Published : 19 May 2025, 06:33 PM
চুয়ান্ন বছরের ‘জঞ্জাল’ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে দূর করা সম্ভব না বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
তবে পাঁচ-দশ বছরে কী করা উচিত, তার একটি পথনকশা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিযেছেন তিনি।
সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
চট্টগ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় নেই জানিয়ে এক সাংবাদিক মতামত জানতে চাইলে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুরী বলেন, “আমি আপনার সাথে একমত। আমরা যেভাবে স্ট্রাকচারগুলো করেছি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর- শিল্পকলা একাডেমি, আর্কিওলজি মিউজিয়াম এমনকি মন্ত্রণালয় নিজে- স্ট্রাকচারগুলো কিন্তু এই আধুনিক সময়ের চাহিদা মেটানোর জন্য তৈরি করা হয় নাই।
“আমরা যে অল্প কদিনের সরকার, আমাদের পক্ষে এটা রিস্ট্রাকচারিং করা খুব কঠিন কাজ। এটার জন্য ইলেকটেড গভর্নমেন্ট লাগবে। পাঁচ বছরের টার্মেও পারবে কিনা জানি না। পরপর দুই মেয়াদে যদি একই সরকার থাকে, তারা যদি বোঝে যে দেশের জন্য এটা ভালো, সেটা আমার কনটিনিউ করা উচিত, তাহলে সেই চেঞ্জ আসবে।”
চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট এখনো চালু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “এটা নির্মাণাধীন। শেষ হবার পরে বুঝতে পারব কখন খুলে দেওয়া যাবে। আমাদের সকল মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন দর্শন হলো- দালান বানাও। দালানের ভিতর কী হবে, আর খবর নাই।
“শিল্পকলা একাডেমির বহু জায়গায় এমন অনেক অডিটোরিয়াম আছে যেখানে ৫০ জন লোকও যায় না। মাসে পাঁচবারও ব্যবহার করা হয় না। সেখানে মাসে কয়েকটা প্রোগ্রামও হয় না। আমাদের কারিকুলাম নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।”
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “যে জঞ্জাল গত ৫৪ বছরে জমেছে, আমাদের এই অল্প দিনে তা দূর করা সম্ভব না। তবে আমরা অনেকগুলো কাজ করছি। একটা ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করছি যে আগামী ৫ বছরে কী করা উচিত, ১০ বছরে কী করা উচিত।
“আমরা যাবার আগে একটা প্রেস কনফারেন্স করব ‘রোড টু সাকসেসর’। আমাদের পরবর্তী পর্যায়ে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, আমার উপলব্ধি আমি নোট আকারে দিয়ে যাব। উনি যদি ফিল করেন এখান থেকে উনার নেওয়ার মত কিছু আছে, তাহলে উনি নিবেন এবং আশা করি দেশের কাজে লাগাবেন।”
ফিরছে ‘নতুন কুড়ি’
শিশুদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে কি না এমন প্রশ্নে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “এখন বললেই বলা হবে যে, গত ১৫ বছরের কথা বলা হচ্ছে। এতদিন আমরা শুধুমাত্র পাসের হার বাড়িয়েছি, আমরা শুধু দেখেছি কতজন জিপিএ ৫ পায়।
“যখন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলি, টের পাই, আমাদের শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ফাউন্ডেশন ভয়াবহভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এটা ঠিক করার জন্য সময় লাগবে। কাজ শুরু করতে হবে।”
তিনি বলেন, “শিক্ষা উপদেষ্টা এবং তথ্য উপদেষ্টার সাথে কয়েকবার আলোচনা করেছি। তাদের সঙ্গে ‘নতুন কুড়ি’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এক সময় নতুন কুড়ি ক্রেজ তৈরি করেছিল। এটা চালু হলে একটা প্রভাব পড়বে।
“আর স্কুলের কারিকুলাম একটা মেজর জিনিস। আমরা তো অল্প কদিনের সরকার। নির্বাচিত সরকার আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে টোটালি তাকানোর সময় অঅসবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটার কাজ কী এবং আমরা ইউনিভার্সিটি থেকে কী প্রডিউস করতে চাই, এটা মাথায় রেখে পুরো ব্যবস্থা নতুন ডিজাইন করার সময় চলে এসেছে।”
জিয়া স্মৃতি জাদুঘর হবে ‘পূর্ণাঙ্গ মিউজিয়াম’
চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর ঘিরে পরিকল্পনা জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “জিয়া স্মৃতি জাদুঘর গত ১৬ বছর প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। মন্ত্রণালয়ে তিন মাস আগে এক সভায় এর বাজেট বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছে। আজ পরিদর্শন করেছি। শুধু বরাদ্দ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ না। এটা পূর্ণাঙ্গ মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রপার কিউরেটর।
“শুধু চট্টগ্রাম পর্ব না জিয়াউর রহমানের পুরো জীবন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনায় উনি কী কী করেছেন সবগুলো জিনিসই আসার কথা। কিউরেশন টিম আমরা তৈরি করছি। পাশাপাশি তাদের সহযোগিতার জন্য একটা রিসার্চ টিম করব। তারপর রেনোভেশন করা হবে। এটার কাজ আমাদের মেয়াদেই শুরু করা হবে।”
অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জাহিদুল কবির কচি বলেন, “পুরাতন সার্কিট হাউজের (জিয়া স্মৃতি জাদুঘর) সামনের মাঠে পার্ক উচ্ছেদ করে এখন হাসপাতাল করা হবে বলে শুনছি। চট্টগ্রামের মানুষ ইতিমধ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছে। অবিলম্বে এটা বন্ধ করেন।”
জবাবে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “আমি ডিসি সাহেবের কাছ থেকে এটা জানলাম। এটা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অবগত আছেন। আমি এটা নিয়ে ঠিক জায়গায় যেন আলোচনার একটা রাস্তা শুরু হয়, সেটা বলব। ডিসি সাহেব জানালেন যে, এটার সামনে যে গ্রিন এরিয়াটা আছে এটাকে শিশুপার্ক করে পুরোটা একটা কম্পাউন্ডের মধ্যে (জিয়া স্মৃতি জাদুঘরসহ) এই প্রস্তাবটাও আমি ঢাকায় গিয়ে আলোচনা করব।”
জুলাই স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “আমরা জুলাই স্মৃতি জাদুঘরের একটি কেন্দ্রীয় কাজ করছি। সেখানে চট্টগ্রামও রিফ্লেকটেড হবে। আস্তে আস্তে বিভাগীয় শহরেও কাজগুলো যাবে।”
বলী খেলা ও সাম্পান বাইচ আয়োজনে মন্ত্রণালয়
উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “আমরা অল্প কয়কদিনের সরকার। আমাদের মূল কাজ হলো বড় স্কেলে কিছু কাজ করা সাংস্কৃতিক প্যারাডাইম শিফটের ক্ষেত্রে। আপনারা দেখতে পেয়েছেন এবারের নববর্ষ স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে বড় এবং ইনক্লুসিভ উৎসব হয়েছে।
“মূল কাজ সংস্কৃতিটা যেন বাংলাদেশের সবার সংস্কৃতি হয়ে উঠে। এর একটা বড় দিক হচ্ছে উৎসব। উৎসব একটা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক এক্সপ্রেশন হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটা বড় উৎসব জব্বারের বলী খেলা। চট্টগ্রামের নাম বললেই এই ছবিটা ভাসে। আরেকটা হলো সাম্পান বাইচ। গত ১৯ বছর ধরে চলছে। চট্টগ্রাম কল্পনা করা খুব কঠিন সাম্পান ছাড়া।”
তিনি বলেন, “উৎসব শুধু উৎসব না, যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে লিংকআপ করতে পারি। এরকম জিনিসগুলোর একটা তালিকা আপাতত শিল্পকলা একাডেমিকে করতে বলেছি। তালিকা হলে তা ন্যাশনাল ক্যালেন্ডারে যুক্ত হবে।
“স্থানীয় পর্যায়ে যারা এগুলো করেন তারা কারো সহযোগিতার জন্য বসে থাকেন না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। জব্বারের বলী খেলা যারা আয়োজন করেন তাদের সাথে গতরাতে সভা হয়েছে। আগামী বছর থেকে এই আয়োজনের সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও যুক্ত হবে। বাংলাদেশের কালচারাল হেরিটেজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ক্যালেন্ডারে যুক্ত হবে। সাম্পান বাইচের সাথেও আমরা যুক্ত হব।”
সারাদেশের এ ধরণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা ও সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এ কাজগুলো আমরা করে দিয়ে যাব। পরে যারা সরকার পরিচালনায় আসবেন তারা কনটিনিউ করবেন বলে বিশ্বাস।”
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, জব্বারের বলী খেলা ও সাম্পান বাইচের আয়োজকরা উপস্থিত ছিলেন।