Published : 12 May 2025, 12:32 AM
দীর্ঘ সময় ধরে দেশে গুম, খুন, হত্যার মত নানা রাষ্ট্রীয় অপরাধের ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে ‘ক্ষত’ তৈরি হয়েছে, তা সারাতে এবং অপরাধীদের ‘শোধরাতে’ দক্ষিণ আফ্রিকার আদলে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন জরুরি বলে মনে করছেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার।
কী করবে সেই কমিশন? ফরহাদ মজহার বলছেন, এই কমিশন অবশ্যই অপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা করবে। সেই সঙ্গে অপরাধগুলো কেন ঘটেছে, কারা এর হুকুম দিয়েছে, কারা করেছে, তা খুঁজে বের করবে। যারা হুকুমের অধীন হয়ে অপরাধ করেছে, কমিশনের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করবে, কারণ ‘স্বীকারোক্তি ছাড়া ক্ষমা মেলে না’।
এই সতান্বেষণ আর বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যদি মীমাংসা করা না হয়, ক্ষত যদি সারানো না যায়, তাহলে সমাজে বড় ধরনের ‘অস্থিতিশীলতা’ দেখা দেওয়ার শঙ্কা থেকে যাবে বলে তিনি মনে করছেন।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউটে’ অতিথি হয়ে এসেছিলেন ফরহাদ মজহার। সেখানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তসহ সমকালীন রাজনীতির নানা দিক নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শনিবার বিকালে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর দ্বিতীয় খসড়ার ওপর মতবিনিময় সভা হয়।
সেখানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করার কথা বলেন। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে প্রধান বিচারপতিসহ একটি দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন বলে অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন উপদেষ্টা।
বর্ণবাদের বিভাজন দূর করে সংহতি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৫ সালে ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করে দক্ষিণ আফ্রিকা। সত্য উদ্ঘাটন, বিচার ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে দেশটিতে ওই কমিশন করা হয়।
অপরাধীদের ‘শোধরাতেই’ কমিশন জরুরি
কেন এবং কীভাবে এ কমিশন গঠিত হবে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলছেন, তিনি বহু আগে থেকেই এ কমিশনের কথা বলে আসছেন।
“এমনকি জামায়াতের যখন বিচার হয়; আওয়ামী লীগের আমলে; সেই সময়ও আমি আওয়ামী লীগকে বলেছিলাম আপনারা এ ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন জাতীয় একটা কমিশন গঠন করুন এবং একাত্তরে অপরাধগুলো মীমাংসা করুন।”
এই চিন্তক বলেন, “এ সমাজের যে ক্ষত, সামাজিক ক্ষত, সমাজের যে রাজনৈতিক ক্ষত, সমাজের যে সাংস্কৃতিক বিভ্রম, সমাজের যে তাত্ত্বিক বিচ্যুতি, এটা যেন আমরা শোধরাতে পারি। তো আমার কথা তো তখন শোনেনি। এবারও এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রত্যেককে…ব্যক্তিগতভাবে জামায়াতে ইসলামের আমির শফিকুর রহমানকে আমি বলেছি, বিএনপিকে বলেছি, তারেককে বলেছি টেলিফোনে। আমি সকলকে বলেছি, আমাদের অবশ্যই অবিলম্বে একটা রেকনসিলিয়েশন এবং রিকনস্ট্রাকশন কাউন্সিল গড়া দরকার।”
তিনি বলেন, “আমি বারবারই এটা বলেছি, কেউ কিন্তু আমার কথা শোনেনি। গতকাল নতুন গুম আইন নিয়ে একটা আলোচনা চলেছিল, সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি তখন এ কথাটা বলেছি আবার। এবং আমি খুশি হয়েছি যে আমাদের আইন উপদেষ্টা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরহাদ ভাই, আমরা এটা ভাবছি এবং আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছি এটা আরও জানতে এবং আপনাকে আমরা জানাব এর কী অগ্রগতি হয়’।”
পারস্পরিক শত্রুতা এবং বিভাজন দূর করতে এ কমিশন গঠন জরুরি বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের বাস্তবতায় এর কী নাম দেব, তাতে কী শর্ত থাকবে, এটা আমরা নিজেরা আলোচনা করতে পারব। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসেন এবং যারা ফ্যাসিস্ট নন, তারা একটা মতাদর্শ ধারণ করেন। আমি একমত নাও হতে পারি তার সঙ্গে, ইতিহাস সম্পর্কে তার একটা পঠন থাকতে পারে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যেন সমাজে আলাপ-আলোচনার, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে একটা নতুন বাংলাদেশের নতুন বয়ান তৈরি করতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের যে পারস্পরিক শত্রুতা, যে বিভাজনগুলো ঘটছে, সেগুলো মীমাংসা করতে পারি।
“এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, যারা এই গুমের সঙ্গে জড়িত, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ে জড়িত, বিভিন্ন রকম অত্যাচার-দমনে জড়িত, তাদের বিচার তো আপনাকে করতেই হবে। এর তো কোনো বিকল্প হতে পারে না।”
তবে কমিশন গঠন করা ছাড়া সেই বিচারিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।
“আপনি যখন এটা বিচার করতে যাবেন, আপনি কি মনে করেন যে সমাজ তখন খুব স্থিতিশীল থাকবে? স্থিতিশীল থাকবে না। কারণ, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে অনেক শক্তিশালী ব্যক্তি জড়িত, অনেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান জড়িত, আমার নাম বলা দরকার নাই।”
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “ধরুন আপনি গুমের জন্য, আয়নাঘরের জন্য কারো বিচার করতে যাচ্ছেন, যখন বিচার করতে যাবেন, আপনাকে সার্ভিং জেনারেলদের বিচার করতে হবে। আপনি কি পারবেন? এটা কি সম্ভব? আপনি সার্ভিং জেনারেলদের বিচার করতে গেলে বাংলাদেশে একটা অভ্যুত্থান হয়ে যাবে। ফলে আপনি কী করবেন?”
যেভাবে কাজ করবে কমিশন
ফরহাদ মজহার বলেন, “এটা করার পদ্ধতি হচ্ছে– নাম্বার ওয়ান সেই প্রাতিষ্ঠানিক ইন্টিগ্রিটি, সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রথমত এই বিচারটা করার সুযোগ দেওয়া। প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, সমাজে একটা ট্রুথ এবং রেকনসিলিয়েশনটা থাকুক। যারা হুকুমের অধীন হয়ে অপরাধ করেছেন, তারা স্বীকার করুক।
“স্বীকারোক্তি ছাড়া তো ক্ষমা হয় নারে ভাই। আপনি যদি শেয়ার করেন, ভাই এই এই কারণে আমার এই কয়েকটা করতে বাধ্য হয়েছি। তা নাহলে তো আপনি ক্ষমা পাবেন না। কারণ, ক্ষমার তো কোনো সুযোগ নাই, অপরাধে যে কেউ করতে পারি। তওবা করলে তো আল্লাহ পর্যন্ত মাফ করে দেয়।”
এই কলামনিস্ট বলেন, “সত্যটা জানা দরকার। আমার সন্তানকে আপনি গুম করেছেন, তার লাশটা আমি খুঁজে পাইনি। আমার স্বামীকে আপনি গুম করেছেন, তার লাশ কোথায় আছে আমি জানি না। এবং যে কারণে তার যে সম্পত্তি, কারা পাবে কারা পাবে না, আদৌ তিনি বেঁচে আছেন কি বেঁচে নেই, এটা আমি জানি না। এত বড় নিষ্ঠুরতা তো আমরা টিকিয়ে রাখতে পারব না।”
তিনি বলেন, “আমি মনে করি যে সেনাবাহিনীতে যদি কোনো মানুষ এই অপরাধ করে থাকেন, তারা ভেবে দেখবেন, এত বড় একটা ক্ষত রেখে আমরা তো বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করতে পারব না।
“একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই ধরনের রেকনসিলিয়েশন অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন অথবা ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন, আপনি যে নামই দেন না কেনো, কিছু আসে যায় না, এর মাধ্যমে আপনি এটার মীমাংসা করেন। যদি আপনি মীমাংসা না করেন, আপনি কী করবেন? আপনি বাংলাদেশকে চরম একটা অস্থিতিশীল জায়গায় ঠেলে দেবেন। এবং একই সঙ্গে আপনি কী করবেন? আপনি সেনাবাহিনী বনাম জনগণের মধ্যে একটা মারাত্মক বিভেদ তৈরি করবেন।”
‘প্রজ্ঞার সাথে করতে হবে’
সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি হলে তা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।
“ফলে যা কিছু কাজ আমরা করি না কেন, অত্যন্ত সতর্কভাবে, অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে, অত্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে এগুলো ডিল করতে হবে। সে ধরনের প্রজ্ঞাবান মানুষ থাকতে হবে।”
এ প্রক্রিয়ায় কোনো আপস করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রথম কথা হল যাদেরকে গুম করা হয়েছে, যেসব পরিবারের প্রতি অত্যাচার হয়েছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের প্রতি ইনসাফ কায়েম করতে হবে। এটা কোনো নেগোসিয়েবল না। যতক্ষণ এটার ইনসাফ না করবেন, তাদের প্রেতাত্মা আমাদের পেছনে ঘুরে ফিরবে। সেই একাত্তরের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াবে। ফলে এটা করতেই হবে। যারা বাধা দিচ্ছেন এখন, তারা কিন্তু বাধা দিয়ে মুক্তি পাবেন না। সেজন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। আশা করব আইন উপদেষ্টা অবিলম্বে এ প্রক্রিয়া শুরু করবেন।”
‘নিষেধাজ্ঞার দায় আওয়ামী লীগের’
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে শনিবার আওয়ামী লীগকে যে নিষিদ্ধ করা হল, তাতে তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের দায়ও দেখছেন ফরহাদ মজহার। নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটিও তার ভাবনা মোতাবেক হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
এই তাত্ত্বিক বলেন, “এখন পর্যন্ত সেভাবেই হয়েছে। অনেক ঘাটতি আছে, কিন্তু প্রথমত যে কথাটা বলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার– আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া পর্যন্ত; ঠিকই আছে। তারা তো একটা বিচার চাইছেন। তার আগে যদি আওয়ামী লীগ, যদি শেখ হাসিনা ভারতে বসে ক্রমাগত প্রভোক না করত, যদি আবদুল হামিদ পালিয়ে না যেতেন এবং ছাত্রলীগ, যে কোনো কথা বললে হামলা খেয়ে পড়ে ফেইসবুকে, তাদের যে হামলা ক্রমাগত চলছে…ফলে আজ বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এ বিচারটা সাঙ্গ হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত একটা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে এবং এটা সঠিক সিদ্ধান্ত।
“এটার মধ্যে তো আমি তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত দেখছি না। আমার চিন্তার সঙ্গে খুবই সংগতিপূর্ণ।”
আরও পড়ুন
পশ্চিমা প্রযুক্তির হার এড়াতে যুদ্ধ থামান ট্রাম্প: ফরহাদ মজহার
নারী সংস্কার কমিশন খারাপ কী বলেছে, ধর্ম সংস্কার তো করতে বলেনি: ফরহাদ মজহার