Published : 11 May 2025, 08:33 AM
বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা সিকিভাগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, যদিও তারা দুই দশক ধরে মূল বেতনের শতভাগ উৎসব ভাতা দাবি করে আসছিলেন।
সিকিভাগ বাড়িয়ে শিক্ষকদের ৫০ শতাংশ এবং কর্মচারীদের ৭৫ শতাংশ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।
এই প্রস্তাব ঈদুল আজহার আগে অনুমোদন হলে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা এবারের ঈদেই বর্ধিত ভাতা পাবেন।
এতদিন শিক্ষকরা মূল বেতনের ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা পেয়ে আসছিলেন, যা কার্যকর করা হয়েছিল ২০০৪ সাল থেকে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব নুজহাত ইয়াসমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যথাযথ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া প্রস্তাব আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাজেট অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ ফারুক-উজ-জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।”
তবে প্রস্তাবটি অনুমোদন দেওয়া হবে কি না, দিলে কবে নাগাদ হতে পারে সে বিষয়ে এই কর্মকর্তা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি।
এমপিওভুক্ত সাড়ে ১৭ হাজারের বেশি স্কুল ও ২ হাজার ৮ শ’র বেশি কলেজের ৩ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর উৎসব ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এজন্য বছরে ৪৮০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে সরকারের।
তবে বেসরকারি এমপিওভুক্ত কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি।
শতভাগ উৎসব ভাতা, সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা দেওয়া এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারিকরণের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলনের মধ্যে গত ৫ মার্চ শেষ কর্মদিবসে শিক্ষক-কর্মচারীদের ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা দেন তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
উপদেষ্টার এ বার্তা পাওয়ার পরদিন ৬ মার্চ ২২ দিন থেকে চলা আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষকরা।
প্রতি ঈদে খরচ ২৪০ কোটি টাকা
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষকদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে।
অধিদপ্তরের অর্থ ও ক্রয় শাখার সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চলতি অর্থবছরের বাজেটে যে টাকা উদ্বৃত্ত ছিল সেখান থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
“প্রস্তাব অনুযায়ী শিক্ষকদের উৎসব ভাতা হবে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ আর কর্মচারীদের উৎসব ভাতা হবে মূল বেতনের ৭৫ শতাংশ। এজন্য একটি ঈদে ২৪০ কোটি টাকা খরচ হবে।”
খুব শিগগিরই অর্থবিভাগ এ প্রস্তাব অনুমোদন করবে বলে আশা প্রকাশ করে এই কর্মকর্তা বলেন, “আগামী বছরের বাজেটেও এ খাতে মোট ৪৮০ কোটি টাকার সংকুলান রাখা হয়েছে।”
দুই দশকের দাবি নিয়ে যা বলছেন শিক্ষকরা
২০০৪ সালে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তৎকালীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে আয়োজিত যে অনুষ্ঠানে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এ ঘোষণা দিয়েছিলেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ শিক্ষক নেতা ও অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “২০০৪ সালেই আমাদের দাবি ছিল শতভাগ উৎসব ভাতার। কিন্তু তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বাজেটে টাকা নেই। তাই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতনের ২৫ শতাংশ ও অপেক্ষাকৃত কম বেতন পাওয়া কর্মচারীদের মূল বেতনের ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা দেওয়ার ঘোষণা এসেছিল।”
শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে মাজহারুল হান্নান বলেন, “আগে এক সিকি উৎসব ভাতা পাওয়া শিক্ষকদের আরেক সিকি বাড়ানোর আলোচনা আছে। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা, আসন্ন বাজেটে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ উৎসবভাতা দেওয়ার সংকুলান রাখবে সরকার।”
এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা মূল বেতনের শতভাগ উৎসব ভাতার দাবি আদায়ে ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি ও প্রতীকী অনশন শুরু করেন।
‘এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট’ নামে একটি মোর্চার ব্যানারে শিক্ষকদের এ কর্মসূচি চলার মধ্যে বিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ৫ মার্চ ভাতা বাড়ানোর বার্তা দেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এই উপদেষ্টা সেদিন বলেছিলেন, “তাদের উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এ বছরের ঈদুল আযহা থেকে শুরু করে আমরা আগামী বছরের বাজেট থেকে অন্তত কিছু বাড়াতে পারব।
“এখানেও আমি ঘোষণা দিচ্ছি না কত বাড়াব। কিন্তু আমি জানি, কারণ সেটুকু বাজেটের মধ্যে, এ বছরের এবং আগামী বছরের বাজেটের মধ্যে সেটার পজিশন রাখা হচ্ছে।”
উপদেষ্টা এই বার্তা দেওয়ার পরের দিন শিক্ষকরা আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসবভাতা আংশিক বাড়ানো হলে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করব না। তবে আগামী বাজেট থেকে যেন শতভাগ উৎসবভাতা, সরকারি নিয়মে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও শ্রান্তি বিনোদন ভাতা দেওয়া হয় সে দাবি থাকবে।
“আর ১৫ মের মধ্যে এমপিওভুক্ত উৎসবভাতা বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলে আমরা ফের রাজপথে নামব। আমরা ঈদুল আজহা থেকেই বর্ধিত হারে উৎসব ভাতা পেতে চাই।”
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি-বিটিএর সভাপতি শেখ কাওছার আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ২৫ পার্সেন্ট বা ৫০ পার্সেন্ট উৎসব ভাতা চাই না, আমরা কোনো পার্সেন্টেজ চাই না। আগামী ঈদুল আজহার আগেই সব শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের শতভাগ উৎসব ভাতা দিতে হবে।
“তা না হলে আমরা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করব, আর সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মত এমপিওভুক্তদেরও বাড়িভাড়া এবং চিকিৎসাভাতা দিতে হবে।”
মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষকরা বাড়তি ভাতা পাবেন?
বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা আছে ৮ হাজার ২২৯টি, মোট শিক্ষক-কর্মচারী ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬৫ জন। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৪০ জন।
আর কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ২২২। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রসা শিক্ষা অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নজরুল ইসলামের কাছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর কোন উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের অর্থ শাখার উপপরিচালক কে এম শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় এখনও মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।”
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের এমপিও শাখার উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরাও কোন নির্দেশনা পাইনি। তাই কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসবভাতা বাড়ানোর কোন প্রস্তাব প্রস্তুত করিনি।”
আন্দোলনের হুঁশিয়ারি মাদ্রসা ও কারিগরি শিক্ষকরা
বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসবভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা।
‘মাদ্রাসা জেনারেল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এর সভাপতি জহির উদ্দিন হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বরাবরই স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসা ও কারিগরির শিক্ষক-কর্মচারীদের একই নিয়মে সব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়।
“তাদের সাথে উৎসব ভাতা না বাড়ানোর ঘটনা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষকদের চরমভাবে বিক্ষুব্ধ ও আন্দোলনমুখী করবে। এর ফলে শিক্ষাখাতে চরম অরাজকতা নেমে আসবে।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই যেন শিক্ষক-কর্মচারীদের একই হারে উৎসব ভাতা বাড়ানো হোক। তা না হলে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষকরা আন্দোলনে নামবেন।”