Published : 11 Jun 2025, 04:01 PM
বাংলা সিনেমা কয়েক দশক এগিয়েছে কেবল ধনী গরিবের প্রেমের বৈষম্য আর লটারি জিতে হিরোর ধনী হওয়ার গল্প দেখিয়ে। তাতে আরো ছিল নায়ক-খলনায়কের দ্বৈরথ, মারপিট, ফুলের বাগান আর সাগর তীরে নায়ক-নায়িকার নাচ। গল্পের সেই ছক ভাঙতে শুরু করেছে বাংলা চলচ্চিত্র। বদলের পালায় ‘তাণ্ডব’ দিয়ে বাণিজ্যিক সিনেমায় রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সুপারস্টার শাকিব খান।
সেই চেষ্টায় শাকিবের সঙ্গে থেকেছেন আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, সিয়াম আহমেদ, আফরান নিশো, জয়া আহসানের মত একঝাঁক অভিনয় শিল্পী।
তবে শেষ পর্যন্ত ‘তাণ্ডবের’ মূল নায়ক হয়ে উঠেছে গল্প, শাকিব নন। গল্পের বিস্তৃত পরিসর এ চলচ্চিত্রের বড় চমক।
শুরুতে অনেকটা ধীর গতিতে এগোনো ‘তাণ্ডব’ শেষ হয়েছে ‘তাণ্ডব’ ঘটিয়ে। আবার কিছু জায়গায় গল্প যে খেই হারায়নি, তা বলা যাবে না।
‘চ্যানেল বাংলা’ নামের একটি টেলিভিশন স্টেশনে আবহাওয়ার খবর পড়ছিলেন একজন সংবাদ পাঠক। দর্শকদের জানাচ্ছিলেন, দেশে ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা নেই। এমন সাদামাটা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েই শুরু হয় ‘তাণ্ডব’।
সেই স্টেশনে উপস্থিত হন দেশের এক মন্ত্রী (এজাজুল ইসলাম)। তাকে নিয়ে শুরু হয় লাইভ সাক্ষাৎকার পর্ব। সে সময় ভেসে আসে গোলাগুলির শব্দ।
হঠাৎ করে সেই লাইভ সম্প্রচারে মাঙ্কি মাস্ক পরা একদল মানুষ হানা দেয়। নাচের তালে তালে তাদের দলনেতা গুলি করেন মন্ত্রীকে আর জিম্মি করেন স্টেশনের অন্যদের।
পর্দায় কী হচ্ছে সেটা ভেবে প্রেক্ষাগৃহের হলভর্তি দর্শক যখন হতবাক, তখন মাস্ক খুলে শাকিব খান এন্ট্রি নেন, পুরো হল ফেটে পড়ে উচ্ছ্বাসে।
সিনেমায় শাকিবের চরিত্রের নাম স্বাধীন। তার মুখে শোনা যায়, 'চলুন নতুন করে শো শুরু করা যাক'।
এ ঘটনায় প্রশাসন নড়ে ওঠে। দেশের মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ, সোয়াট টিম দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছুটে যায় ওই টেলিভিশন স্টেশনে। স্বাধীনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি মুক্তিপণ হিসেবে কী চান।
স্বাধীন তখন বলেন, তার সামনে ভিন্ন পেশার চার ব্যক্তিকে হাজির হতে হবে। একে একে আসেন ধর্মমন্ত্রী, পুলিশের সাবেক আইজিপি, চ্যানেলের মালিক এবং সাংবাদিক। ঘটনা নতুন মোড় নিতে শুরু করে।
এভাবে ‘তাণ্ডবে’ অ্যাকশন আর থ্রিলার গল্পের মোড়ক খোলেন পরিচালক রায়হান রাফী।
লাইভ চলতে থাকে। টেলিভিশন স্টেশনকে শাকিব ঘোষণা করে ‘বন্দিশালা’ হিসেবে। নিজেকে তুলে ধরেন ‘জেলার’ পরিচয়ে।
আর সারা দেশের মানুষ সরাসরি দেখতে থাকেন স্বাধীনের কাণ্ড। বন্দি করা সেই মানুষদের বাঁচাতে অনেকটা শাহরুখ খানের বলিউডি সিনেমা 'জওয়ান' স্টাইলে সময় বেঁধে দেওয়া হয় মাত্র এক ঘণ্টা। স্বাধীনের কথা মত হাজির হন ধর্মমন্ত্রীর চরিত্রে আফজাল হোসেন, ‘বাংলা নাইনের’ কর্ণধারের চরিত্রে গাজী রাকায়েত, পুলিশের আইজিপি হয়ে আসেন শহীদুজ্জামান সেলিম এবং ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জয়া আহসান।
আর স্বাধীনকে মারতে এগিয়ে যায় সোয়াট টিম।
শুরু হয় স্বাধীনের গল্প। তবে শুরুর দিকে গল্পের একাধিক প্লট, যেমন চাকরি না পাওয়া যুবকের হতাশা-কষ্ট, স্বাধীনের সঙ্গে প্রেমিকা নিশাতের গল্প, বাবা ছেলের সম্পর্ক-সব কিছুই অনেকটা সাধারণ পরিচিত গল্পের মতই মনে হচ্ছিল।
তবে বাংলা সিনেমার চিরায়িত এই গল্পের ভেতরে স্বাধীনকে দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা মামলায় ধরে নিয়ে যাওয়া, গুম, আয়নাঘর, দুর্নীতি নিয়ে কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন রাফী।
জিম্মি দশার টানটান উত্তেজনা, অ্যাকশনের মধ্যে নিশাত চরিত্রে অভিনয় করা ছোট পর্দার অভিনেত্রী সাবিলা নূর নজর কেড়েছেন। শাকিবের বিপরীতে সাবিলার অভিনয় এবারই প্রথম, তবে দুজনের রসায়ন প্রশংসনীয়।
শাকিবের সঙ্গে সাবিলার দেখা মেলে দুটি গানে। এর মধ্যে ‘লিচুর বাগান’ গানটি হঠাৎ করেই শুরু হয়ে যায়। আগের দৃশ্যের সঙ্গে গানটির যোগাযোগ কিছুটা দুর্বল। তবে গানের লোকেশন এবং ক্যামেরার কাজে মুন্সীয়ানার ছাপ দেখা গেছে।
পর্দায় সাবিলার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি এবং আত্মহত্যা করে তার বিদায় নেওয়ার ঘটনা কিছুটা অতৃপ্তিও তৈরি করেছে।
আর শাকিব খানের বিপরীতে সোয়াট টিমকে মনে হয়েছে 'ঠুঁটো জগন্নাথ'। তাদের সঙ্গে শাকিবের গোলাগুলির দৃশ্যে নাটকীয়তা দেখা যায়নি।
শাকিবের সঙ্গে সিনেমার প্রথম অংশ অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন সাংবাদিক সায়রা চরিত্রে অভিনয় করা জয়া আহসান।
ভয়াবহ পরিস্থিতিতে টেলিভিশন স্টেশনে যখন তার ডাক পড়ে, মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেখানে যান জয়া। সায়রার ভাষায় তিনি একজন 'রিটায়ার্ড জার্নালিস্ট'।
সাহস, ভয়, দ্বিধা, অসহায়ত্বের অভিনয়ে নিজের চরিত্রটি আলাদা করে দেখিয়েছেন জয়া।
অভিনেতা আফজাল হোসেনের চরিত্র একাধারে কৌতুকপূর্ণ ও নাটকীয়। রাফী সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহৃত কিছু শব্দ আফজালের মুখে বসিয়ে দর্শক টানার চেষ্টা করেছেন।
একঘেয়েমি কাটাতে টেলিভিশনের লাইভের বাইরে রাস্তার দৃশ্যে অভিনেতা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনের বানর খেলার দৃশ্য রেখেছেন রাফী। খেলা দেখানোর সময় বানরকে উদ্দেশ্য করে অভিনেতার কয়েকটি সংলাপ ছিল সিনেমার মূল উপজীব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
টিজার-ট্রেইলারে আগেই বোঝা গিয়েছিল, শাকিব ‘তাণ্ডবে’ ধরা দিচ্ছেন নেতিবাচক চরিত্রে। একসময় কারাবন্দি অবস্থায় জেলারদের হত্যা করে অপরাধীদের নিয়ে বাইরে পালিয়ে এসে শাকিব আট বছর সময় নিয়ে গড়ে তোলেন তার দল।
নায়কের বয়ানে তার অতীত জীবন ভেসে ওঠে পর্দায়। আট বছরের ব্যবধানের দুই লুকের খুব একটা পার্থক্য দেখা যায়নি শাকিবের রূপটানে।
এসবের মাঝে অভিনেতা সিয়াম আহমেদের উপস্থিতি দর্শককে কিছুটা বিস্মিত করেছে। সমাজের প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বখে যাওয়া ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম। এক চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া সিয়ামের লুক ও অভিনয়ে চোখ আটকাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সিয়ামের দেখা মিলেছে দুবার, বিরতির আগে ও পরে। শুরুতে সিয়াম অল্প সময়ের জন্য হাজির হলেও পরে তার চরিত্রটি যে শক্তিশালী জায়গা নিতে চলেছে, তার আঁচ মিলেছিল।
বিরতির পর সিনেমায় আসে নতুন গতি। জিম্মি করে সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থদের মুখ থেকে তাদের অপকর্মের স্বীকারোক্তি আদায় করেন স্বাধীন।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে জনতার সামনে হিরো সেজে আত্মসমর্পণ করেন স্বাধীন।
সে সময় শাকিবের মুখে “আজ আমি সত্যিই স্বাধীন" সংলাপ শুনে মনে হয়, এত অল্প সময়ে গল্পের ইতি টানা হল, তাহলে নতুনত্ব কোথায়!
কিন্তু এরপর গল্পের মোড় ঘুরিয়েছেন রাফী। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা স্বাধীনের দ্বিতীয় চরিত্রটি সামনে আনেন তিনি।
সিনেমায় উচ্ছ্বাস জাগানো এন্ট্রি হয় মাসুদের। যার নাম ‘সুড়ঙ্গ মাসুদ’। 'সুড়ঙ্গ' সিনেমায় দর্শকের দেখা ব্যাংক ডাকাতির সেই টাকার হিসাব নিতে হাজির হন তিনি। এই চরিত্রে অভিনয় করেন আফরান নিশো।
বাংলা সিনেমায় একাধিক তারকা নিয়ে সিনেমা তৈরির রেওয়াজ পুরনো, কিন্তু অতিথি চরিত্রগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার নজির কম।
ভারতীয় হিন্দি বা ইংরেজি সিনেমায় অতিথি চরিত্র সাধারণত দাগ কেটে যায়। তবে ঢাকাই সিনেমায় একসঙ্গে সিয়াম ও নিশো অভিনীত দুই অতিথি চরিত্রের আগমন পরিচালক রাফীর হাত ধরে নতুন মাত্রা পেয়েছে।
‘সুড়ঙ্গ’, ‘তুফান’, আর ‘তাণ্ডব’ এই তিন সিনেমাকে রাফী যে ধীরে ধীরে একটা ইউনিভার্সের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, তার ইঙ্গিত মেলে ‘তাণ্ডবের' শেষ দৃশ্যে মাসুদের (আফরান নিশোর) প্রবেশে। পাশাপাশি ওই দৃশ্য 'তাণ্ডব ২' সিনেমার জন্য এক নতুন প্রত্যাশাও তৈরি করে।
তাণ্ডবের দ্বিতীয় পর্বের ঘোষণা দিয়ে শেষ হয় সিনেমার দৃশ্য।
বিভিন্ন চরিত্রে আরও অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, এফ এস নাঈম, সুমন আনোয়ার, তারিক আনাম খান। তাদের চরিত্রগুলো কিছুটা নীরবই মনে হয়েছে।
২ ঘণ্টা ৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমার চিত্রনাট্যকার রাফী ও আদনান আদিব খান।
গত ৭ জুন কোরবানি ঈদের দিন মুক্তি পাওয়া ‘তাণ্ডব’ চলছে দেশের ১৩২টি প্রেক্ষাগৃহে, এর মধ্যে স্টার সিনেপ্লেক্সে চলছে সর্বোচ্চ ২৮টি শো।
‘তাণ্ডব’ প্রযোজনা করেছে এসভিএফ আলফা আই এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। সহ-প্রযোজনায় আছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি। সহযোগিতা করেছে দীপ্ত টিভি।