Published : 08 Jun 2025, 12:36 AM
দাম বৃদ্ধির সরকারি ঘোষণা মাথায় রেখে এবার কোরবানির গরুর ২৪০টি চামড়া কেনেন ঢাকার কোণাপাড়ার রুবেল। কিন্তু পোস্তায় আড়তদারদের দাম শুনে হতভম্ব এই মৌসুমি ব্যবসায়ী।
রুবেল শনিবার রাত ৮টার দিকে পোস্তায় বলছিলেন, “গতবছরের চেয়ে বাড়িয়ে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু গতবার যেই চামড়া ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার তার দাম আড়তদাররা ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দিতে চাচ্ছেন। মনে হচ্ছে সিন্ডিকেটের হাতে পড়ে গেছি।”
পরে রাত সাড়ে ১১টায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় গরুর ফ্রেশ চামড়া ৭০০ টাকা করে বেচছি। আর অল্প ফুটো বা টিউমার আক্রান্ত গরুর চামড়া ১৪০ টাকা দর পেয়েছি।
“ধারণা করছি, ২৪০ চামড়ায় পরিবহন ও লেবার খরচসহ ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লোকসান হল। কষ্টে টাকার হিসাবও করিনি।”
বাংলাদেশে সারা বছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার মোটামুটি অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। কোরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে।
পাইকাররা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দান হিসেবে পাওয়া গরুর ১৬টি চামড়া বিক্রি করতে সন্ধ্যায় পোস্তায় এসেছিলেন লালবাগের শহীদনগরের তালিমুল কোরআন মাদ্রাসার শিক্ষক ফয়সাল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “সরকার নির্ধারিত দরে প্রতিটি চামড়ার দাম ১৫০০ থেকে ২০০০ হওয়া উচিত। কিন্তু আড়তদাররা এভারেজে সবগুলোর দাম বলছে ৪০০ টাকা। একজন ৬০০ টাকা বলেছে, তাকেই দেব ভাবছি।”
চলতি বছরের কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের যে দাম সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে; তাতে গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৫ টাকা বেড়েছে, ছাগলের চামড়ার দাম বেড়েছে ২ টাকা।
ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় কিনবেন; গত বছর এই দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।
আর ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫৫ টাকা ৬০ টাকা গতবছর যা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ছিল।
আড়তদারদের কাছ থেকে লবণযুক্ত চামড়া বর্গ ফুট হিসেবে কেনেন ট্যানাররা। আর আড়তদার ও ফড়িয়ারা চামড়া কেনেন গড়পড়তা আকার ধরে।
বিকালে ডেমরা থেকে ৪০টি চামড়া নিয়ে আসা আবু হানিফ বলছিলেন, “যেই চামড়া ৬৫০, ৭০০ বা ৮০০ টাকার বেশি দিয়ে কেনা চামড়া, এখানে ৭০০ টাকা দর বলছে। ট্রাক ভাড়া ও লেবার খরচটা লস হবে, সঙ্গে সারাদিনের খাটনি তো আছেই।”
সময় গড়ালে দর আরও কমবে বলে আশঙ্কা তার।
আড়তদার ও ফড়িয়ারা গড়পড়তা আকার ধরে চামড়া কিনলেও ট্যানাররা লবণযুক্ত চামড়া কেনেন বর্গফুট হিসেবে। মাঝারি আকারের গরুতে ২০ থেকে ২৫ বর্গফুট চামড়া হয়।
পোস্তায় কাঁচা চামড়া কিনে সেগুলোতে লবণ মিশিয়ে বিক্রি করা হবে ট্যানারিতে। আর সেই প্রক্রিয়া সারতে লবণ ও শ্রমিকের খরচ গুণতে হয় আড়তদারকে। তাই বলে আড়তের দাম অর্ধেক হয় কী করে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিলেন না ফড়িয়া হানিফ।
ডেমরার এই বাসিন্দা বলেন, “দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের গুণ দিয়ে প্রতি বর্গফুট হিসাব করা হলেও পোস্তায় আড়তদাররা শুধু দৈর্ঘ্য মেপে চামড়ার দাম দিচ্ছেন। সে হিসাবে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম পড়ছে ৩০-৩৫ টাকা।”
তবে আড়তদারদের কেউ কেউ সরকারি দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চামড়া কেনার দাবি করলেন।
নবাব ম্যানশনের অংশীদার আব্দুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চামড়ার ওপর দাম দিচ্ছি। ৭০০ থেকে ১০০০ টাকায় চামড়া কিনছি। লবণ দেওয়ার খরচ বাদে সরকারি দর দেওয়া হচ্ছে।”
তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়। তবে ছিদ্র থাকলে তার দর নেমে আসছে ৫০-১০০ টাকায়। আর বড় গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আড়তদার আব্দুস সালাম খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে কিনছি। আর ছোট গরুর চামড়া কিনছি ২০০ টাকা, আর মাঝারি গরুর চামড়া কিনছি ৩৫০-৪০০ টাকা দরে।”
সরকার লবণযুক্ত চামড়ার যে দর ঠিক করে দিয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে কেন কাঁচা চামড়া কেনা হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমাদের থেকে চামড়া কিনবে ট্যানারি; তারা যেরকম রেট দেবে, সেভাবেই আমাদের কিনতে হবে।
“সরকার নির্ধারিত দরে আমাদের কাছ থেকে (ট্যানারি) চামড়া কিনুক, আমরা সেভাবেই দাম দেব।”
পোস্তার বাসিন্দা মুহম্মদ আনাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার একটু কম বাজার। সরকার তো উদ্যোগ নিয়েছিল, তাহলে সেই উদ্যোগ কাজে আসল না কেন বুঝতেছি না।”
পোস্তায় চামড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির তরফে শৃঙ্খলার দায়িত্বে আছেন আলিফ। পাশাপাশি তিনি চামড়াও কিনছেন।
আলিফ বললেন, “বিগত ৩-৪ বছরের তুলনায় এ বছর দাম কম। আগে যেভাবে খোলামেলা বেচাকেনা হইতো, এখন সেরকম হচ্ছে না। সিন্ডিকেটের মতো একটা আবহ দেখা যাচ্ছে।”
এবার পোস্তায় চামড়া কম আসছে বলে ভাষ্য নবাব ম্যানশনের অংশীদার আব্দুর রহমান।
তার ভাষ্য, “বেশিরভাগ আড়ত সাভারের হেমায়েতপুরে চলে যাওয়ায় চামড়ার বাজারও ভাগ হয়ে গেছে।”
এতিমখানা ও মাদ্রাসাগুলো যেন যথাযথ সংরক্ষণের মাধ্যমে কোরবানির চামড়ার ‘উপযুক্ত মূল্য’ পায়, সে লক্ষ্যে সারা দেশে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ বিতরণ করছে সরকার; সঙ্গে কাঁচা ও ‘ওয়েট ব্লু’ চামড়া রপ্তানির সুযোগও দিয়েছে। এজন্য অনেকে আড়তে বিক্রি না করে নিজেরাই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করছে বলে মনে করছেন অনেক আড়তদার।
এবার ৭৬ কেজির লবণের বস্তা ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন পোস্তার লবণের আড়ত মদিনা সল্টের স্বত্বাধিকারী জামিল আহমেদ। তার দাবি, কক্সবাজার থেকেই ৯০০ টাকা বস্তায় লবণ কিনেছেন তিনি।
জামিল বলেন, “আড়তগুলো পর্যাপ্ত লবণ মজুদ করেছে। তারপরও রাতের দিকে যদি টান পড়ে, হয়তো ৮-১০ বস্তা করে লবণ নেবে।”
আলাপচারিতায় জামিল জানালেন, একসময় চামড়া কেনাবেচা করলেও এখন কেবল লবণের কারবার করেন।
তার ভাষ্য, “অনেক ট্যানারি আগের বছরের অর্ধেক টাকা দিয়েছে। এখন তারা চামড়া কিনছেন না। তাই এবার চামড়া কিনছি না।
“চামড়ার ব্যবসা নেশার মত। কিছু লাভের আশায় চামড়া কিনলেও দিন শেষে দেখা যায়, লাখ দুই টাকা লস। তাই এবার চামড়া কিনিনি।”