Published : 30 May 2025, 10:54 PM
হালদা তীরে দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ডিম সংগ্রহ শেষে খুশি সংগ্রহকারীরা। প্রাথমিক হিসেবে এবার সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কেজি।
শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে ডিম সংগ্রহের এই হিসেব জানায় মৎস্য বিভাগ।
রাউজানের জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হালদা পাড়ের মানুষ খুব খুশি। গত বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি ডিম মিলেছে। সব তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করে প্রাথমিক হিসাবে প্রাপ্ত ডিমের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কেজি। প্রায় ২৫০টি নৌকা ও সাড়ে ৫০০ ডিম সংগ্রহকারীর প্রচেষ্টায় সফলভাবে ডিম সংগ্রহ কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে।
“দাপ্তরিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সব তথ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে। সেখান থেকে চূড়ান্ত তথ্য পরবর্তীতে ঘোষণা করা হবে।”
মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ পুলিশ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে ডিম সংগ্রহের তথ্য সংগ্রহ করে।
এর আগে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে মা মাছ।
রাত দেড়টার পর থেকে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডিম সংগ্রহ শুরু হয়।
হালদা নদীর মদুনাঘাটের কাছে ছায়ার চর, রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতার গোনা, আজিমের ঘাট, মাচুয়া গোনা, কাগতিয়া, আইডিএফ হ্যাচারি, সিপাহী ঘাট, নোয়াহাট, কেরামতালির বাক এবং অঙ্কুরিগোনা সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চলে ডিম সংগ্রহের উৎসব।
হালদার বর্ষীয়ান ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত দেড়টার দিকে নদীতে ডিম ছাড়ে মা মাছ। এর আগে অমাবস্যা তিথি ছেড়ে গিয়েছিল। কাল বেশি বৃষ্টি ছিল রাতে। সাথে ছিল বজ্রপাত। পাহাড়ি ঢল নামায় মা মাছ ডিম ছেড়ে দেয়।
“আমার ১০টা নৌকা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল। প্রায় ৩০ বালতি ডিম পেয়েছি। ডিম সংগ্রহের পর এখন নিজস্ব হ্যাচারিতে এনে রাখা হয়েছে। আল্লাহ চায় তো ভালো রেণু পোনা হবে বলে আশা করছি।”
হালদা যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, সেই কালুরঘাট সেতুর কাছের অংশ থেকে উজানে মদুনাঘাট হয়ে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে নদীর দুই তীরে হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি এই তিন উপজেলা।
মদুনাঘাট থেকে সমিতির হাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে হাটহাজারি ও রাউজান উপজেলা সংলগ্ন অংশেই মেলে নিষিক্ত ডিম। এই অংশেই মা মাছের আনাগোনা বেশি।
হালদায় ডিম সংগ্রহকারীদের আনন্দ এবার বাড়ার কারণ হলো, ২০২৪ সালে হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়েনি। গত বছর কয়েক দফায় নমুনা ডিম ছেড়েছিল কার্প জাতীয় মাছ। তাতে মোট ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৮৬ কেজি। তার আগে ২০২৩ সালে ডিম সংগ্রহ হয় ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি।
হালদার ডিম সংগ্রহকারী রওশনঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার ভালো ডিম পেয়েছি সবাই। প্রতি নৌকায় ৩ থেকে ৫ বালতি পর্যন্ত ডিম মিলেছে। হালদা পাড়ের মানুষ খুশি। সারা বছর এই একটা দিনের অপেক্ষায় থাকি আমরা।”
হালদায় মা মাছের ছাড়া ডিম থেকে উৎপাদিত পোনা মাছ থেকে বেশ ভালো মানের মাছ পাওয়া যায় বলে দেশব্যাপী এই পোনার চাহিদা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাছ চাষীরা এই পোনা সংগ্রহ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হালদা নদীর দুই পাড়ে উৎসবের আমেজ চলছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে গত রাতে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছেড়েছে।
“নদীপাড়ের প্রায় ৫৫০ জন ডিম সংগ্রহকারী প্রায় ২৫০টি নৌকা নিয়ে উৎসব সহকারে ডিম সংগ্রহ করেছে। এবছর প্রায় ১৪ হাজার কেজি ডিম সংগৃহীত হয়েছে।”
নৌকা প্রতি গড়ে ৫ থেকে ৬ বালতি ডিম মিলেছে জানিয়ে অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “এখন নদীর পাড়ে স্থাপিত সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারি এবং ট্রেডিশনাল মাটির কুয়াগুলোতে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিমের পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন।
“আমি মনে করি আজকের ডিম প্রাপ্তি হালদা নদী রক্ষায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনার একটি ফসল।”
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে সরকার সাতটি বিভাগের আটটি নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে হালদা নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হালদা বাংলাদেশের একমাত্র নদী, যেখানে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যেই দূষণমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি।
“ভূজপুর রাবার ডেম নিয়ন্ত্রণ, মানিকছড়ির তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, পোল্ট্রি বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ এবং কাটাখালি, কৃষ্ণখালি এবং খন্দকিয়া খালের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শতভাগ দূষণমুক্ত করা সম্ভব হবে। বর্তমানের সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকলে প্রতিবছরেই হালদা নদীর ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।”
২০২২ সালে হালদা নদী থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি এবং ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম পেয়েছিলেন সংগ্রহকারীরা।
২০২০ সালে হালদা থেকে সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছিল জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, যা ছিল ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম পাওয়া যায়।
২০১৯ সালে প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম মিলেছিল। এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ১৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ডিম মেলে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে ২৮০০ কেজি; ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ২০০ কেজি এবং ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৪০ কেজি ডিম মিলেছিল হালদায়।
হালদা নদীতে বছরের এরকম সময়ে (এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন পর্যন্ত) বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ।
নদীতে রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাউশ মাছের ছাড়া সেই নিষিক্ত ডিম বিশেষ ধরনের জাল দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। পরে হ্যাচারিতে তা থেকে রেণু পোনার জন্ম হয়।
চলতি মৌসুমে ইতিমধ্যে নদীতে মা মাছের আনাগোনা বাড়তে থাকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল ছিল না নদীতে।
তাই গত দুই মাস নদীতে নৌকা নিয়ে মাছের ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় ছিলেন হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা।