Published : 02 Feb 2025, 09:50 PM
মোংলা বন্দরের সুবিধা বাড়াতে একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। প্রকল্পটি চীন সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ের তাগিদে’ অনুমোদন করার বিষয়টি তুলে ধরে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন, এটি ভূ-রাজনীতির দিকে থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’।
রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এই প্রকল্পসহ ১৩টি প্রকল্প অনুমোদনের তথ্য দিয়ে উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “একটি প্রকল্প আমাদের না, কিন্তু এটাই সবচেয়ে (রোববারের) বড় প্রকল্প।
“… যেই বড় প্রকল্পটা সেটা হল, এটা মেগা প্রকল্প আমি বলব না, কিন্তু স্ট্রাটেজিক্যালি খুব, মানে ভৌগলিক দিক থেকে, আর কী দিক থেকে, মানে জিওপলিটিক্স এর দিক থেকে ইম্পরট্যান্ট।”
‘মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ নামের চার বছর মেয়াদী এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা; যার মধ্যে চীনের অর্থায়ন ৩ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। বাকি অর্থায়ন করবে সরকার।
প্রকল্পটির মেয়াদের সময় ধরা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ-এনইসি সম্মেলন কক্ষে চলতি অর্থবছরের সপ্তম একনেক বৈঠককটি হয়েছে। সেখানে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারপারসন মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠক শেষে বিফ্রিংয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “মোংলা বন্দর ভবিষ্যতের একটা হাব, একটা আঞ্চলিক হাব হিসেবে যাতে হয়; এখানে যা আসা যাওয়া করে ফ্রেইট, সেটা সক্ষমতার তুলনায় বরং বেশিই করে। এবং এটাকে ভবিষ্যতে আরও বড় হতে হলে এটার কন্টেইনার ফ্যাসিলিটিজ লাগবে।”
তিনি বলেন, “এটা খুব বড় প্রকল্প না কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এটা বোধহয়, কতদিনে… ২৫ সাল থেকে শুরু করলে, আমরা শুরু করতে যাচ্ছি, ২৬, ২৭, ২৮, তিন বছর বলা হচ্ছে।
“কন্টেইনার ফ্যাসিলিটিজ এতদিন ছিল না, জায়গা অধিগ্রহণের খুব বেশি দরকার হবে না, আগের জায়গাই আছে যেখানে বিগ প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে এবং যেসব যন্ত্রপাতি লাগে ওগুলো করা হবে।”
এ প্রকল্প এ সরকারের নয় দাবি করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “বেশ আগে থেকে অনুমোদিত প্রকল্প ছিল এবং আমরা অনেকদিন ধরে বিবেচনা করেছি নানা দিক। একটা হল, এটা চীনের ঋণে।
“প্রথমত আমরা ঋণ নির্ভর প্রকল্প বেশি নিতে চাচ্ছিলাম না কিন্তু এটাকে আমাদের মনে হয়েছে, শেষ পর্যন্ত এটাকে লাগবেই। মোংলা বন্দর বড় হতে হলে কন্টেইনার ছাড়া তো চলবে না। এবং এটা চীনের প্রকল্প এবং আগে থেকেই করা প্রকল্প।
“যেহেতু চীনের প্রকল্পগুলো বড় প্রকল্প। এটা মেগা না, আগেই বলেছি, ৩০০, সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলার, এই ধরনের। স্থানীয় অর্থায়ন কিছু আছে, তবে পুরোটাই চীনের ঋণ। মেগা প্রকল্প হতে গেলে তো ২, ৩ বিলিয়ন ডলার লাগে। এটা সেই হিসেবে মেগা প্রকল্প না।”
ভূ-রাজনীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিবেচনায়, এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, “মানে এই জায়গাটা খুব জিওপলিটিক্যালি ইম্পরট্যান্ট। এটার প্রকল্পের যে প্রস্তাব, সেখানে বলা আছে যে, এটা এই অঞ্চলে এত ভালো কন্টেইনার… ভুটান, ভারত, নেপাল, ওই দিককার, চট্টগ্রামের সক্ষমতার তো একটা লিমিট আছে, মাতারবাড়িতে হবে।
“কিন্তু মোংলার ক্যাচমেন্ট তো পুরো বাংলাদেশের ওই পার্টটা, এর সাথে নেপাল, ভুটান ও পশ্চিমবঙ্গের কথাও বলা আছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বন্দরের সক্ষমতাও খুব বেশি না।”
এই প্রকল্প অন্তর্বর্তী সরকার পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “এটা কিছুদিন ধরে রেখে পর্যালোচনা করেছি, দুই কারণে। একটা হল, চীনের যে প্রতিষ্ঠান, সেটাকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়েছে কিনা। সেখানে দেখলাম যে এটা বাংলাদেশ সরকারের কিছু করার ছিল না।
“যেহেতু সরকার টু সরকার, জিটুজি বলে। সে কারণে এটা চীনের সরকারই, আসলে চীনের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের থেকেই এটাকে তারা গুরুত্ব দিয়ে আসছেন এবং চীনের সরকারই, চীনের দিক থেকেই কোম্পানিকে বাছাই করা হয়। কাজেই এখানে আমাদের দিক থেকে টেন্ডার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। ওরা নিজেরাই নিজেদের কোম্পানি ঠিক করে।”
চীন বাংলাদেশের ঠিকাদারও নিয়োগ করে দেবে এমন ইঙ্গিত ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “কিন্তু আমাদের দিক থেকে পার্টনার কে হবে সেখানেই তো সমস্যা। কারণ, এখানে যে কম্পোনেন্ট থাকে সেটার পার্টনার থাকতে হয়। সেখানে আমরা চিন্তিত ছিলাম। কারণ অনেক প্রকল্পে, পায়রা বন্দর… এরকম কিছু প্রকল্প আছে যেসব প্রকল্পে দেশীয় যারা ঠিকাদার তারা কিন্তু রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেছিল। এরকম উদাহরণ আছে।
“কাজেই সে কারণে দেখছিলাম, দেশীয় ঠিকাদার নিয়োগ ঠিক আছে কিনা। চীনের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আলোচনা হয়েছে, আমার সাথে কিছুটা হয়েছে, এবং তারা বলেছে যে ঠিকাদার আমাদের মত করে আমরা ঠিক করে দিতে পারব। সেখানে যাতে দুর্নীতি না হয় সেরকম ব্যবস্থা করব।”
আগামী সপ্তাহ থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি সংশোধনের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে বলে তিনি তুলে ধরেন।
উন্নয়ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণের নির্ভরতা কাটিয়ে রাজস্ব আহরণে জোর দেওয়ার কথা সরকার ভাবছে বলেও পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন।
আরও যেসব প্রকল্পের অনুমোদন
এদিন একনেক সভায় যে ১৩টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে ১২ হাজার ৫৩২ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৪ হাজার ৯৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ ৭ হাজার ৩২৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ১ হাজার ১০৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
মোংলা বন্দরের প্রকল্প ছাড়াও রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর কাট্টলী ক্যাচমেন্ট স্যানিটেশন’ প্রকল্প; কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুটি- ‘ধান, গম ও ভুট্টার উন্নততর বীজ উৎপাদন এবং উন্নয়ন প্রকল্প (তৃতীয় পর্যায়)’ প্রকল্প এবং ‘বিএডিসি’র বিদ্যমান বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিতরণ ব্যবস্থাদির আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্প।
আছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ফুড সেইফটি টেস্টিং ক্যাপাসিটি ডেভলপমেন্ট’ প্রকল্প; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি প্রকল্প ‘তিতাস ও কামতা ফিল্ডে চারটি মূল্যায়ন-কাম-উন্নয়ন কূপ খনন’ প্রকল্প, ‘হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও মেঘনা ফিল্ডে ত্রিমাত্রিক সাইসমিক জরিপ’ প্রকল্প, ‘সিলেট-১২ নম্বর কূপ খনন (তেল কূপ)’ প্রকল্প, ‘ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং (তৃতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্প এবং ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় উন্নয়ন, চট্টগ্রাম জোন (দ্বিতীয় পর্যায়) (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্প।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ‘স্ট্রেনদেন্ড সার্ভিস ডেলিভারি সিস্টেমস ফর ইম্প্রুভড মাইগ্রেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবল রিইনটেগরেশন’ প্রকল্প; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ (প্রথম সংশোধিত প্রকল্প এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) (প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্প।
এ ছাড়া, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ এবং অপসারণ ব্যবস্থাপনা (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পের চতুর্থ বার মেয়াদ বৃদ্ধি প্রস্তাব সভায় পাস করা হয়।