Published : 23 Feb 2025, 12:44 AM
জেলার উন্নয়ন কাজে যুক্ত দপ্তরগুলোর নিয়ন্ত্রণ জেলা পরিষদের হাতে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
কমিশন বলেছে, চেয়ারম্যান থাকবেন জেলা পরিষদের নেতৃত্বে। যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা হবেন জেলা পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা।
এছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে পৃথকভাবে জাতীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা এবং ভূমি ব্যবস্থাপনায় রাখার প্রস্তাব এসেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে।
সরকার পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারে দ্বিতীয় ধাপে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার’ কমিশনের প্রাথমিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
স্থানীয় সরকার কমিশন প্রাথমিকভাবে স্থানীয় সরকার সংগঠন, আইন অবকাঠামো, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারী প্রতিনিধিত্ব, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার, স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অর্থায়ন, স্থায়ী স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন, স্থানীয় সরকার সার্ভিস কাঠামো, স্থানীয় সরকারের পৃথক অধিদপ্তর গঠনের সুপারিশ করেছে।
ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে অক্টোবরে প্রথম ধাপে রাষ্ট্রের ছয়টি খাত সংস্কারে কমিশন গঠন করে।
গত ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনসহ আরো পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে এই সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এই অধ্যাপকের নেতৃত্বে কাজ করেছেন সাত সদস্য।
এই কমিশন কাজ শুরু করেছে গেল বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে। কাজের জন্য ১৫টি ক্ষেত্র নির্ধারণ করে প্রতিবেদনের কাঠামো গঠন করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চূড়ান্তে আরও সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন কমিশন।
দ্বিতীয় ধাপে গঠিত পাঁচ কমিশনের মধ্যে ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের’ প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা পড়ায় বাকি থাকল গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন।
স্থানীয় সরকার আইন ও সাংগঠনিক কাঠামো
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বিদ্যমান তিন স্তর বিশিষ্ট গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ) এবং নগর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (পৌরসভা, সিটি করপোরেশন) আইন ও সাংগঠনিক কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কারের করা দরকার।
জেলা পরিষদের কার্য ও কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনের সুপারিশ করা হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সারাদেশে স্থানীয় সরকারের পাঁচটি মৌলিক আইন আছে তুলে ধরে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনগুলো ভিন্ন হওয়ায় ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ কাঠামো অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ কারণে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের তিনটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি আইনের বদলে একটি এবং নগর স্থানীয় সরকারের দুটি আইনের বদলে একটি আইনের অধীনে এনে কাঠামোগত সামঞ্জস্য রক্ষার প্রস্তাব করেছে কমিশন।
অভিন্ন বা সমন্বিত দুইটি স্থানীয় সরকার আইনের খসড়াও প্রস্তাব করেছে কমিশন।
নারী প্রতিনিধিত্ব
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে প্রচলিত সংরক্ষিত নারী আসন পদ্ধতি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
এতে বলা হয়েছে, পুরো পরিষদের ও কাউন্সিলের মোট ওয়ার্ডের এক তৃতীয়াংশ (একক আসন) প্রতি নির্বাচনে নারীদের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি সংরক্ষিত রাখা হবে। স্থানীয় সরকারের প্রস্তাবিত নতুন কাঠামো অনুযায়ী সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা পদাধিকার বলে চেয়ার ও মেয়র কাউন্সিলের নির্বাহী পরিষদের এক তৃতীয়াংশ সদস্যপদ পাবেন।
স্থানীয় পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থা
আগামী দুই বছরের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সারা দেশের সকল উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপনের সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের পাশাপাশি একই পদমর্যাদায় প্রতিটি উপজেলায় ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন সিনিয়র সহকারী জজ এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় স্থাপন করা হবে।
গ্রাম আদালত বিলুপ্ত করে ওয়ার্ড পর্যায়ে সালিশি ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সেখানে সালিশ তত্ত্বাবধান, সালিশকারদের প্রশিক্ষণ ও সালিশের আপিল শুনানির জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি-এডিআর আদালতের বিচারকের এখতিয়ার ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করার সুপারিশ রয়েছে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অর্থায়ন
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় কর রাজস্ব সংগ্রহের অধিকারী হবে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন। জেলা ও উপজেলা পরিষদ যথাযথ নিয়মে ফি, নিজস্ব সম্পত্তির আয় পাবে এবং সরকারি অর্থ সহায়তায় তাদের কার্যনির্বাহ করবে।
স্থানীয় সরকারের বর্তমান অর্থায়ন ব্যবস্থায় অস্বচ্ছতা ও নানা বৈষম্য এবং তদবির নির্ভর দুর্নীতি আছে বলে তুলে ধরেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
এসব দূর করতে কর রাজস্ব, সরকারি অনুদান বা হস্তান্তর, প্রকল্পভিত্তিক অর্থায়ন ও উন্নয়ন সহায়তা নীতির আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
স্থায়ী স্থানীয় সরকার কমিশন
অবিলম্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক মর্যাদাসম্পন্ন স্থায়ী স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত সব ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়নে এই কমিশন দীর্ঘমেয়াদে সরকারকে আইন, বিধি, নিয়মকানুন ধারাবাহিক ও আইনগতভাবে তৈরিতে সহায়তা করতে পারবে।
স্থানীয় সরকার সার্ভিস কাঠামো
ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ পর্যায়ে দুই ধরনের জনবলের পৃথক দুটি কাঠামো নিয়ে স্থানীয় সরকার সার্ভিস কাঠামো গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশন বলেছে, প্রতিটি স্তরে প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারি, তাদের কার্যক্রম এবং সকল সরকারি অর্থসম্পদ প্রেষণকালীন সময়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকবে।
তাদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, পুরষ্কার ও তিরস্কার সংশ্লিষ্ট বিভাগের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী হবে। কিন্তু তাদের সমস্ত কার্যাদি স্থানীয় পরিষদের নিদের্শনায় পরিচালিত হবে।
এর আগে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ সংস্কার ও দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি।
ছয় কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে এই কমিশন।
এর মধ্যে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক দফা বৈঠক সেরেছেন ইউনূস।
আগের খবর-
৬ সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ
বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখার সুপারিশ কমিশনের
প্রশাসন সংস্কার: সচিবালয়ে এসইএস, উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব নিয়োগ
ক্ষমতার অপব্যবহার কমিয়ে দুদক শক্তিশালী করতে ৪৭ সুপারিশ
পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ চায় সংস্কার কমিশন
৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন
সংবিধান সংস্কার: প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ২ বারের সুপারিশ, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন যেভাবে
চার কমিশনের প্রতিবেদন: রাষ্ট্র সংস্কার কোন পথে?
৬ সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ ৮ ফেব্রুয়ারি: আসিফ নজরুল
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে ভোটের সময়: প্রেস সচিব