Published : 04 Jun 2025, 08:50 AM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য চীনে পাড়ি দিয়েছিলেন তাহেরা তমা। সেখানেই তার ব্যবসা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দাদাবাংলা নেচারাল ফাইবার’ নামের একটি কোম্পানি। যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি নিজে এখন চীনে রয়েছেন, দেশে তার কোম্পানি ভালোভাবেই চলছে।
রংপুর ও নরসিংদীতে তমা গড়ে তুলেছেন দুটি হ্যান্ডমেইড ও মেশিনভিত্তিক কারখানা– যেখানে পাট দিয়ে তৈরি হয় নানা পণ্য। এসব পণ্যের একটি বড় অংশ রপ্তানি হয় বিদেশে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছের ফুসফুস প্রক্রিয়াজাত করে তিনি চীন ও কানাডার ল্যাবরেটরিতে রপ্তানি করছেন, যা সেখানে গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়।
ব্যবসা শুরুর সময় সরকারি কোনো সহায়তা পেয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে তমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসএমই খাতে কাজ করব বলে মেম্বারশিপ নিই, তা-ও নিজের খোঁজেই। আসলে তেমন কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি। ঋণের সুযোগও ছিল না, তাই ঘুরে ঘুরে নিজেই নিজের অর্থ জোগাড় করেছি।”
অথচ নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেছে বলে দাবি করা হয়। সেজন্য ২০০৭ সালে সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে, যা বর্তমানে এসএমই নীতিমালা-২০১৯ ও জাতীয় শিল্পনীতি-২০২২ অনুসারে কাজ করছে।
তবে এর কার্যক্রম এখনও সীমিত। বাজেট সীমাবদ্ধতা, মানবসম্পদ ঘাটতি এবং আইনি কাঠামোর অভাব এ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসএমই ফাউন্ডেশনের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ২০ কোটি টাকা, যা দেশের বিরাট এসএমই খাতের তুলনায় অতি নগণ্য।
তমা বলছিলেন, “এসএমই ফাউন্ডেশনের বাজেট সীমিত আমরা জানি। তবে সেই সীমিত বাজেটও যাদের প্রয়োজন বেশিরভাগ সময় তারা পান না। ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, কম্বোডিয়া ও লাওসে ব্যবসার অভিজ্ঞতা আছে আমার। আমি দেখেছি ওই সব দেশে ঋণের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বা স্বজনপ্রীতির দৌরাত্ম্য নেই।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “একজন রপ্তানিকারক ও উদ্যোক্তা হিসেবে এসএমই ফাউন্ডেশন বা অন্য কোনো সংস্থা থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা আমি পাচ্ছি না। বরং অল্প যে অর্থ বরাদ্দ আছে, সেটাও ঠিকভাবে বিতরণ হচ্ছে না।’’
ঝামেলার ভয়ে কথাও বলতে চান না উদ্যোক্তারা
ছোটখাট ব্যবসা শুরু করতে চাইলে পরিস্থিতি এখন কেমন– এ প্রশ্ন করার পর অটোমোবাইল খাতের একজন উদ্যোক্তা প্রথমে কথাই বলতে চাইলেন না। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন।
তিনি বললেন, “আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল, আমাদের দেশে উদ্যোক্তা পর্যায়ে কিছু মৌলিক ঘাটতি আছে, যা অনেকাংশে আমাদের জাতিগত মানসিকতা বা প্রবণতার সঙ্গে জড়িত। যেমন, আমি পাকিস্তানের উদাহরণ দিচ্ছি—ওখানে অনেক পণ্য তৈরি হয় এবং তা বিক্রিও হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয় না। আমাদের দেশে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের পর বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।”
নাম না প্রকাশের শর্ত দেওয়ার কারণ হিসেবে এই উদ্যোক্তা বলছিলেন, “এমনিতে যে খুব একটা সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছি, তা নয়। তবে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার অপরাধে সহযোগিতা তো দূরের কথা, ঝামেলায় পড়তে পারি।”
তিনি বলেন, “উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকান—দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ইসরায়েল—ওখানে বড় বড় কোম্পানিগুলো নতুন নতুন খাত চিহ্নিত করে সেখানে বিনিয়োগ করে, সহযোগিতা করে, এমনকি ‘নার্সিং’ করে। ওরা নতুন উদ্যোগগুলোকে দাঁড় করাতে সাহায্য করে।
“কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো চিত্র। এখানে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোটদের সাহায্য করা তো দূরের কথা, বরং অনেক ক্ষেত্রে বড় মাছ যেমন ছোট মাছ গিলে খায়, সেই রকম ছোট উদ্যোক্তাদের গিলে খাচ্ছে। তাছাড়া, আমাদের দেশের ইম্পোর্টাররা বিদেশ থেকে সস্তা ‘ডাম্পিং প্রোডাক্ট’ এনে বাজার সয়লাব করে ফেলেছে—বিশেষ করে চীনের পণ্য। চায়না তো ম্যাস প্রোডাকশনে অভ্যস্ত—কম খরচে অনেক পণ্য তৈরি করে।”
এই ব্যবসায়ী বললেন, তার নিজের তো তিক্ত অভিজ্ঞতা আছেই, আরো অনেক উদ্যোক্তাকে তিনি চেনেন, যাদের একই রকম বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
“আমাদের এখানে ‘ক্রেডিট সিস্টেম’ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ধরুন, কেউ ৫ লাখ টাকার পণ্য নিল, পরিশোধ করল ৪ লাখ, এরপর আবার ৭ লাখ টাকার পণ্য নিল, কিন্তু দিল ৫ লাখ—এইভাবে একসময় দেখা যায় মূলধনের প্রায় সবটুকুই আটকে গেছে বড়দের কাছে। এতে ছোট উদ্যোক্তারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”
আর্থিক সহায়তা না পেলেও প্রশিক্ষণ কাজে লাগে
শাবাব লেদারের উদ্যোক্তা মাকসুদা খাতুন বললেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং যোগাযোগের মাধ্যমেই তিনি ব্যবসা প্রসারের সুযোগ পেয়েছেন।
“আমি এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং করেছি। এদের সহায়তায় আমি আগামী ১৭ জুন চায়না ফেয়ারে যাচ্ছি। ফাউন্ডেশন প্রতিবছর আমাদের মত উদ্যোক্তাদের নিয়ে এসব এক্সিবিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। এতে আমাদের প্রোডাক্ট প্রদর্শন করা যায়, বিক্রিও হয়—একটা মার্কেট তৈরি হয়।
“ব্যবসায়িক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যেমন স্কিল ডেভেলপমেন্ট, কাগজপত্র প্রস্তুতকরণ, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া—এসব বিষয়েও তারা প্রশিক্ষণ দেয় এবং প্রয়োজনীয় লিঙ্কেজ তৈরি করে দেয়।”
উদাহরণ দিয়ে মাকসুদা বলেন, কীভাবে ছোট আকারে উৎপাদন শুরু করে ধাপে ধাপে তা উন্নত করা যায়—এসব বিষয়ে তিনি একটি জাপানি পদ্ধতির প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে, যা তার লেদার প্রোডাকশনে কাজে লেগেছে।
“আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম একটি দুর্ঘটনার কারণে হঠাৎ করেই—এক ধরনের পরিস্থিতির চাপ থেকে, জীবনে টিকে থাকার জন্য। কিন্তু শুরু করলেই তো হয় না, কীভাবে পথ চলতে হবে, কোন প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তাদের সহায়তা করে—সেই সন্ধানে আমি এসএমই ফাউন্ডেশনের কাছে যাই। তখন থেকেই আমার ব্যবসার যাবতীয় কাগজপত্র থেকে শুরু করে, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সহায়তা ফাউন্ডেশন থেকে পেয়েছি।
“যদিও এসএমই ফাউন্ডেশন সরাসরি আমাকে কোনো ঋণ দেয়নি, তবে তাদের সহায়তায় আমি প্রাইম ব্যাংক এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিতে পেরেছি। এই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল এসএমই ফাউন্ডেশনই।"
এসএমই খাত– ‘অবহেলিত সম্ভাবনা’
দেশে ক্ষুত্র ও মাঝারি উদ্যোগ বা এসএমই খাতের সম্ভাবনা নিয়ে গত দুই দশক ধরেই নানা ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতা ও নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে সাফল্যের গল্প খুবই সীমিত।
২০২৪ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, দেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৭.৯৫ শতাংশ, যার মধ্যে এসএমই খাত প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখছে।
এর আগের বছরের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে কুটির শিল্পসহ প্রায় ৭৮ লাখ এসএমই প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ২.৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত।
২০১৯ সালে এসএমই ফাইন্যান্স নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, উন্নত বিশ্ব তো বটেই, বাংলাদেশের কাছের দেশগুলোতে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান অনেক বেশি। যেমন, ভিয়েতনাম ৪০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৫২ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ায় ৫৮ শতাংশ।
অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ইউরোপীয় দেশগুলোতে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান গড়ে ৫৫ শতাংশ। চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় জিডিপিতে ৬০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখছেন এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও এই হার ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসএমই খাতে আরও প্রসারের সুযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এই খাত যতটা এগিয়েছে, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে হলে আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন।
“প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, পণ্যে বৈচিত্র্য আসছে, গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে—এসব বিষয়ের সঙ্গে অনেক এসএমই উদ্যোক্তা এখনও পরিচিত নন বা তাদের সেই সক্ষমতাও নেই। ফলে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। অনেক সময় বড় কোম্পানি বা আমদানি করা পণ্য তাদের বাজার দখল করে নিচ্ছে। তাই এসএমই খাতের জন্য নতুন ইনোভেশনকে উৎসাহ দেওয়া, ইনকিউবেশন সাপোর্ট দেওয়া, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচিত করা অত্যন্ত জরুরি।”
পিছিয়ে থাকার মূলে কী
উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসএমই খাতের মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থায়নের সংকট, নীতি বাস্তবায়নে বাজেট অনুপস্থিতি, প্রযুক্তিগত ও দক্ষতার সীমাবদ্ধতা, রপ্তানিতে সহায়তার অভাব এবং আইনগত কাঠামোর ঘাটতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ব্যাংক ঋণের মাত্র ১৯ শতাংশ এসএমই খাতে গেছে। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, পরিস্থিতি আরো বেশি কঠিন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের করা এক পলিসি ব্রিফ প্রতিবেদনে উদ্যোক্তাদের ৭০ শতাংশ বলেছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, বিশেষ করে জামানতজনিত বাধার কারণে। এছাড়া এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ না থাকায় অনেক লক্ষ্যই বাস্তবে রূপ পায়নি।
এসএমই খাতকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে হলে একাধিক খাতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে উঠে এসেছে এসএমই ফাউন্ডেশনের পলিসি ব্রিফে।
সেখানে বলা হয়েছে, এসএমই নীতিমালা ২০২৫ বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে পৃথকভাবে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সহজ শর্তে জামানতবিহীন মাইক্রো-ফাইন্যান্স চালু করে ১০ লাখ টাকার নিচের ঋণে সরকারকে ২-৩ শতাংশ সুদ-ভর্তুকি দিতে পারে।
তৃতীয়ত, ব্যাংকগুলোর এসএমই ঋণের জন্য কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কোটা নির্ধারণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। কর নীতিতে এসএমইদের জন্য পৃথক ও সহজ কর কাঠামো প্রবর্তন, যেমন অগ্রাধিকারমূলক কর ব্যবস্থা এবং জাতীয় শিল্পনীতিতে উল্লিখিত সংজ্ঞা অনুসারে কর সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি রাশেদুল করিম মুন্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দেশের এসএমই খাতের একটি বড় অংশ এখনও ‘ইনফর্মাল চ্যানেলে’ রয়েছে। অনেক মাইক্রো ও কটেজ উদ্যোক্তা এখনো মূলধারার ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত। অথচ ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডের মত দেশগুলো এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তায় ‘এসএমই ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের এখানেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার।
তিনি বলেন, যারা এনজিও বা ইনফর্মাল উৎস থেকে অর্থায়ন পায়, তাদের প্রবৃদ্ধি কম হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে চিহ্নিত করে সমন্বিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগিয়েছে—যেখানে গবেষণা, পণ্যের উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও দক্ষতার উন্নয়ন, মার্কেট লিংকেজ এবং ফাইন্যান্স—সবকিছুকে সমন্বয় করে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে সেই সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
“এসএমই ফাউন্ডেশন মূলত এই জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তারা অর্থনৈতিক সহায়তার দিক থেকে খুব সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, ফাউন্ডেশনকে ২০০ কোটি টাকার একটি স্থায়ী ফান্ড দেওয়া হয়েছে—এটা থেকে ব্যাংক ইন্টারেস্টের আয় দিয়েই তাদের প্রোগ্রাম চালাতে হয়। কোভিড পরবর্তী সময়ে আরও ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটাও ‘রিভলভিং ফান্ড’ হিসেবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেওয়া হয়। অথচ প্রয়োজন ছিল ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার মত একটি বড় তহবিল, যাতে বৃহৎ পরিসরে কাজ করা যায়।”
মুন্না বলেন, “এসএমই খাতের অনেক উৎপাদক কাঁচামাল কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করেন। আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা তাদের কঠিন হয়ে যায়। যেমন, জুতা বা ব্যাগের মত পণ্যের কাঁচামাল দেশে ট্যাক্স দিয়ে কিনে উৎপাদন করলে সেটার খরচ বেড়ে যায়, যেখানে একই পণ্য চীন থেকে কম দামে আমদানি হয়। এখানে সরকারের ট্যাক্স নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা ছিল, সেটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
“আরেকটা বিষয় হল—আমরা অনেক সময় শুধুই অনুসরণকারী হয়ে কাজ করি, নিজস্ব কোনো ইনস্টিটিউশনাল ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলি না। বিদেশে বহু দেশে ‘সাপোর্ট সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ গড়ে তোলা হয়েছে—যেখানে ফ্যাক্টরিগুলো কী ধরনের সাপোর্ট পাবে, সেটা ঠিক করা থাকে। আমাদের দেশেও এর প্রয়োজন। গার্মেন্টস সেক্টর এখনো মূলত বেসিক ও সস্তা পণ্য তৈরি করছে, অথচ সেই একই মডেল যদি লেদার, জুট বা প্লাস্টিক খাতে প্রয়োগ করা যেত, তাহলে বৈচিত্র্য ও মান বাড়ানো যেত “
এ জায়গায় গবেষণা, প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা সহায়ক নীতিমালা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাজেট এক বছরের জন্য হলেও, শিল্প উন্নয়নের জন্য ৫ বছরের একটি নিরবচ্ছিন্ন পলিসি দরকার। সরকার যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ বছরের ইনসেনটিভ ঘোষণা দিতে পারে, তাহলে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য কেন নয়?”
প্রসারের সুযোগ কোথায়
এসএমই ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তবে এই ভূমিকা আরও বিস্তৃত ও কার্যকর করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, “যেহেতু তারা সরকারের একটি নির্দিষ্ট বরাদ্দের ওপর নির্ভরশীল এবং বছরে একবার অর্থ পায়, তাই আলাদা করে ইনকিউবেশন ও গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রমের জন্য বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন। ঋণ সহায়তা তো অবশ্যই প্রয়োজন, তবে সেটা মূলত তাদের চলমান বা অপারেশনাল কাজের জন্য। ইনকিউবেশন, গবেষণা বা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সাধারণ ঋণ যথেষ্ট নয়; এসবের জন্য ভিন্ন ধরনের অর্থায়ন বা ফাইনান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্ট দরকার হয়।”
তিনি বলেন, “এসএমই ফাউন্ডেশন চাইলে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, পরামর্শ ও গবেষণার ভিত্তিতে এমন একটি ফাইনান্সিয়াল প্যাকেজ ডিজাইন করতে পারে, যা সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও ব্যাংকগুলো থেকেও সহায়তা পাওয়ার পথ তৈরি করবে।”
এসএমই খাতের উন্নতির জন্য আরও বেশি কাজ করতে হবে বলে মনে করেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই এ খাতে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। যেমন আমরা বলি— ‘শিক্ষা যেমন জাতির মেরুদণ্ড’, তেমনি ‘এসএমই খাত হল দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড’।”
বর্তমানে দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদানের একটি বড় অংশই যে এসএমই খাত থেকে আসে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে আনোয়ার বলেন, “এ থেকেই বোঝা যায় খাতটির গুরুত্ব কতটা। বর্তমানে দেশে ১ কোটি ১৮ লাখ এসএমই প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩ কোটি ৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। শিল্প খাতের মধ্যে ৯৮ শতাংশই এসএমই, মাত্র ২ শতাংশ বৃহৎ শিল্প।
“এই খাতকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে—স্কিল ডেভেলপমেন্ট, ফাইন্যান্সে সহজ প্রবেশাধিকার, বাজার সংযোগ, প্রযুক্তি গ্রহণ—এই প্রতিটি বিষয়েই কাজ করতে হবে। অন্য অনেক দেশ, যাদের আপনি উল্লেখ করেছেন, সেখানে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসাথে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের দেশেও উদ্যোগ আছে, তবে এখনো তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।”
জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত নয় এসএমই খাত
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ভাষ্য, উন্নয়নের মূল চালিকা হিসেবে কাজ করছে এসএমই খাত। অথচ এই খাতটি জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না করায় বরাদ্দ পাওয়া যায় না। এটি বড় একটি সীমাবদ্ধতা।
“২০০৭ সালে যখন এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সরকার থেকে প্রথমে ২০০ কোটি টাকা সিড মানি দেওয়া হয়েছিল। পরে ২০২০ সালে কোভিডকালীন স্টিমুলাস প্যাকেজ হিসেবে আরও ৩০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই সীমিত অর্থে সারাদেশে সেবা দেওয়া কঠিন। সবচেয়ে বড় বিষয় হল—এসএমই ফাউন্ডেশনকে জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে বাৎসরিক বাজেট বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।
“এই খাতের উন্নয়নে আমাদের আরও অর্থ, পরিকল্পনা ও নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের পণ্যের বাজার তৈরি করে দিতে হবে, বিশেষ করে মার্কেট লিঙ্কেজ নিশ্চিত করতে হবে।”
বিদেশে অনেক ইনকিউবেশন হাব আছে, তারা এআই ব্যবহার করছে; বাংলাদেশের এসএমই খাত এসব বিষয়ে কী ভাবছে?
আনোয়ার চৌধুরী বলেন, “এখন আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আছি—‘ফোর আই’ সেন্ট্রিক টেকনোলজি, যার মধ্যে অন্যতম হল এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই প্রযুক্তি এখন প্রোডাকশন, মার্কেটিং, এমনকি ফাইনান্সিয়াল সিস্টেম—সবখানেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
“এসএমই খাতকে টেকসই করতে হলে, এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের এসব নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষম করে তুলতে হবে। নইলে বড় শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব হবে না। আমরা এ বিষয়ে সচেতন। ইতোমধ্যে আমরা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করেছি। নতুন প্রযুক্তি যাতে সহজে গ্রহণ করতে পারে, সেই অনুযায়ী উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা তৈরি করছি।”