Published : 14 Jun 2025, 01:32 PM
তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তি নির্ভরতা থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়া, দুই বছরে ইন্টারনেটে ১৬ তরুণীর ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁস, একের পর এক আত্মহত্যা এবং সেসব অনুসন্ধানে এক পুলিশ কর্মকর্তার মরিয়া ভূমিকা।
এসব অপরাধের পেছনে কোনো ব্যক্তি নাকি একটি চক্র কাজ করছে? অথবা কোনো একটি অপরাধে ভিকটিম নাকি সমাজ, কে মূলত দোষী, সেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে পরিচালক মিঠু খান বানিয়েছেন 'নীলচক্র: ব্লু সার্কেল'।
যে সিনেমায় মিশে আছে সাসপেন্স, আবেগ ও সামাজিক ব্যাধির থাবা। তবুও টিজারের আভাস অনুযায়ী যতটা রোমাঞ্চকর থ্রিলার নির্ভর সিনেমা হয়ে উঠতে পারত 'নীলচক্র’, ততটা হয়নি। এতে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্বল চিত্রনাট্য এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্যের ব্যবহার।
স্কুল পালানো দুই কিশোরের গল্প দিয়ে শুরু হয় সিনেমা। যারা মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ায়, হারমোনিকা বাজায়, আর সুযোগ পেলেই কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে সময় কাটায়। বিদেশি বন্ধু সুজির সঙ্গে ফেইসবুকে কথা বলতে পারাই তাদের জীবনের মূল আনন্দ।
কিশোরসুলভ কৌতূহল থেকেই একদিন পর্ন ভিডিওর সাইটে প্রবেশ করে দুই বন্ধু। ওই সাইটের একটি ভিডিওর জেরে ভেঙে যায় তাদের বন্ধুত্ব। যার ছায়া পড়ে পুরো সিনেমার গল্পে।
আবার সিনেমার শেষে মুখোমুখি হয় সেই দুই বন্ধু। বাংলা সিনেমার সেই চিরায়িত ঘটনা, যেন বৃত্ত পূরণ না করলে ঢাকাই সিনেমার ব্যাকরণ ভুল হবে।
মাঝে কেটে যায় কয়েক বছর। দুই বন্ধুর মধ্যে একজন ফয়সাল, যিনি পুলিশের স্পেশাল টিমে কাজ করেন। ফয়সাল চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। সিনেমায় ফয়সাল একজন বরখাস্ত হওয়া অফিসার। গ্রেপ্তারের পর অপরাধীদের মুখ থেকে কথা আদায়ের জন্য তাদের উপর চালানো অতিমাত্রায় নির্যাতনের অভিযোগে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
কিন্তু ফয়সালের পারিবারিক জীবনে তার পেশাগত জীবনের রুক্ষতা কোনো ছাপ নেই। তার স্ত্রী নেই, একমাত্র মেয়ে জুঁই আর খালাকে নিয়ে ফয়সালের সংসার। বাবা ওই শিশুকন্যার বন্ধুত্বের গল্প পুরো সিনেমা জুড়ে একটা দারুণ অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছে। জুঁইয়ের চরিত্রে শিশুশিল্পী অদিতি আহমেদও বেশ ভালো অভিনয় করেছেন।
একদিন মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে থানা থেকে হঠাৎ ডাক আসে ফয়সালের। বরখাস্ত থাকা অবস্থাতেই ভিডিও ফাঁসের জেরে তরুণীর আত্মহত্যার ঘটনা তদন্তে ভার দেওয়া হয় ফয়সালকে।
কিন্তু তদন্তে নেমে বারবার হোঁচট খেতে হয় ফয়সালকে। কারণ ঘটনার কিছুটা কিনারা করে ফয়সাল যখন সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন, তখনই নতুন করে কোনো একজন তরুণী আত্মহত্যা করে বসেন, ভিডিও ফাঁসের কারণে।
সিনেমা অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার পর তরুণীদের আত্মহত্যার রহস্য ভেদের কাহিনী খেই হারায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফয়সাল চরিত্রে আরিফিন শুভ বেশ ভালো করলেও দুই বছর পর তার পর্দায় ফেরাটা ফেরার মত হয়নি বলা যায়। সেক্ষেত্রে শুভর অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেয়ে চিত্রনাট্য তাকে কাজ করার জন্য কতটুকু জায়গা ছাড়ছে সেই প্রশ্ন আসে। চিত্রনাট্য দুর্বল হলে অভিনয় শিল্পীর কী বা করার থাকে।
ভিডিও ফাঁসের কারণে সূচনা নামের প্রথম যে তরুণী প্রথম আত্মহত্যা করেন, তার বাবার চরিত্রে আছেন ফজলুর রহমান বাবু, তিনি ‘সমীর বাবু’ নামের এক রহস্যময় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শুরু থেকেই তার আচরণ ছিল সন্দেহজনক। মিথ্যা বলা, পুলিশের নজর কাড়ার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি, সংবাদ সম্মেলন করে মেয়ে হত্যার বিচার চাওয়া, আবার সব খুনের ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতি তাকে ঘিরে আলাদা রহস্য তৈরি করে।
তবে এই চরিত্রের পরিণতি প্রত্যাশিত গভীরতা পায়নি। দর্শকের মনে চরিত্রটি নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল সেটার রহস্যভেদ আশানুরূপ চমক জাগাতে পারেনি।
সিনেমার নায়িকা মন্দিরা চক্রবর্তীর প্রবেশ অনেকটা বাস্তবধর্মী। ফয়সালের মেয়ের নাচের শিক্ষক হলেন রাইমা। মন্দিরার সঙ্গে শুভর রসায়ন জমে উঠেনি বা এই ধরনের গল্পে নায়ক নায়িকার প্রেমকে প্রাধান্য দিলে হয়ত সিনেমাটি ক্রাইম ডিটেকটিভ ঘরানার হয়ে উঠতো না।
এছাড়া গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘কাজলরেখা’ দিয়ে অভিষেক হওয়া মন্দিরার আড়ষ্টতা তার দ্বিতীয় সিনেমাতেও কাটেনি।
পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে যে ধরনের ধীরস্থির ও দায়িত্বশীল চিত্র আমাদের চোখে ভাসে, মন্দিরাকে গড়া হয়েছে সেই আদলে। তবে শান্তশিষ্ট এই চরিত্রটিকে অন্যায়ের প্রতিবাদী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলে সেটি কাহিনীকে আরও শক্তপোক্ত করত।
সিনেমায় আরেক পুলিশ অফিসার রাজা, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহেদ আলী। এই চরিত্রটিকে নির্মাতা সাদামাটাভাবে পর্দায় এনেছেন। স্পেশাল ফোর্সের সদস্য হিসেবে শাহেদ আলীকে আরেকটু চৌকস বা বুদ্ধিমান হিসেবে তুলে ধরতে পারতেন পরিচালক।
সিনেমার কিছু দৃশ্যের অস্পষ্টতা চোখে পড়ে। হঠাৎ করে সামঞ্জস্য না পেয়ে দর্শক হিসেবে কারো মনে হতেই তিনি হয়ত অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন।
অস্পষ্ট দৃশ্যগুলোর উদাহরণ টেনে বলা যায়, সূচনার খুনী সাগরকে ধরার জন্য সন্ত্রাসীদের পিছু নেন ফয়সাল। দুই পক্ষের গোলাগুলির এক পর্যায়ে কনটেইনারের ভেতরে মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় সাগরকে। যে লাশের দেখা পায় পুলিশ অফিসার রাজা। অথচ সেই লাশের খোঁজ পাওয়ার কথা ফয়সালকে রাজা জানাননি। অর্থাৎ সাগরের লাশ নিয়ে কোনো তদন্তের দৃশ্য রাখা হয়নি।
কিন্তু শুভর হঠাৎ করে ফরেনসিক বিভাগে গিয়ে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট জানতে চাওয়ার দৃশ্যে দর্শক হিসেবে প্রশ্ন জাগে, তিনি কার লাশের কথা বলছেন? কার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট? আত্মহত্যা করা তরুণী সূচনার নাকি খুনি সাগরের?
রাইসা চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়ন্তী ঊর্বী। এই চরিত্রটির মধ্যে টু টাং (টিকটক) করে তারকা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আরেক টু টাং (টিকটক) স্টারের সঙ্গে তার প্রেম এবং সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তার ভিডিও।
ভিক্টিম হিসেবে তার চরিত্রটি অর্থবহ, তবে রাইসাকে দেখে মনে হয়েছিল সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে এই মেয়েটিরও পরাজয় বা পরিণতি দেখানো হয়েছে।
সিনেমার শেষে ফয়সালের সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু রাশেদকে খুঁজে পাওয়া এবং তার সঙ্গে শুভর বন্ধুত্বসুলভ কথাবার্তা ভালো লাগা তৈরি করে। পাশাপাশি বন্ধুর পরিচয় ফাঁস হলে সেটি দর্শককে কিছুটি ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা থেকে চাঙ্গাও করে।
তবে গুহার ভিতরে তৈরি করা সিনেমার সেট চমৎকৃত করেছে।
নীলচক্র গল্পনির্ভর বাণিজ্যিক সিনেমা। যেখানে মার্ডার মিস্ট্রির পাশাপাশি এই প্রজন্মের বর্তমান পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সচেতন বার্তা দেওয়া হয়েছে। সোশাল মিডিয়ার কালো ফাঁদ, ডিজিটাল ব্ল্যাকমেইল, নৈতিক দুর্ভিক্ষ উঠে এসেছে গল্পের পরতে পরতে। এছাড়া টিকটকে ভিডিও করে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য টিকটকারদের মরিয়া হয়ে উঠা, নারী পাচার এবং ১৬ তরুণীর আত্মহত্যার নেপথ্য রহস্য উন্মোচন কীভাবে হবে তা জানতে পর্দায় চোখ আটকে থাকবে দর্শকের।
বাস্তব জীবনের অনুরণনে ‘নীলচক্র’ এমন এক সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরেছে, যেখানে ভিক্টিমই হয়ে ওঠে দোষী। ব্যক্তিগত ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে মেয়েরাই দায়ী হয়, একঘরে করা হয় তার পরিবারকে। পরিবার থেকে শুরু করে বাইরের দুনিয়াতেও ঘটনার শিকার হওয়া মেয়েদের মানসিকভাবে এতটা ক্ষতবিক্ষত করা হয়, যা মৃত্যুর নামান্তর। সেই নির্মম বাস্তবতা ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন পরিচালক।
এছাড়া চাইলেই একটি অপরাধ চক্রকে নিঃশেষ করা যায় না সেই সত্যও তুলে ধরেছেন নির্মাতা মিঠু। পাশাপাশি কোনো অপরাধে ভিকটিম, নাকি সমাজ, কে মূলত দোষী, সেই প্রশ্ন ছোড়া হয়েছে।
এছাড়া অপরাধীকে হাতে পেয়েও উপরমহলের চাপে পুলিশের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার অসহায়ত্ব তুলে ধরেছেন মিঠু খান।
তবুও সিনেমার শেষটা তুলনামূলকভাবে সরল করে উপস্থাপন করা হয়েছে। যা আরও নাটকীয় করা যেত বা টানটান মুহূর্ত তৈরির করার রসদ নির্মাতার হাতে ছিল। কিন্তু তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে দর্শক। অ্যাকশন থ্রিলার ঘরানার গল্পের এত সহজ সমাপ্তি ভালো লাগেনি।
সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা সংগীতশিল্পী বালাম দর্শকের নজর কেড়েছেন। এছাড়া আরো ভালো অভিনয় করেছেন মাসুম রেজওয়ান, পারভীন পারু, মনির আহমেদ শাকিল, নাজমা আনোয়ার।
এক ঘণ্টা ৫৩ মিনিটের সিনেমাটি মিঠু খানের সঙ্গে যৌথভাবে চিত্রনাট্য ও কাহিনী লিখেছেন নাজিম উদ দৌলা।
সিনেমায় তিনটি গান রয়েছে। অন্য সিনেমায় যেমন গানের দৃশ্য দেখা যায় নায়ক-নায়িকার কল্পনায়, এখানে তা হয়নি। দৃশ্যের মাঝেই গান ব্যবহার করা হয়েছে। একটি রাস্তা এবং স্কুটি চালানোকে ঘিরে হয়েছে পুরো একটি গানের দৃশ্যধারণ। তবে তা দেখতে মন্দ লাগেনি।
এছাড়াও সিনেমার কালার কম্বিনেশন এবং ভিজুয়ালও প্রশংসনীয়।