Published : 23 Nov 2024, 09:29 PM
সরকার পতনের পর ‘পদত্যাগে বাধ্য’ করার দুই মাস পর ‘হৃদরোগে’ মারা গেছেন চট্টগ্রামের বেসরকারি হাজের-তজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুব।
শনিবার চট্টগ্রামের বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়েছে বলে তার ভাগ্নে টিপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
শিক্ষক আইয়ুবের বয়স হয়েছিল ৫৯। তার বাড়ি বাঁশখালীতে।
রসায়নের শিক্ষক আইয়ুব হাজেরা-হজু ডিগ্রি কলেজের আগের গর্ভনিং বডিতে শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মাঝেও তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন বলে সহকর্মীরা জানিয়েছেন।
তার মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের অনেকে ফেইসবুকে পোস্ট করে তাকে পদত্যাগ করানোর ঘটনায় আবারও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কারও দাবি, জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়ার পর থেকে তিনি ‘মানসিক চাপে ছিলেন’।
সেদিন যা ঘটেছিল
কলেজটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, গণ আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে ‘একদল লোক’ হাজেরা-হজু ডিগ্রি কলেজে অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেন কিছু শিক্ষার্থীও। সেদিন তারা উপাধ্যক্ষ আইয়ুবের পদত্যাগ ও আরও তিন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের বরখাস্তের দাবি তোলেন।
একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়েন উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুব। এরপর ‘আন্দোলনকারীদের লেখা’ একটি পদত্যাগপত্রে তার আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হয়। সেদিন কলেজটির অধ্যক্ষ চয়ন দাশকেও অবরুদ্ধ ও মারধর করা হলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। পরে তাকে দিয়ে অন্য তিনজন শিক্ষকের বরখাস্ত আদেশেও জোর করে সাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি খবরে আসে।
সেদিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাতকারে উপাধ্যক্ষ আইয়ুব বলেছিলেন, “আমি তো প্রিন্সিপাল না। আমার তো এখানে (কলেজে) কিছু করার পাওয়ারও নাই। বললাম যে, বাবা আমার তো করার এখানে কিছু নাই। না, তারা মানবে না। বাই ফোর্স…। আমি সাইন না করলে তারা আমাকে হত্যা করবে।”
ঘটনার দিন অধ্যক্ষ চয়ন দাশ সাংবাদিকদের বলেন, “যার শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছে, তারা সবাই বহিরাগত। জোর করে বরখাস্ত বা পদত্যাগের আদেশে সাক্ষর নিলেও তারা বহিরাগত।”
‘যাননি কলেজে, ছিলেন মানসিক চাপে’
২৪ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনার পর আর কলেজে যাননি অধ্যক্ষ চয়ন দাশ ও উপাধ্যক্ষ আইয়ুব।
শিক্ষক আইয়ুবের ভাগনে টিপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই ঘটনার পর থেকে মামা আর কলেজে যাননি। আমি সবসময় উনার সঙ্গে থাকি। সেদিনের ঘটনার পর থেকে তিনি মানসিক টেনশনে ছিলেন। তবে আমাদেরকে সেসব নিয়ে কিছু বলতেন না। সহকর্মীদের হয়ত বলে থাকতে পারেন।”
শনিবার সকালে শিক্ষক আইয়ুবের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা বলেন, উনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, উনার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। এক ঘণ্টা পর ডাক্তার বলেন, তিনি মারা গেছেন।”
হাসপাতাল থেকে আইয়ুবের মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তোলার একটি ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়েছে, যেখানে তার স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা গেছে। ওই ভিডিও অনেকে ফেইসবুকে শেয়ার করেন।
হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন দাশ শনিবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৪ সেপ্টেম্বর উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগ ও তিনজন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে বাধ্য করা হয়। আইয়ুব স্যার আমাদের কলেজের উপাধ্যক্ষ। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও মেধাবী শিক্ষক হিসেবে পুরো চট্টগ্রামে পরিচিত।
“ওই ঘটনার পর তিনি আর কলেজে আসেননি। ৮/১০ দিন আগে বাসা থেকে একটি রিজাইন লেটার তিনি কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি বরাবরে পাঠান। কিন্তু গভর্নিং বডির সভা না হওয়ায় সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ঘটনার পর থেকে তিনি মানসিক চাপে ছিলেন।”
মৃত্যুর আগে সকালে শিক্ষক আইয়ুবের কাছে তার কয়েকজন ছাত্র পড়তেও যান বলে অধ্যক্ষ চয়ন দাশ জানান।
তার ভাষ্য, “পড়ানোর সময় তিনি বলেন, ‘শরীর খারাপ লাগছে’। এরপর ওই ছাত্ররা চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর বেশি খারাপ লাগায় তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে উনাকে লাইফসাপোর্টে রাখা হয়। এক ঘণ্টা পর তিনি মারা যান।”
শিক্ষক আইয়ুবকে পদত্যাগের ঘটনার দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “২৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনার সময় আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বক্ষব্যাধি ও ডায়বেটিসের ডাক্তার দেখিয়েছি। অসুস্থ থাকায় আমি আর কলেজে যেতে পারিনি।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর একটি সরকারি কলেজের এক শিক্ষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিন দিন আগে আইয়ুব স্যারের সাথে কথা হয়। উনার চাকরির নির্ধারিত বয়স আর মাত্র আট মাস পর শেষ হওয়ার কথা। তিনি বলছিলেন, ‘মান সম্মান নিয়ে হয়ত আর বেঁচে থাকতে পারব না’। উনি মানসিকভাবে খুব চাপে ছিলেন।”
শিক্ষক আইয়ুবের মৃত্যুর পর তার প্রথম জানাজা হয়েছে নগরীর মৌলভীপুকুর পাড়ে।
এরপর মরদেহ বাঁশখালীর কাথারিয়ায় নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও স্কুলের মাঠে রোববার দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে দাফনের কথা রয়েছে বলে জানান ভাগনে টিপু।
হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজটি ১৯৯১ সালে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম বিএসসির পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।
সরকার পতনের পর কলেজটির আগের পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়; নতুন গভর্নিং বডি গঠন নিয়েও কলেজে জটিলতা চলছে।