Published : 08 Jun 2025, 07:19 PM
চট্টগ্রাম নগরীর পাড়া-মহল্লা থেকে সংগ্রহ করা কোরবানির চামড়া বেচতে না পেরে পথে বসেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তাদের ফেলে যাওয়া চামড়া যেমন সড়কে পচেছে, তেমনই শ্রমিক সংকটে লবণ না মেশাতে পেরে অনেক চামড়া নষ্ট হয়েছে আড়তে।
নগরীর আতুড়ার ডিপো, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদের চৌমুহুনী এবং অক্সিজেনের নয়াহাট এলাকার সড়কে এসব চামড়া পড়ে ছিল। রোববার সকাল থেকে এসব নষ্ট চামড়া সরানোর কাজ শুরু করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে প্রত্যাশিত দামে বিক্রি করতে পারেননি। তাই সড়কে ফেলে চলে গেছেন।
আবার আড়াতদারদের অনেকেই দাবি করেছেন, তারা চামড়া কিনলেও শ্রমিকের অভাবে লবণ দিতে পারেননি। এ কারণে তাদের অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।
এদিকে দুপুরে নগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে সড়ক থেকে ট্রাকে করে চামড়া সড়ানোর কাজ করতে দেখা গেছে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের। এসব চামড়া গরমে নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল।
সেখানে দায়িত্বরত নগর সংস্থার পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বোরহানুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখান থেকে কয়েক হাজার চামড়া সরানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করতে এসে না পেরে সেগুলো সড়কে রেখে চলে গেছেন।
তিনি বেলা ২টার দিকে বলছিলেন, সকাল ১০টা থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ওই এলাকায় চামড়া সরানোর কাজ করছেন। চার ঘণ্টায় সেখান থেকে চারটি বড় ট্রাক ও আটটি ছোট গাড়িতে করে চামড়া সরানো হয়েছে।
বহদ্দারহাট মোড়ের পান দোকানি মো. আমিন জানান, শনিবার দুপুর থেকে বহদ্দারহাট মোড়ে আদা কিলোমিটার জুড়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে বসেছিলেন। বিকালে অনেকেই কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে চামড়া ছাড়েনি। পরে আর কোনো ক্রেতাই আসেনি।
বাধ্য হয়ে রাতে তারা এসব চামড়া সড়কে রেখে চলে গেছেন বলে জানান তিনি।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, গতবছর যা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ছিল।
কোরবানির মৌসুমে ফড়িয়াদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে সেগুলোতে লবণ মিশিয়ে সংরক্ষণ করেন আড়তদাররা। এরপর তারা চামড়া বেচেন ট্যানারিতে। লবণযুক্ত চামড়ার তুলনায় কাঁচা চামড়ার দরে এবার যে পার্থক্য দেখা গেছে, তাতে পথে বসেছেন ফড়িয়ারা।
বিক্রি করতে না পেরে আগ্রাবাদের চৌমুহুনী মোড়েও চামড়া ফেলে চলে যান অনেক ফড়িয়া।
চৌমুহনী এলাকার মাংস ব্যবসায়ী মো. আলম সওদাগর তিন দশকের বেশি সময় ধরে কোরবানির চামড়ার মৌসুমি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আলম বলেন, রাতে অনেকেই চামড়া বিক্রি করতে না পেরে এবং ক্ষোভ থেকে চামড়া সড়কে ফেলে চলে গেছেন।
“আমি যেসব চামড়া কিনেছিলাম সেগুলো আড়তদারদের কাছে বিক্রি করলেও লাভ হয়নি। আবার তরুণ বয়সী অনেকেই চামড়ার ব্যবসায় নেমেছিল। তারা ৬০০/৭০০ টাকা দরে কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে চামড়া কিনেছিলেন। পরে আড়তদাররা সেগুলো ১০০/১৫০ টাকা দর করেছিলেন। তাদের অনেকেই সেগুলো ফেলে দিয়ে চলে গেছেন।”
আড়তদারদের কাছ থেকে লবণযুক্ত চামড়া বর্গফুট হিসেবে কেনেন ট্যানাররা। আর আড়তদার ও ফড়িয়ারা চামড়া কেনেন গড়পড়তা আকার ধরে।
চৌমুহুনীর ফড়িয়া নাছির জানান, তিনি ৩৫০ থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দরে চামড়া কিনেছিলেন। পরে সেগুলো গড়ে ৩৮০ টাকা দরে বিক্রি করে দিয়েছেন।
এতে লোকসান হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকেই দামের জন্য বিক্রি না করে চামড়া ধরে রেখেছিলেন। পরে সেগুলো আর বিক্রি করতে না পেরে সড়কে ফেলে গেছেন।”
কেবল চৌমুহুনী এলাকায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার চামড়া সড়কে নষ্ট হয়েছে বলে ভাষ্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।
আতুরার ডিপোতে করুণ দশা
চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার আড়তগুলোর অবস্থান নগরীর বিবিরহাট আতুরার ডিপো এলাকায়। আড়তদার তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহ করে সেখানে নিয়ে আসেন। আবার অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী সরাসরি আতুড়ার ডিপো এলাকায় চামড়া নিয়ে আসেন আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে।
সেই আতুড়ার ডিপো এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক জুড়ে দুই পাশে চামড়া পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের দুই পাশে কোথাও লবণ দিয়ে পলিথিন ঢাকনা দিয়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে চামড়া।
আবার কোথাও কোথাও এলোমেলো ভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নষ্ট হওয়া চামড়াগুলো সড়ক থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য, অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী সেখানে বিকাল থেকে চামড়া নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু আড়তদারদের সঙ্গে দরদামে না মেলায় রাতে অনেকেই সেসব চামড়া ফেলে চলে গেছেন। আবার অনেক আড়তদার চামড়া কিনলেও সেগুলো শ্রমিকের অভাবে সংরক্ষণ করতে না পেরে নষ্ট হয়ে গেছে সড়কেই।
আবদুল খালেক নামে এক চামড়া ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি নিয়মিত আড়তে চামড়া বিক্রি করেন। ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা থাকায় এবার তিনি একটি গুদাম ভাড়া নিয়েছিলেন চামড়া সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু চামড়া কিনলেও শ্রমিক সংকটের কারণে তার সব চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।
খালেক বলেন, এক মাসের জন্য ৪০ হাজার টাকায় গুদাম ভাড়া নিয়েছিলেন এবং এক লাখ টাকার লবণ কিনেছিলেন চামড়া সংগ্রহের জন্য।
“বিভিন্ন দামে এক হাজার চামড়া সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু সেগুলোতে লবণ দিয়ে গুদামে সংরক্ষণ করার মত কোনো শ্রমিক আমি পাইনি; যার কারণে রাতে সবগুলো চামড়া নষ্ট হতে শুরু করে।”
রোববার দুপুরে বিবিরহাট এলাকায় ভাড়া গুদামের কাছে দাঁড়িয়ে তিনি চামড়া সরাতে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অনুরোধ করছিলেন।
খালেক বলেন, “যেসব চামড়া কিনেছি, শ্রমিকের অভাবে একটা চামড়াও আর রাখতে পারিনি। সব চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।”
কুতুব উদ্দিন নামের এক আড়তদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার টার্গেট ছিল দুই হাজার চামড়া সংগ্রহের। সে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহের জন্য শ্রমিকও ঠিক করেছিলাম। অনেকেই চামড়া নিয়ে এখানে এসেছিলেন। কিন্তু তারা দর ধরে রাখায় আমরা চামড়াগুলো কিনতে পারিনি।”
রাতে তাদের চামড়া কিনতে বাধ্য করা হয়েছিল অভিযোগ করে কুতুব বলেন, “আমি অতিরিক্ত আরও এক হাজার ৪০০ চামড়া কিনেছিলাম। কিন্তু শ্রমিকের অভাবে সেগুলোতে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে পারিনি; যার কারণে সব চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, শ্রমিকরা তাদের নির্ধারিত চামড়ায় লবণ দেওয়ার পর আর কাজ করতে রাজি হয়নি। অনেকেই কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
রোববার দুপুরে আতুড়ার ডিপো এলাকায় পরিচ্ছন্নতার তদারকিতে থাকা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আবু জাহেদ সিদ্দিকী বলেন, “আমরা একটা পরিকল্পনা করেছিলাম, উপজেলা থেকে চামড়া যেন শহরে নিয়ে আসা না হয়। কিন্তু অনেকেই আতুড়ার ডিপোতে চামড়া নিয়ে এসেছিলেন।
“কিন্তু তাদের চাহিদামতো দাম না পেয়ে সেগুলো বিক্রি না করে সড়কে ফেলে চলে গেছেন।”
এতে এবার অনেক চামড়া সড়কে নষ্ট হয়ে বর্জ্যে পরিণত হয়েছে বলে জানান তিনি।
এর আগে ২০১৯ সালে একই অবস্থা হয়েছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে সড়কে চামড়া ফেলে বিক্ষোভ করেছিলেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন আহমদ চৌধুরী রোববার বলেন, “দুপুর পর্যন্ত আমরা বেশ কয়েক হাজার চামড়া সড়ক থেকে সরিয়ে নিয়েছি। এখন আবার অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে- আরও চামড়া সরাতে।
“পরিস্থিতি দেখে ধারণা করছি, প্রায় ২০ হাজারের মত ফেলে যাওয়া চামড়া অপসারণ করতে হবে। এটা আমাদের জন্য অতিরিক্ত লোড। তার পরও শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে যা করার তা করা হবে।”
বিপুল সংখ্যক চামড়া এভাবে সড়কে ফেলে যাওয়া এ শিল্পের জন্য ক্ষতিকর হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে সারা বছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার মোটামুটি অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। কোরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে।
পাইকাররা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।