Published : 16 Jan 2024, 01:15 PM
পর পর দুদিনে আমরা হারিয়েছি দুজন সৃজনশীল মানুষকে। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য দু’জনই বরণীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। দুজনই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত। একজন ষাট দশকের নন্দিত কবি, কথাশিল্পী ও বহু হৃদয়ছোঁয়া গানের সফল রচয়িতা জাহিদুল হক। অন্যজন সত্তর দশকের বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক খালেক বিন জয়েন উদ্দিন।
কবি জাহিদুল হক গতকাল (১৫-০১-২০২৪) সোমবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনন্তে পাড়ি জমান। আর তার আগের দিন (১৪-০১-২০৩৪) গত রোববার রাজধানীর নিজের বাসায় ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন খালেক বিন জয়ন উদ্দিন। মৃত্যুকালে কবি জাহিদুল হকের বয়স হয়েছিলো ৭৫ আর শিশু সাহিত্যিক খালেক বিন জয়েন উদ্দিনের ৭০ বছর।
জাহিদুল হক ১৯৪৯ সালের ১১ আগষ্ট পিতা ডা. মোহাম্মদ নুরুল হক ভূইয়া কর্মস্থল আসামের বদরপুরে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর মায়ের নাম জাহানারা খাতুন চৌধুরী। জন্ম ভিটা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। থাকতেন রাজধানীর বনশ্রীতে। চট্টগ্রামের নগেন্দ্র চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক (১৯৬৩), ফেনী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৬৬) এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
লেখালেখিটা তাঁর ছাত্র অবস্থাতেই শুরু। ১৯৬৫ সালে দৈনিক সংবাদ-এর ঈদ সংখ্যায় প্রথম কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর আনুষ্ঠানিক কাব্যযাত্রা শুরু। এবং তিনি মূলত কবিই। কিন্তু গল্প, উপন্যাস এবং গীত রচনায়ও তিনি সফল ও স্বচ্ছন্দ ছিলেন। প্রেমই যখন সৃষ্টির উৎস ও সারাৎসার তখন প্রেমেই আকন্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন তিনি। কবিতায় নির্মাণ করেন নিজস্ব এক প্রেমের পৃথিবী। পরিমিত শব্দ অলংকারে তাঁর কবিতার মধ্যে রয়েছে আলাদা এক প্রসাদ গুণ। প্রেম ও নস্টালজিয়া মানব হৃদয়ে চিরায়ত এক আবেদন তৈরি করে বলে জাহিদুল হকের কবিতা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। তিনি এই বৃত্তের বাইরে কখনো যাননি, যাওয়ার চেষ্টাও করেননি বরং সুন্দরের সাধনা এবং তার নন্দনত্বই বজায় রেখেছেন কাব্য কুশলতায়। কবিতা ও গানের মহামিলনে নিজের ভেতরের জাগতিক আকাঙ্ক্ষা ও ব্যর্থতাকে তিনি সহজেই সুরভিত করে গেছেন সংযত আবেগ ও নমিত ভাষণে। তাঁকে তাই আমরা বলতেই পারি প্রেমের বিশুদ্ধ এক কবি।
গল্প, কবিতা ও উপন্যাস মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ১৮। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘পকেট ভর্তি মেঘ’ (১৯৮১), ‘তোমার হোমার’ (১৯৮৪), ‘নীল দূতাবাস’ (১৯৮৫), ‘সেই নিশ্বাসগুচ্ছ’ (১৯৮৯), পারীগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৪), ‘এই ট্রেনটির নাম লোরকা’ (১৯৯৬), ‘এই উৎসবে আমি একা’ (১৯৯৭), ‘জাহিদুল হকের শ্রেষ্ট কবিতা’ (১৯৯৭) ও ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০১৭)। উপন্যাস: ‘তোমার না আসার বার্ষিকী’ (২০০৬), ‘প্রেমকে করেছি বাড়ি’ (২০০৭) এবং ‘আমজাদ আলীর মেঘবাড়ি’। গল্প গ্রন্থ: ‘ব্যালকনি গুলো’ (২০০৩), ‘আমার ভালোবাসার অটম’ (২০০৫)। এছাড়া আধুনিক ও দেশাত্মবোধক শতাধিক গানের রচয়িতা তিনি। সুবীর নন্দীর গাওয়া তাঁর হৃদয় ছোঁয়া “আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়” গানটি যে কোন প্রেমিক হৃদয়ে এখনও ঝড় তোলে। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০০০ সালে কবি জসিম উদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার এবং গীতি কবিতার জন্য ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগের বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। তিনি দৈনিক সংবাদ-এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ বেতার-এর উপ-পরিচালক, জার্মানির ডয়েস ভেলের সিনিয়র সম্পাদক ছাড়াও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সংগীত বিভাগের একজন উর্ধতন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন।
অন্যদিকে শিশু সাহিত্যিক খালেক বিন জয়েন উদ্দিনের জন্ম ১৯৫৪ সারের ২৪ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার চিত্রা গ্রামে। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণসহ রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। লেখালেখিতেও আমরা তাঁর সেই রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় পাই। তাঁর উল্লেখ করার মতো গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘ধান সুপারি পান সুপারি’, ‘আপিল চাপিল ঘন্টিমালা’, ‘চিরকালের ১০০ ছড়া’, ‘হৃদয় জুড়ে বঙ্গবন্ধু’, ‘নলিনীকান্ত ভট্টশালী’,‘ হুমায়ুননামা’,‘ মায়ামাখা শেখ রাসেল’, ‘বঙ্গবন্ধু ও শেখ মুজিব’ ইত্যাদি। ছড়ায় তাঁকে বলা হয় চিরায়ত বাংলার আধুনিক রূপকার। সেখানে শাণিত ও তীর্যকতার বদলে আমরা দেখি ঐতিহ্যের সাথে এক অটুট বন্ধন। শিশু সাহিত্যে ঐতিহ্যের বন্ধনে তাঁর অনন্যতার স্বাক্ষর ‘ধান সুপারি পান সুপারি’ ও ‘নলিনীকান্ত ভট্টশালী’ গ্রন্থ দুটি। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সংগে যুক্ত ছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকের ফিচার বিভাগের ‘কচিকাঁচার আসর’ পাতাটি সম্পাদনা করতেন। শিশু সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র একদিনের ব্যবধানে পর পর এই দুই গুণী লেখকের প্রয়াণে শোক জানাই। বাংলা সাহিত্যে তাদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।