটি চরিত্র। তিনি একজন বিজ্ঞানী। নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কারের নেশা তার। বিহারের গিরিডি শহরে তার নিবাস। সঙ্গী হিসেবে তার আছে একটি পোষা বিড়াল। বিড়ালটির নাম নিউটন। বয়স ২৪। এছাড়াও রয়েছে তার চাকর প্রহ্লাদ। তিনি একজন পদার্থবিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তার রয়েছে অবাধ যাতায়াত। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার অনেক জ্ঞান। তিনি পারেন না বা করেন নি এমন কাজ খুব কমই আছে। প্রফেসর শঙ্কু ঊনসত্তরটি ভাষা জানেন, হায়ারোগ্লিফিক পড়তে পারেন। তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন, এমনকি ভ্রমণ করেছেন মঙ্গলগ্রহেও। আবার তিনিই প্রথম হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লিপির পাঠ উদ্ধার করেন। প্রফেসর শঙ্কু আত্নভোলা একজন মানুষ। তিনি নিজের দেশকে ভালোবাসেন। বিজ্ঞানী হলেও ভূত-প্রেত, তন্ত্র-মন্ত্রে তার বিশ্বাস রয়েছে। প্রফেসর শঙ্কুকে আমরা প্রথমবার দেখি ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পটিতে। গল্পটি ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তাকে নিয়ে আরোও গল্প প্রকাশিত হয়। এবং এটি একটি সিরিজ হিসেবে খ্যাতি পায়। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে শঙ্কু সিরিজের মোট ৮ টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শঙ্কু চরিত্রটি সৃষ্টির জন্য সত্যজিৎ রায়ের অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ‘হেসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি’ গল্পটি।
শঙ্কু সিরিজের উল্লেখযোগ্য কিছু গল্প হল: প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক, প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল, প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত, প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়, প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য, প্রোফেসর শঙ্কু ও বাগদাদের বাক্স ইত্যাদি।
ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কুর গল্পকাহিনি ছাড়াও তিনি বিভিন্ন ছোটগল্প রচনা করেছেন। নিজের ছেলেবেলা নিয়ে লিখেছেন ‘যখন ছোটো ছিলাম’। চলচ্চিত্র নিয়ে লিখেছেন আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস, বিষয় চলচ্চিত্র, এবং ‘একেই বলে শুটিং’ নামক প্রবন্ধ সংকলন। এবং তাঁর রচনাসমূহ পাঠককে মুগ্ধ করেছে। তাঁর গল্প বলার ভঙ্গিও চমৎকার। এখনও মানিকবাবুর রচনাগুলো মানুষ বারবার পড়েন। চলচ্চিত্র নিয়ে যে এত চমৎকার কিছু লেখা যায় তা আমরা তাঁর প্রবন্ধগুলো পড়ে জানতে পারি।
তিনি সুন্দর লিখতেন। তাঁর সিনেমাশৈলীও ছিল অনন্য। তিনি ছিলেন একাধারে একজন গুণী নির্মাতা। কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ছবি আঁকিয়ে। তিনি সাহিত্যের কদর করতেন। ভালো বাসতেন অন্যান্য শিল্পকেও। তাঁর সিনেমায় স্থান পেয়েছে মানুষের সংবেদনশীলতা। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গীত আবহে ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার অপু ও দুর্গার সেই অসামান্য দৃশ্য এখনও মানুষকে মুগ্ধ করে। রিডিংব্লকে পড়লে পাঠক এখনও হাতে তুলে নেয় ফেলুদা ও শঙ্কু কাহিনি। তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি যিনি তার জাদুতে সুসজ্জিত করেছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল এই মহারথী মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র:
https://www.bbc.com/bengali/news-50146966
https://www.bbc.com/bengali/articles/cv2dremepn3o
"এক নজরে প্রোফেসর শঙ্কু", সত্যজিৎ রায়: তথ্যপঞ্জি, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সৃষ্টি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ৯৫-৯৭
"প্রোফেসর শঙ্কু-ফাইল", সত্যজিৎ রায়: তথ্যপঞ্জি, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সৃষ্টি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ৯১-৯৪
শঙ্কু সিরিজের বিভিন্ন বই
ফেলুদা সিরিজের বিভিন্ন বই