Published : 11 May 2025, 12:15 PM
সাহিত্যজগতে এমন অনেক বই আছে যা তার রচয়িতাকে এনে দিয়েছে ভুবনজোড়া খ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তা। কিংবা বলা যায়, এমন কিছু লেখক আছেন যারা তাদের লেখা একটি বইয়ের জন্যই পাঠকমহলে সর্বাধিক পরিচিত। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা অন্যান্য অনেক কিছু লিখলেও তাদের নাম একটি বইয়ের সাথেই যেন অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এই যেমন অস্কার ওয়াইল্ড এর কথাই যদি বলি—তিনি যে শুধু ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’ ই লিখেছেন তা তো নয়, কিন্তু এই উপন্যাসটির জন্যই বিশ্বব্যাপী পাঠকদের কাছে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এরকমই আরেকজন লেখক হচ্ছে জেরম ডেভিড স্যালিঙ্গার। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’ উপন্যাসটির জন্যই তিনি সর্বাধিক পরিচিত যদিও এটি ছাড়াও তার অন্যান্য রচনা রয়েছে। আবার কিছু কিছু লেখক আছেন যাদের রচিত গ্রন্থের সংখ্যাই এক কিংবা দুই এবং বিশেষ ওই ‘এক’ রচনাই তাকে পাঠকহৃদয়ে অমর করে রেখেছে। আজ তেমন কয়েকজন লেখকের কথাই জানা যাক।
পেদ্রো পারামো (Pedro Paramo)
হুয়ান রুলফো
মেক্সিকান লেখক হুয়ান রুলফো সারা জীবনে একটি মাত্র উপন্যাসই লিখেছিলেন। পরবর্তী কালে আরও একটি উপন্যাস তিনি লিখছেন বলে জানালেও, তার কোনো হদিস কখনো মেলেনি। ধারণা করা হয়, তিনি সেটি কখনো লিখেনই নি। তার প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, উপন্যাসটির নাম পেদ্রো পারামো। শুধু স্প্যানিশ সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যেই এটি ছিল বাঁকবদলের এক উপন্যাস। এই উপন্যাসটি মেক্সিকান বিপ্লবের সময়কার বিবরণ হলেও, উপন্যাসের সবগুলো চরিত্রই ছিল মৃত। উপন্যাসের কাহিনির শুরু হয়েছে হুয়ান প্রেসিয়াদো নামের এক যুবক তার মায়ের অনুরোধে পিতা প্রেদো পারামোর সন্ধানে বের হয়। যাত্রাপথে তিনি অন্য যেসব চরিত্রদের সাথে পরিচিত হন তারা সবাই ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে। আমরা একটা সময় লক্ষ্য করি, হুয়ান প্রেসিয়াদো নিজেও মৃত। এই উপন্যাসটির সময়ের পেক্ষাপট ও কাঠামোগত নির্মাণের দিক থেকেও এক জটিল উপন্যাস। লাতিন আমেরিকার ভূতুরে বাস্তবতাকে এই প্রথম তিনি একটি মাত্র উপন্যাসে অত্যন্ত শৈল্পিক দক্ষতার সাথে চিত্রায়িত করেছেন। উপন্যাসটি অবলম্বনে প্রথম যে সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল তার চিত্রনাট্য রচনার সাথে জড়িত ছিলেন কথাসাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও কার্লোস ফুয়েন্তেস। হুয়ান রুলফোর জন্ম হয়েছিল ১০১৭ সালের ১৬ মে মেক্সিকোর সান গাব্রিয়েল-এ, মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৬ সালের ৭ জানুয়ারি মেক্সিকো সিটিতে।
হারপার লি
সবার শুরুতেই বলতে হয় আমেরিকান ঔপন্যাসিক হারপার লি’র কথা। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হল ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’।
১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ গ্রন্থটি জাতিগত সম্পর্ক নিয়ে রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৩০ এর দশকের আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলে প্রচলিত বর্ণবাদী মনোভাব এবং জাতি ও শ্রেনি নিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের অমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত যা একটি ছোট্ট মেয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। এটি ১৯৬১ সালে পুলিটজার পুরস্কারে ভূষিত হয়। উপন্যাসটি আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যের একটি চিরায়ত গ্রন্থ বলে বিবেচিত। ২০১৫ সালে তার দ্বিতীয় ও সর্বশেষ উপন্যাস ‘গো সেট আ ওয়াচম্যান’(Go Set a Watchman), মকিংবার্ড বইটির পরিশিষ্ট হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি শুধুমাত্র ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ বইটির জন্যই বিখ্যাত ছিলেন। এবং আজও তিনি মূলত এই বইটির জন্যই সাহিত্যজগতে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
দ্য হেল্প (The Help)
ক্যাথরিন স্টকেট
১৯৬০ এর দশকে মিসিসিপির জ্যাকশন শহরের তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকান গৃহপরিচারিকার জীবনের ওপর ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাসটি ক্যাথরিন স্টোকেটের প্রথম ও এখন পর্যন্ত লেখা একমাত্র উপন্যাস। এই একটি মাত্র উপন্যাসের জন্য তিনি পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বেদনা, হাস্যরস, ও আশায় পূর্ণ—দ্য হেল্প একটি অতি আবেঘন উপন্যাস। তিনজন নারী—কনস্টান্টাইন, আইবিলিন, ও মিনি। তাদের জীবন একে অপরের থেকে অনেকক্ষেত্রেই আলাদা, কিন্তু কোন এক জায়গায় তারা অভিন্ন। এই তিন নারীর জীবন ও একটি আন্দোলনের সূচনা বদলে দেয় একটি শহরকে এবং বদলে দেয় নারীদের, কন্যাদের, মায়েদের একে অপরকে দেখার, জানার, ও বোঝার দৃষ্টিকোণ। পাঠক হিসেবে আমরা জানি যে আমাদের ঘিরে যে সীমারেখা গুলো আছে তার মধ্যে কোন রেখাগুলো আমরা মানি এবং কোনগুলো ভাঙি। একটি মাত্র উপন্যাস—যা তার রচয়িতাকে এনে দিয়েছে ভুবনজোড়া খ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তা।
উইদারিং হাইটস (Withering Heights)
এমিলি ব্রনটি
ইংরেজি সাহিত্যে চিরায়ত গ্রন্থ হিসেবে খ্যাত ‘উইদারিং হাইটস’ এমিলি ব্রনটির একমাত্র উপন্যাস যা তাকে এখনো পাঠকহৃদয়ে অমর করে রেখেছে। উপন্যসটি ১৮৪৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। অতিপ্রাকৃত ও অপূর্ণ আবেগের ধবংসাত্নক শক্তির ওপর ভিত্তি করে রচিত এই উপন্যাসটি হিথক্লিফ ও ক্যাথরিন আর্নশ নামক দুজন মানুষের গল্প যাদের ব্যক্তিত্ব আবেগপূর্ণ ভালোবাসা, নিষ্ঠুরতা, ও প্রতিশোধ পরায়ণতায় পরিপূর্ণ। প্রকাশের সময় উপন্যাসটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, বর্তমানে এটি ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় একটি উপন্যাস যা এর মৌলিকতার জন্য খুব প্রশংসিত। অথচ উপন্যাসটির কোনো সাফল্য এমিলি ব্রনটি দেখে যেতে পারেন নি কারণ এটি প্রকাশের এক বছরের মধ্যেই মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
দ্য গুয়ার্নসে লিটারেরি এন্ড পটেটো পিল পাই সোসাইটি (The Guernsey Literary and Potato Peel Pie Society)
মেরি অ্যান শ্যাফার
২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গুয়ার্নসে লিটারেরি এন্ড পটেটো পিল পাই সোসাইটি’ মেরি অ্যান শ্যাফার রচিত একমাত্র উপন্যাস যা তার মৃত্যুর কয়েকমাসে পরে প্রকাশিত হয়েছিল। তার জীবদ্দশায় তিনি একজন সম্পাদক, গ্রন্থাগারিক, ও বইয়ের দোকানের কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। স্বপ্ন দেখতেন কোনো একদিন বই লিখবেন এবং নিজের লেখা সেই বই প্রকাশ হবে। হয়েছিলও তাই। তিনি এখন আমাদের কাছে একজন গুণী লেখক হিসেবেই পরিচিত। ‘দ্য গুয়ার্নসে লিটারেরি এন্ড পটেটো পিল পাই সোসাইটি’ তার লেখা প্রথম উপন্যাস। হঠাৎ করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তিনি তার ভাগ্নি এন্নি ব্যারোসের সহযোগিতায় বইটি লিখে শেষ করেন। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এবং একই বছরের জুলাই মাসে তার লেখা প্রথম উপন্যাসটিই তার একমাত্র উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হয়। এবং তার জীবনজুড়ে যে লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তা পূর্ণ হয়। ঐতিহাসিক এই উপন্যাসটি চিঠিপত্রের ধারায় রচিত হয়েছে। লেখিকা জুলিয়েট অ্যাশটন ও গুয়ার্নসির এক ব্যক্তির মধ্যে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে গড়ে ওঠে এক অসাধারণ কাহিনি আর তাই হল ‘দ্য গুয়ার্নসে লিটারেরি এন্ড পটেটো পিল পাই সোসাইটি’।
গন উইথ দ্য উইন্ড (Gone with the Wind)
মারগারেট মিচেল
মারগারেট মিচেল একজন আমেরিকান লেখক যিনি তার রচিত একমাত্র উপন্যাস ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ এর জন্য সর্বাধিক পরিচিত। উপন্যাসটি ১৯৩৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং এই উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৩৬ সালে ন্যাশনাল বুক আওয়ার্ড এবং ১৯৩৭ সালে তিনি পুলিটজার পুরস্কারে ভূষিত হন। ২৮ মিলিয়ন কপিরও অধিক বিক্রি হওয়া এই গ্রন্থটি সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। এটি তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র গ্রন্থ হলেও, মৃত্যুর বহু বছর পর, তার শৈশবের লেখাগুলোর একটি সংকলন ও কিশোরী বয়সে লেখা তার একটি উপন্যাসিকা ‘লস্ট লাইসেন’ (Lost Laysen) শিরোনামে প্রকাশিত হয়।