Published : 22 May 2025, 11:18 PM
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সময় সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করেছে সেনাবাহিনী।
বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর বলেছে, ওই সময় ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।
তাদের মধ্যে ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন অসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ৫১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ ১২ জন এবং স্ত্রী ও শিশু ৫১ জন পরিবারের সদস্য ছিলেন।
সঙ্গে ৫৭৮ জনের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি যাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি, তারা আশ্রয় নেওয়া অন্যদের স্ত্রী-সন্তান।
আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সেসময়ে শুধুমাত্র মানবিক দায়বদ্ধতার কারণে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে আশ্রয় প্রার্থীদের জীবন রক্ষা করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।”
পরিবারসহ সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, আপিল বিভাগের বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নাম রয়েছে এই তালিকায়।
তাদের মধ্যে শামসুল হক টুকু গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। বাকিদের আর কখনো প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তারা কোথায় আছেন, তাও প্রকাশ করা হয়নি।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের তখনকার বিচারকরা পদত্যাগ করে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়। আর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পদত্যাগের খবর জানানো হয় ২ সেপ্টেম্বর।
সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, বিগত সরকারের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম, গত সংসদের এমপি সায়েদুল হক সুমন, কাজী নাবিল আহমেদ, নাজমা আক্তার, রাগিবুল আহসান রিপু, এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন, এমএ লতিফ এবং ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতও সেসময় সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তাদের মধ্যে শাজাহান খান, পলক, সুমন, রিপু ও সৈকত পরে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন।
তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, তখনকার র্যাব মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার লুৎফুল কবির, পুলিশের বিশেষ শাখার তৎকালীন প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিআইজি আসাদুজ্জামান, আমেনা বেগম, আমিনুল ইসলাম, অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার, পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার আজিমুল হকও সেনা নিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তাদের মধ্যে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
কোন পরিস্থিতিতে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “জুলাই-অগাস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পর কতিপয় কুচক্রী মহলের তৎপরতায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। ফলশ্রুতিতে, সরকারি দপ্তর, থানাসমূহে হামলা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপর আক্রমণ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, মব জাস্টিস, চুরি, ডাকাতিসহ বিবিধ বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। এ ধরনের সংবেদনশীল ও নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দেশের নাগরিকদের মনে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম নেয়।
“এমতাবস্থায়, ঢাকাসহ দেশের প্রায় সকল সেনানিবাসে প্রাণ রক্ষার্থে কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নাগরিকগণ আশ্রয় প্রার্থনা করেন। উদ্ভূত আকস্মিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সেনানিবাসে আশ্রয়প্রার্থীদের পরিচয় যাচাই বাছাই করার চাইতে তাদের জীবন রক্ষা করা প্রাধান্য পেয়েছিল।”
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পরিস্থিতি উন্নয়ন সাপেক্ষে, আশ্রয় গ্রহণকারীদের বেশিরভাগই এক-দুই দিনের মধ্যেই সেনানিবাস ত্যাগ করেন এবং এর মধ্যে পাঁচজনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়।”
তালিকায় দেখা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ২১ জন করে; বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে সাতজন; কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ২৫ জন; ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্টে তিনজন; যশোর ক্যান্টনমেন্টে ছয়জন; খুলনা ক্যান্টনমেন্টে ৭ জন; ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে ৯ জন; রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে ২৭ জন; রংপুর ক্যান্টনমেন্টে একজন; সিলেট ক্যান্টনমেন্টে ১৫ জন আশ্রয় নেয়। বাকিরা সাভার ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন।
কেন এই তালিকা প্রকাশ করা হল, সেই ব্যাখ্যায় আইএসপিআর বলেছে, “সেনানিবাসে অবস্থানকারী ও আশ্রয় প্রার্থীদের ব্যাপারে গত ১৮ অগাস্ট ২০২৪ তারিখে আইএসপিআর এর আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় এবং একই দিনে ১৯৩ জন ব্যক্তিবর্গের একটি তালিকা (৪৩২ জন সাধারণ পুলিশ সদস্য ও ১ জন এনএসআই সদস্য ব্যতীত) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়- যা ছিল একটি মীমাংসিত বিষয়। সেনানিবাসে আশ্রয়প্রার্থী এসকল ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা ও জীবন রক্ষার্থে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাময়িক আশ্রয় প্রদান করা হয়েছিল।”
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “তৎকালীন বিরাজমান নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে আশ্রয় প্রার্থীদের জীবন বিপন্ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে, জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সেনানিবাসের অভ্যন্তরে প্রাণ রক্ষার্থে আশ্রয় গ্রহণকারী ৬২৬ জন ব্যক্তিবর্গের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা (৪৩২ জন সাধারণ পুলিশ সদস্য ও ১ জন এনএসআই সদস্যসহ) এই প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে সংযুক্ত করা হল।”
সকলকে ‘বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার’ থেকে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানিয়েছে আইএসপিআর।