Published : 31 Dec 2023, 01:47 PM
চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বাতিঘর জীবন চেতনার কবি ও কথক আবুবকর সিদ্দিক। গত ২৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ভোর পৌনে ছয়টায় খুলনায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ আগস্ট বাগেরহাটের গোটা গ্রামে (পৈত্রিক নিবাস একই জেলার বৈটপুর গ্রামে) চলে যাওয়ার জন্য তিনি বহুদিন ধরেই প্রস্তুত ছিলেন। যেহেতু নানাবিধ রোগ বালাইয়ে জীবনসায়াহ্নে দীর্ঘদিন ধরেই ছিলেন শয্যাশায়ী। স্বাস্থ্যের এই কিছুটা উন্নতি তো এই অবনতি। এভাবেই দুলছিল তাঁর দেহঘড়ির পেন্ডুলাম। বলতে গেলে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফটই করছিল তাঁর আত্মার পাখি।
তাঁর এই চলে যাওয়া হয়তো অস্বাভাবিক নয়, পরিণত বয়সেই অনন্তে যাত্রা। তদুপরি এই চাটুকার পরিবেষ্টিত সমাজ ও প্রাতিষ্ঠানিক ধূর্তামির কাছে তিনি ছিলেন উপেক্ষিত ও নিঃসঙ্গ। সেকথা তিনি গোপন রাখেননি। প্রকাশ করে গেছেন তাঁর কবিতায়।
আমি যে কাছে যাবো মিশে যাবো হায় তারা তো
আমায় জানে না চাটুকাম-তাড়িত সমাজ।
আমি যে ছায়া নেব জাগাবো শিরায়
হায় আমার শেকড় দাঁড়ায় না শিলায়
অস্থির শিলায়
কিন্তু কেন তাঁর এই উপেক্ষা বরণ যখন অতুল তাঁর সৃষ্টিসম্ভার আর আমাদেরই বা কেন এই কৃপণতা কেন এই সংকীর্ণতা? কেন একমাত্র স্বীকৃতি তাঁর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার মাত্র। সাহিত্য যখন সর্বজনীন তখন ব্যক্তিগত দীনতা দিয়ে তাকে মুড়িয়ে দেয়া কি সম্ভব? যেহেতু ইতিমধ্যে বলাবলি হচ্ছে আমাদের সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করার মতো লেখক এখন নেই। আবুবকর সিদ্দিক ছিলেন প্রভাবশালী তো বটেই, সুদূর প্রভাব বিস্তারি এক লেখক। তাঁর কালজয়ী সৃজনই সেকথা বলবে। তিনি ছিলেন এপার বাংলার জাতীয় প্রতিনিধিত্বশীল লেখক। দেশের দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের প্রকৃতিক বিপর্যয়ের উপর রচিত দুটি কালজয়ী উপন্যাস জল রাক্ষস ও খরাদাহ তার প্রমাণ। এছাড়া গল্পে যে তিনি অসাধারণ তারও প্রমাণ পাই তাঁর চরবিনাশকাল এর মতো অনন্য এক গল্পে। বিদগ্ধজনের মতে তিনি আর কিছু না লিখলেও এই দুটি উপন্যাস ও চরবিনাশকাল গল্পের জন্য স্মরণীয় থাকবেন।
শুধু কি গল্প উপন্যাসে ছড়িয়ে ছিলেন তিনি? না, গদ্য, সমালোচনা সাহিত্য, শিশুসাহিত্য ও গণসংগীতের মতো জীবন জাগরণের শিল্পেও ছিলেন জড়িয়ে। তিনি এদেশে গণসংগীতের অন্যতম দিকপাল। জীবন ও সমাজ বদলের সংগ্রামে তাই তাঁর কলম যেমন ছিল শাণিত তেমনি মাঠেও ছিলেন সক্রিয়। চারটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পগ্রন্থ, আঠারোটি কবিতাগ্রন্থ ও হট্টমালা নামে একটি ছড়াগ্রন্থ নিয়ে তাঁর আটাশটির মতো বইয়ের খবর আমরা জানি। অথচ তার চেয়েও খুব কম লেখালেখির আমলনামা নিয়ে খ্যাতির মুকুট মাথায় পরেছেন অনেকেই। তাঁরাই ছিলেন তাঁর সাহিত্য প্রতিপক্ষ। সে জন্যেই হয়তো তাঁর প্রস্থান নিঃশব্দ। কোনো হইচই নেই সাহিত্য মহলে। আমি এই গুণীকে নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায়ই প্রায় পাঁচশত পৃষ্ঠার একটি মূল্যায়ন সংখ্যা প্রকাশ করেছি আমার সম্পাদিত সাহিত্য ছোট কাগজ ‘খেয়া’য়। এরপর তাঁর ওপর আর আমার কোনো কাজ করার অবকাশ নেই। এমনকি তাঁকে নিয়ে আমি একটি মূল্যায়নধর্মী গদ্যও লিখেছি। সুতরাং এই গুণীসাহিত্যিকের প্রতি আমার মতো সাধারণের এখানেই আত্মতৃপ্তি। কিন্তু অবাক হয়েছি দেখে যে শুধু সাহিত্যজন ও প্রাতিষ্ঠানিক উপেক্ষার শিকারই নন তিনি, নিজের পরিবারেও উপেক্ষিত ছিলেন তিনি। নইলে পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জন্মদাতা হয়েও তিনি কেন নিজের ছোট্ট বোনের বাড়িতে থাকবেন? জীবনের শেষ বিদায়ও সেখান থেকেই। যেন তাঁর জীবনটাও একটা ঘোরলাগা গল্প।