Published : 24 May 2025, 10:12 PM
গণ অভ্যুত্থানের যে ‘প্রতিশ্রুতি’ রক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তা শেষ করতে তার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে তারা প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের অভিপ্রায় নিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের নিয়ে গঠিত দল এনসিপি।
দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠকের পর এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বসেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।
রাত পৌনে ১০টার দিকে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠক শেষে রাত ১০টা ১০ মিনিটের দিকে যমুনা থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, “আজকের এই আলোচনায় আমরা প্রথমেই ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছি এবং উনাকে আমরা অনুরোধ করেছি, আহ্বান জানিয়েছি যে, গণভ্যুত্থানের যেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় উনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সেই দায়িত্ব সম্পন্ন করেই যাতে উনি সিদ্ধান্ত নেন যে কোনো বিষয়ে।”
সেই সঙ্গে পাঁচ দফা দাবিও বৈঠকে তুলে ধরেছেন এনসিপির প্রতিনিধিরা। তাতে এটা স্পষ্ট যে, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেসব বিষয়ে তাদের মতভেদ, তাতে দলের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন আসেনি।
১ .আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের একটি দাবি ছিল এনসিপির। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই সনদ দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যেই যাতে জুলাই ঘোষণাপত্র আকারে তা জারি করা হয়, সেই আহ্বান বৈঠকে জানিয়েছে এনসিপি।
নাহিদ ইসলাম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার দিক থেকে এই দাবি পূরণের বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।
২. এনসিপি বলেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার এবং আহতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে। গণভ্যুত্থান অধিদপ্তর থেকে যে সঞ্চয়পত্র দেওয়ার কথা ছিল, সেটি এখনো সকল শহীদ পরিবার পায়নি। মাসিক ভাতা দেওয়ার কথা ছিল, তা এখনো দেওয়া শুরু হয়নি।
দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে আর্থিক সহায়তাসহ পুনর্বাসনে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়, সেই দাবি প্রধান উপদেষ্টার সামনে রেখেছেন এনসিপি নেতারা।
৩ শেখ হাসিনার আমলে হওয়া সকল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন আইন করে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করতে বলেছে এনসিপি।
দলটি বলছে, সেই নির্বাচনগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এবং তখনকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন সময় ওই নির্বাচন প্রত্যাখান করেছে। কিন্তু এখন আবার সেই নির্বাচনগুলোকে আদালতে নিয়ে ‘এক ধরনের পরিস্থিতি’ তৈরি করা হচ্ছে।
সেজন্য ‘বিশৃঙ্খলা এড়াতে’ আগের সেসব নির্বাচন আইন করে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছে এনসিপি।
৪. এনসিপি বলেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর তারা আর আস্থা রাখতে পারছে না। এই কমিশন পুনর্গঠন করে যেন দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা হয়।
৫. জুলাই গণহত্যার বিচার; রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়া ও জুলাই সনদ ঘোষণা এবং গণপরিষদ ও আইনসভা নির্বাচন– এই তিনটি বিষয়ে সমন্বিত একটি পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রধান উপদেষ্টার কাছে চেয়েছে এনসিপি।
নাহিদ বলেন, “জুলাই মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ আসতে পারে, এরকমটা আমাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। আমরা বলেছি যে বিচারটাও কবে শেষ হবে, কোন প্রতিয়ায় আগাবে এবং নির্বাচন যেটা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হওয়ার কথা, সেটারও একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা যাতে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করে। মোটা দাগে এই পাঁচটি বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে।”
অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা দুই ছাত্র প্রতিনিধির পদত্যাগ দাবি করেছে বিএনপি, এ বিষয়েও এনসিপি নেতাকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
জবাবে তিনি বলেন, “আমরা সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে, ছাত্র উপদেষ্টা যারা রয়েছেন, তারা গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে গিয়েছিলেন, সরকারকে বৈধতা দিয়েছেন। ফলে তাদের সাথে কোনো রাজনৈতিক দলের বা এনসিপির যে সম্পর্ক নাই, সেটা আমরা আজকে সকালের বক্তব্যও স্পষ্ট করেছি।
“বরং গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি আকারে তারা (সরকারে) গিয়েছে। গণভ্যুত্থনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করছে, অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে মিলে। সেখানে তাদেরকে হেয় করা, তাদেরকে অপমান করা, সে বিষয়ে আমরা নিন্দা জানিয়েছি। আমাদের সাথে তাদেরকে জড়িয়ে ট্যাগ দিয়ে তাদেরকে পদত্যাগ করতে বলাটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বলে আমরা বলেছি।”
এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের অভিপ্রায় নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে। সেখানে এনসিপি কী বলেছে তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।
উত্তরে নাহিদ বলেন, “আমরা বলেছি যে উনি যাতে দায়িত্বে থাকেন, দায়িত্ব থেকে রাজনৈতিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে সকল পক্ষের সকল সমস্যার সমাধান করেন। কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং জনগণ এবং যে গণঅভ্যুত্থানকারী ছাত্রজনতা, তাদের আহ্বানেই তিনি দায়িত্বে এসেছেন এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই তিনি আসলে কমিটেড, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি উনি কমিটেড নয়, এ বিষয়টা যাতে উনি বিবেচনা করেন যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে।”
কী কারণে ইউনূস সরে যেতে চান, সেই প্রশ্নে এনসিপি নেতা বলেন, “উনি কাজ করতে পারছেন না, বা উনি দায়িত্ব ছেড়ে দিবেন কিনা, এ বিষয়ে উনার চিন্তা ভাবনা রয়েছে। এটা তো অলরেডি মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়ায় এসেছে। তো সেই প্রেক্ষিতেই আজকের এই বৈঠক।”
অধ্যাপক ইউনূস কেন হতাশ– সেই প্রশ্নের উত্তরে নাহিদ বলেন, “ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করেছেন, তার কারণ হচ্ছে, যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে উনি দায়িত্বে এসেছেন, সেই সময় আমরা যেহেতু আন্দোলনের প্রতিনিধি ছিলাম, আমরাই উনাকে আহ্বান করেছিলাম, গণঅভ্যুত্থান পরিবর্তী একটা নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য।
“এবং শুধু ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস বা সরকার নয়, সেই সময় যারা আমরা আন্দোলন করেছিলাম, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সকলেই কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি জনগণের কাছে ব্যক্ত করেছি যে একটা নতুন বাংলাদেশ… সংস্কারের মধ্য দিয়েই নতুন বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব। সেই নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি থেকে কোনো কোনো পক্ষ সরে আসছে বলে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের মনে হচ্ছে এবং উনাকে চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন দাবি আদায়ের চেষ্টা চলছে। এর ফলে আসলে এইভাবে উনার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। এবং সংস্কার বা পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তো সেই জায়গাতে উনি হতাশা ব্যক্ত করেছে।
“আমাদের জায়গা থেকে আমরা বলেছি, যে কোনো রাজনৈতিক দল নয়, উনি যাতে জনগণের প্রতি, গণঅভ্যুত্থানকারী, ছাত্র জনতার প্রতি কমিটেড হন, সেই জায়গায় কাজ করতে উনি উনার দৃঢ়তা ব্যক্ত করেন।“
বৈঠকে এনসিপির চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন দলের মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা।
ছাত্রজনতার প্রবল আন্দোলনে গত বছর ৫ অগাস্ট সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার তিন দিন পর ৮ অগাস্ট নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
এর সাড়ে নয় মাস পর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও অভ্যুত্থানের নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ভিন্ন অবস্থান এবং ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ পড়ানো নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের ঘটনা ঘটে।
দুই পক্ষই কিছু উপদেষ্টার পাল্টাপাল্টি পদত্যাগের দাবি তোলে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার মধ্যে সেনানিবাসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন বলে খবর আসে।
এমন প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের গুঞ্জন চলে। রাতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে যান নাহিদ; যিনি এনসিপির দায়িত্ব নিতে গত ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করেন।
নাহিদের পর সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন।
দেখা করার পর নাহিদ সংবাদমাধ্যমে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ‘পদত্যাগের কথা ভাবছেন’।
বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ডিসেম্বরের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলের অবস্থান জানানো হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওইদিন বৈঠক করে জামায়াতে ইসলামী। বৈঠকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর দলটির আমির শফিকুর রহমান সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানান।
আরও পড়ুন
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি
সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জামায়াতের
আরেকটা এক-এগারোর 'পাঁয়তারা চলছে': নাহিদ
রাতে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা
ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন: কী ছিল তৈয়্যবের ফেইসবুক পোস্টে
পদত্যাগের কথা 'ভাবছেন' ইউনূস: নাহিদ
গুজবে বিভ্রান্ত না হতে সেনাবাহিনীর আহ্বান
গুঞ্জনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নাহিদের আধা ঘণ্টার সাক্ষাৎ