Published : 07 Jun 2025, 12:43 AM
ঈদের কথা বলতে গেলেই ছোটবেলার ঈদ-স্মৃতির কথা বলেই অভ্যস্ত আমরা যেখানে অবশ্যম্ভাবী রূপে স্থান পায় ঐ বয়সকালে এক নিষ্পাপ এবং নির্মল আনন্দে পালিত উৎসবটি উপভোগ করার স্মৃতি। অবশ্য আমার নিজেরও এই উৎসব উৎযাপন-স্মৃতি কোনো ভিন্নতর কিছু নয়।
যেমন ছোটবেলায় যে দুটো ঈদ পালন করেছি, অর্থাৎ এক মাস রোজার পর ঈদুল ফিতর এবং তার আনুমানিক দু’মাস পর ঈদুল আযহা বা আদহা, এবং রোজার ঈদে নতুন জামা পরার অত্যাসক্তি এবং ঈদুল আযহা বা আমাদের প্রচলিত ভাষাতে যাকে বলতাম বকরি ঈদ, সেই ঈদে গরু বা খাসি কেনার উত্তেজনা ইত্যাদি। কিন্তু ধর্মীয় উৎসবের ঐতিহাসিকতা এবং এর পেছনের দর্শন নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই নি—অবশ্য ঐ বয়সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার কথাও নয়। আমরা সবাই জানি বয়সটা আসলে উপভোগ করারই, সময়টা তো আনন্দেরই।
অনেক পরে জেনেছি আরবি ‘ঈদ’ শব্দের বুৎপত্তি কি প্রকারে হয়েছে। সহজ রূপে বলতে গেলে ‘ঈদ’ অর্থ ‘উৎসব’, ‘আনন্দ’ ‘তৃপ্তিদায়ক ভোজ’ অথবা ‘অবকাশ দিন যাপন’। তারও পরে, আরব দেশে থাকাকালীন জেনেছি, আসলে আরবি ভাষা এতটাই পুরাতন এবং সমৃদ্ধ—আমরা তো সবাই জানি আরবি সেমেটিও ভাষার অন্তর্গত সবচাইতে বৃহৎ ভাষা এবং হিব্রু ভাষার-ই আধুনিক রূপ—ফলে, প্রসঙ্গ বা কনটেক্সট এবং প্রয়োগাকারে একই শব্দের অর্থের অনেক তারতম্য ঘটে। এমনটা অবশ্য সব ভাষাতেই ঘটে, কিন্তু আরবি ভাষা বা এমন প্রাচীন সমৃদ্ধ ভাষার ক্ষেত্রে এটি অধিক প্রযোজ্য। তো ‘ঈদ’ শব্দেরও একটি অর্থবহ দার্শনিক দিক আছে আর সেটি হলো ‘একটি আবর্তের প্রত্যাবর্তন’। অর্থাৎ ‘উৎসব আবর্তের বারবার ফিরে আসা’। এর সাথে প্রকৃতির এবং মানব জীবনের আবর্তের একটি সাযুজ্য রয়েছে বলে আমি মনে করি। উৎসবের এই ফিরেফিরে আসার আবর্ত বা চক্র মানুষের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, জীবনের উপলব্ধি, পরিবর্তনশীলতা, এবং সর্বোপরি বেঁচে থাকার অবলম্বনকে সমৃদ্ধ করে।
পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই যেখানে উৎসবের স্থান নেই—তা সে সনাতন ধর্মই হোক কিম্বা একেশ্বরবাদী ইব্রাহিমীয় ধর্ম-ই হোক। সনাতন ধর্মে রয়েছে উপবাসের কথা। তেমনি সকল ইব্রাহিমীয় ধর্মে ফাস্টিং এবং রোজার বাধ্যবাধকতা আছে। অবশ্য এই উপবাস, ফাস্টিং বা রোজার ভেতর প্রক্রিয়াগত এবং আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণগত তারতম্যও অনেক আছে। যেমন আমরা ইসলামধর্মে বিশ্বাসীরা রমজান মাসব্যাপী আঠাশ, উনতিরিশ বা তিরিশ দিন সিয়াম পালন করি চন্দ্রমাসের হিসাবক্রমে (মজার ব্যপার হলো চন্দ্রমাসের হিসাবটি সকল ধর্মই মেনে চলে)। এবং তারপর আসে ঈদ, যাকে আমরা বাঙালি মুসলমানরা বলি রোজার ঈদ। তবে মানতেই হবে সকল ধর্মের এই উপবাস, ফাস্টিং বা সিয়ামের ভেতর নিজ নিজ ধর্ম-দর্শন আছে। সনাতন কিম্বা ইসলাম ব্যতীত অন্য দুটি ইব্রাহিমীয় ধর্মে এত দীর্ঘ সময় ধরে উপবাস বা ফাস্টিং করার কোনো প্রচলন দেখা যায় না।
আমরা জানি আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে লেখা হোমার-এর কাব্যগ্রন্থ ‘ইলিয়াড”-এ বর্ণিত আছে মিসেনার রাজা বীর যোদ্ধা অ্যাগামেমনন যখন ট্রয়ে হেলেনকে উদ্ধারের জন্য জাহাজে রওনা দিচ্ছিলো তখন তার জাহাজ সমুদ্রে চলছিলো না বাতাসের অভাবে কারণ তার প্রতি গ্রিক দেবী আর্টেমিস নাখোশ হয়ে বাতাস বন্ধ করে দিয়ে ছিলো। তাকে খুশি করারা জন্য সেই দেবী দাবি করেছিলো অ্যাগামেমনন-এর কন্যা ইফিজিনিয়াকে বলি দিতে হবে। অ্যাগামেমনন কাজটি করতে বাধ্য হয়েছিলো। আমরা এও জানি, অপরাপর সনাতন ধর্মেও মানুষ এবং পশু বলির প্রথা প্রচলন ছিলো। পরবর্তীকালে ইব্রাহিমীয় ধর্মে আমরা হজরত ইব্রাহিম-পুত্র ইসমাইল-এর কথা জানতে পারি, যার বর্ণনা বাইবেল এবং কোরান শরিফে আছে। যদিও এই কোরবানি প্রথা খ্রিস্টানরা পালন করে না, আমরা মুসলমান সম্প্রদায় বিশ্বব্যাপী করি হজ পালনের একটি অন্যতম অনুশাসন হিসাবে। এর পেছনের ধর্মীয় দর্শন হলো সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাঁর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য প্রকাশ। শুধু তাই নয়, সেই সাথে নিজের ভেতরের লোভ-লালসা, স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিয়ে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ প্রার্থনা এবং সমাজের অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত মানুষের সাথে ‘উৎসব’, ‘আনন্দ’ ‘তৃপ্তিদায়ক ভোজ’ অথবা ‘অবকাশ দিন যাপন’ ভাগ করে নেয়া।
আমার স্মৃতিতে সবচাইতে প্রথম যে কোরবানির কথা মনে আছে সেটি হলো, আমার বাবার তদানীন্তন সরকারি চাকরির কর্মস্থল সান্তাহারের ঘটনা। যতদূর মনে পড়ে ঘটনাটি ১৯৫০ সালের দিকের। তখন গরু কোরবানির ঝামেলা এড়াতে ছাগল/খাসি কোরবানির প্রচলটাই বেশি ছিলো। আমার বাবা একটি কালো খাসি কিনেছিলেন সম্ভবত বারো টাকা দিয়ে। এটি জবাই করার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম কিনা আমার স্মরণে নেই, তবে এতোদিন পরে—এই আশি বছর বয়সকালে আমার একটি সরল স্বীকারোক্তি হলো—ধর্মীয় উৎসব হিসাবে আমি রোজার ঈদকেই বেশি উপভোগ করি কোরবানি ঈদের চাইতে।