Published : 15 Jun 2025, 05:12 PM
‘বাবা দিবসে’ ব্যান্ডতারকা প্রয়াত শাফিন আহমেদের বাড়িতে আনন্দ, উপহার আর ভালোবাসাকে সঙ্গী করে হত ছোটখাট পারিবারিক আয়োজন, যেখানে তিনিই মধ্যমণি। বাবার মৃত্যুর পর সে সব স্মৃতিতে মনভার হয়ে আছে তার ছেলে আযরাফ রাকিন আহমেদ অজির।
অজি বলেছেন, এমন দিনে শাফিনকে একদম নিজের করে পেতেন তার সন্তানেরা।
কেবল অজি নন, প্রয়াত অভিনেতা বুলবুল আহমেদ ও খালেদ খানের সন্তানরাও ফিরে তাকিয়েছেন ফেলে আসা দিনগুলোয়। যেখানে এই দিনটি ছিল তাদের কাছে বড় একটি উৎসবের। বাবাহীন জীবনে এই দিনটি তাদের কাছে এখন কেবল স্মৃতি।
রোববার ‘বাবা দিবস’ উপলক্ষে বুলবুল আহমেদ, খালেদ খান ও শাফিন আহমেদের সন্তানেরা বাবাকে নিয়ে গল্প করেছেন গ্লিটজের কাছে।
‘বাবা দিবসে’ শূন্যতা বেড়েছে শাফিনপুত্র অজির
“এটাই আমাদের প্রথম বাবা দিবস, যেখানে বাবা নেই” এই কথাটুকু বলতেই কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে আযরাফ রাকিন আহমেদ অজির।
ব্যান্ডতারকা শাফিন আহমেদের ছেলে অজিরের জীবন গেল এক বছরে বাবাকে হারিয়ে অনেকটাই শূন্য। সেই শূন্যতার ব্যাপ্তি আরেকটু বাড়ল এই দিনে এসে।
অজি গ্লিটজকে বলেন, ‘বাবা দিবসে’ শাফিন আহমেদের কাছ থেকে আলাদা করে খানিকটা সময় পাওয়াতেই ছিল তাদের আনন্দ।
"বাবা তো সবসময় গান, শো নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতেন, আমরা তাকে খুব কম পেতাম। কিন্তু এই দিনে বাবাকে আমরা ভাই বোন মিলে শুভেচ্ছা জানাতাম। বাবাও চেষ্টা করতেন আমাদের আলাদা করে একটু সময় দিতে। কোথাও কফি খেতে হলেও নিয়ে যেতেন। বাবার সঙ্গে সময় কাটানো মানেই আমরা একসাথে বসে মনোপলি গেম খেলতাম, লুডু খেলতাম।"
বাবাকে ছাড়া গেল কয়েকটি ঈদ পার করাও অনেক কঠিন ছিল অজির কাছে।
তিনি বলেন, "ঈদ গেল তাকে খুব মিস করেছি। কোরবানির ঈদ ছিল বাবার সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, আর দুপুরের পর একসাথে বসে গেমস খেলা এই রুটিনটা ছিল বরাবর।"
প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে গিটার বাজানো প্র্যাকটিস করতেন শাফিন আহমেদ। সেই মুহূর্তটা ভীষণ মনে পড়ে অজির।
তিনি বলেন, "প্রতি রাতে গিটার নিয়ে তিনি চার থেকে পাঁচটা গান করতেন। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। ঘুমানোর আগে এই প্র্যাকটিসটা বাবার মিস হত না। আমাদের গান শুনাত, আমাকে সাথে নিয়ে গান করত।
"বাবা ফ্রি থাকলেই পারিবারিকভাবে একটা গানের আড্ডার মত হত। আমি গিটার বাজাতাম, বাবা গান গাইতেন বা আমি গাইতাম বাবা গিটার বাজাতেন।"
স্নাতক শেষ করে এখন বাবার প্রোডাকশন কোম্পানি থেকে নতুন গান নিয়ে কাজ করছেন অজি।
দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল মাইলসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শাফিন আহমেদ গত বছরের ২৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে মারা যান।
আশি-নব্বই দশকের কিশোর-তরুণ শ্রোতাদের মন মাতানো ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’, ‘জ্বালা জ্বালা জ্বালা এই অন্তরে’, ‘ফিরিয়ে দাও’ গানের এই শিল্পী কনসার্টে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেখানে হার্ট অ্যাটাক হলে শাফিনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে; কিন্তু বাঁচানো যায়নি।
বাবাহীন ‘বাবা দিবস’ কষ্টে কাটে ঐন্দ্রিলার
বাবাকে শেষবারের মত উপহার দেওয়া শার্টটা স্মৃতিতে বিরাট জায়গা নিয়ে আছে অভিনেতা বুলবুল আহমেদের মেয়ে অভিনেত্রী তাজরিন ফারহানা ঐন্দ্রিলার কাছে।
বাবা বেঁচে থাকতে ‘বাবা দিবস’ নিয়ে আগে থেকে পরিকল্পনা করতেন ঐন্দ্রিলা, আর এখন এই 'বাবা দিবস' এলে দিনটি কষ্টে কাটে এই অভিনেত্রীর।
ঐন্দ্রিলা বলেন, "বাবা দিবসের আয়োজন নিয়ে প্রস্তুতি থাকত আগে থেকেই, আব্বুকে কী গিফট দিব, কী আয়োজন করব, কী রান্না করব এসব নিয়ে। ছোট থেকে আব্বুকে পাঞ্জাবি গিফট করা হত। যখন একটু বয়স হল, অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন তখন প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট দিলে তিনি খুব খুশি হত। বিভিন্ন রংয়ের শার্ট দিতাম সেগুলো আনন্দ নিয়ে পরতেন।"
বুলবুল আহমেদের জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে কাটানো শেষ ‘বাবা দিবসের’ স্মৃতি তুলে ধরেন ঐন্দ্রিলা। বাবা সিবসের ঠিক এক মাস পরেই চলে যান বুলবুল আহমেদ।
"আব্বু মারা যাওয়ার আগে শেষ বাবা দিবসে আমি যে শার্টটা দিয়েছিলাম সেই শার্টটা আমার কাছে এখনো আছে। আব্বু মারা যাওয়ার পর আমি ওইটা নিয়ে ঘুমাতাম। বাবা দিবসে সেই শার্টটা পরে আব্বু বলেছিল 'আমি আর বাঁচব না রে মা'। তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন। তার এক মাস পরেই ১৫ জুলাই আব্বু চলে যান। আমি কখনো বুঝিনি সেটাই আমাদের শেষ বাবা দিবস। ছোটবেলায় বাবা দিবস আনন্দের ছিল। আর এখন বাবাহীন বাবা দিবস কষ্টে কাটে।"
ঐন্দ্রিলা বলছেন, বাবার সিদ্ধান্তই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
“আমার ইচ্ছা ছিল ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে পড়ার। কিন্তু আব্বু চেয়েছিলেন তিন ছেলেমেয়ে তিন ধরনের বিষয়ে পড়ুক। তাই বললেন আমি যেন কমার্স নিয়ে পড়ি। এখন বুঝি, সেটা ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত।”
পরবর্তীতে বাবার ইচ্ছাতেই তিনি ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া নিয়ে পড়াশোনা করেন। বাবার নির্মাণের অনুপ্রেরণা এসেছে তার মধ্যে।
“আব্বু চাইতেন আমি নির্মাণে আসি। এখন আমি দুইটা প্রফেশনে যুক্ত অভিনয় আর নির্মাণ তো আছেই, পাশাপাশি পড়াশোনা সাবজেক্ট অনুযায়ী মার্কেটিং নিয়ে আন্তজার্তিক কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছি।"
বুলবুল আহমেদের মেয়ে ঐন্দ্রিলা নিজেও এক সময়ে নাটকে নিয়মিত মুখ ছিলেন। পাশাপাশি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও গানও করেন তিনি।
‘রূপনগর’, ‘মোহর আলী’, ‘জীবন কাহিনী’, ‘শেষ থেকে শুরু’, ‘অভিমানে অনুভবে’, ‘সাংসারিক ভালোবাসা’সহ বেশ কয়েকটি নাটক তিনি অভিনয় করেছেন ঐন্দ্রিলা। তবে এখন অভিনয়ে ঐন্দ্রিলার দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে।
১৯৫৮ সালে মঞ্চনাটক দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু বুলবুল আহমেদের। আবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘পূর্বাভাস’ নাটক দিয়ে টেলিভিশনে তার অভিষেক হয় ১৯৬৮ সালে।
‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘ইডিয়ট’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’, ‘তুমি রবে নীরবে’, ‘টাকায় কি না হয়’, ‘মালঞ্চ’, ‘হৈমন্তী’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘সারাদিন বৃষ্টি’, ‘রূপনগর’, ‘সারাবেলা’সহ তিন শতাধিক নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন বুলবুল আহমেদ।
জহির রায়হানের উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’তে অভিনয় করে নজরে আসেন তিনি। ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’তে তার অভিনয়ের প্রশংসা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারত পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের নাটকে ব্যস্ততার জন্য এর মধ্যে ১০ বছরের ব্যাংকিং পেশা ছেড়ে অভিনয়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন তিনি।
বুলবুল আহমেদ সিনেমায় নাম লেখান ১৯৭৩ সালে, আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের (ইউসুফ জহির) ‘ইয়ে করে বিয়ে’ সিনেমার মাধ্যমে। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘মোহনা’, ‘মহানায়ক’, ‘ওয়াদা’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দেবদাস’, ‘ভালো মানুষ’, ‘বদনাম’, ‘দুই জীবন’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ ইত্যাদি। এর মধ্যে পরিচাক চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'দেবদাস' সিনেমায় দারুণ খ্যাতি কুড়ান বুবলবুল আহমেদ।
২০১০ সালের ১৫ জুলাই মারা যান এই অভিনেতা।
খালেদ খানকে নিয়ে স্মৃতিচারণে মেয়ে জয়িতা
মঞ্চ ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেতা খালেদ খান চলে গেছেন এক যুগ হল। আগে প্রতি বছর ‘বাবা দিবসে’ তাকে ঘিরেই পরিবারিক আয়োজন থাকত বলে গ্লিটজকে জানিয়েছেন তার মেয়ে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ফারহিন খান জয়িতা।
বাবার সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলো স্মৃতিতে অম্লান জয়িতার কাছে। তার কাছে শোনা গেল, উদযাপন বিষয়টি বেশ পছন্দ করতেন খালেদ খান।
"বাবা স্পেশাল দিনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করতেন। ঈদ হোক, জন্মদিন হোক কিংবা বাবা দিবস, সবকিছুর পেছনে তার একটা আবেগ ছিল। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেই বাবা দিবসে কিছু না কিছু করতাম। একসাথে খাওয়া-দাওয়া হত। গিফট আদান প্রদান করা হত।"
‘বাবা দিবসের’ স্মৃতি তুলে ধরে জয়িতা বলেন, "শেষ বাবা দিবসে সারাদিন আমি বাবার জন্য রান্না করেছিলাম। একটার পর একটা পদ রান্না করে তার সামনে নিয়ে গেছি।”
স্মৃতির পাতায় খালেদ খান কেবল একজন অভিভাবক নন, বরং একজন দার্শনিক মানুষ হিসেবেই থেকে গেছেন জয়িতার মনে।
বাবার কোন কথাটা জীবনে ধ্রুব সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল প্রশ্নে জয়িতা বলেন, "শেষের দিকে বাবার কথাগুলো অনেক বেশি গভীর হয়ে উঠেছিল। তাকে আমার দার্শনিক মনে হত। বয়স যত বাড়ছে তার সব কথাই এখন উপলবদ্ধি করতে পারি। সকল ক্ষেত্রে সব কথাই কেমন যেন মিলে গিয়েছে। যেমন সম্পর্কের ক্ষেত্রে, আমার গানের ক্ষেত্রে।
"প্রতিটা সম্পর্কে ইফোর্ট দেওয়া তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি আমাকে সবসময় বলতেন গান বুঝে গাওয়ার জন্য। তার পরোপকারী গুণটা তিনি চেয়েছেন আমার মধ্যেও আসুক। আমিও চেষ্টা করছি বাবার গুণগুলো সাথে নিয়ে চলতে।"
নব্বইয়ের দশকের মঞ্চ ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেতা খালেদ খান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' ও ইমদাদুল হক মিলনের 'রূপনগর' নাটকে অভিনয় করে সে সময় দারুন জনপ্রিয়তা পান তিনি। রূপনগর নাটকে ‘ছি, ছি, তুমি এতো খারাপ’ সংলাপটি সেই সময় দর্শকদের মুখে মুখে ফিরত।
নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের হয়ে মঞ্চে দেওয়ান গাজীর কিসসা, নূরুল দীনের সারাজীবন, দর্পনসহ ৩০টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন পুতুল খেলা, ক্ষুধিত পাষাণসহ ১০টির বেশি নাটক।