Published : 15 Jun 2025, 11:50 PM
জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যের ভাগ নিয়ে প্রতিবছর হতাশার কথা এলেও এ বরাদ্দ দিয়েই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের আরও উন্নতি করা সম্ভব বলে মনে করেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান।
তিনি বলছেন, “সেজন্য দরকার সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে এ কে আজাদ খান বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার পৃথিবীজুড়ে স্বাস্থ্যখাতে আমূল পরিবর্তন আনছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশেও প্রত্যন্ত এলাকায় সেবা পৌঁছানো যায়।
“আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া। সেখানকার আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে খুব ট্রেইনড লোক ওখানে দীর্ঘকাল থাকতে চায় না। কিন্তু প্রযুক্তি এমন হয়েছে যে ওখানে ফিজিক্যালি যাওয়ার দরকার নাই। অনলাইনে সেবা পৌঁছানো যায়।
“শুধু তাই নয়, কনসালট্যান্ট রোগীকে দরকারি যেসব ইনভেস্টিগেশন দিল, সেগুলোর রেজাল্ট এখন পয়েন্ট অফ কেয়ারে সাথে সাথে করে নিতে পারে। ডিজিটাল মাধ্যমে একজন চিকিৎসক ঢাকা বা নিউ ইয়র্কে বসেও রোগী দেখে, পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ব্যবস্থাপত্র দিতে পারে।”
এই চিকিৎসকের মতে, প্রযুক্তির উন্নয়নে একটি ‘বিশাল সুযোগ’ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশেও সে সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। তবে কাজটা ‘আরো ভালোভাবে’ করা দরকার।
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ কে আজাদ খান দীর্ঘদিন ধরে বারডেমের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান এবং ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান।
স্বাস্থ্যসেবায় ‘ইব্রাহিম ডায়াবেটিস কেয়ার মডেল’ উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সমাজসেবায় স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া এই চিকিৎসক অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ইনসাইড আউটে এ কে আজাদ খান বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাজেট যথাযথ ব্যবহার করেই ৯০ শতাংশ মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়।
“সেজন্য স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনও সাজেস্ট করেছে যে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার এটা সরকারের জন্য অবশ্য কর্তব্য হবে। পাশাপাশি নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার হয়ে যাবে। আমাদের বর্তমান অবকাঠামো আরেকটু উন্নত করে রেফারেলের মাধ্যমে এটা সম্ভব।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে রোববার ইনসাইড আউটের সর্বশেষ পর্বটি সম্প্রচার করা হয়।
আস্থার সঙ্কট
ডা. এ কে আজাদ খান মনে করেন, অব্যবস্থাপনা, আস্থার সঙ্কট, দুর্নীতি, অবকাঠামো ও বাজেট সঙ্কটের কারণে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে আছে। তবে ‘চাইলে’ এগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
“ধরুন, আপনি প্রত্যন্ত এলাকায় আছেন, সেখানেও চিকিৎসা সম্পন্ন করা যায়। বা ঢাকায়ই করা যায়। আমি কথাটা বাড়িয়ে বলছি না। আগেও বলেছি।”
তিনি বলছেন, দেশের রাষ্ট্রপতি যখন ঘোষণা দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান, বিষয়টি দেশের মানুষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তৈরি করে।
“দেশের প্রেসিডেন্ট চেকআপ করতে বাইরে গেলে অ্যানাউন্স করে কাগজে দিয়ে যাইতে হবে কেন? তার মানে আপনি এদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একদম আন্ডারমাইন করছেন। জওহরলাল নেহরু অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে বাইরে নিয়ে যায়নি, চিকিৎসা দিল্লিতেই হয়েছে। মাও জেদংয়ের চিকিৎসা কিন্তু বেইজিংয়েই হয়েছে।"
অধ্যাপক এ কে আজাদ খান মনে করেন, বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ যে ভারতে চিকিৎসা নিতে যেত, তার একটি বড় কারণ ছিল আস্থার সঙ্কট।
বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে চান না বলে যে অভিযোগ আছে, ‘সেটাও সত্যি’ বলে স্বীকার করছেন এই জাতীয় অধ্যাপক।
সেই সঙ্গে তিনি এও বলছেন, “সেটা ওভারকাম করা যায়। ডাক্তারদের ট্রেনিংয়ের ভেতরে হিউম্যান বিহেভিয়ারের বিষয়টি নাই। আমাদের মেডিকেল কলেজে শেখায় রোগের চিকিৎসা করা, মানুষের চিকিৎসা করা না। হিউম্যান বিহেভিয়ার মেডিকেল এডুকেশনে ইনক্লুড করতে হবে।”
রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে চিকিৎসকদের আচরণ পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন অধ্যাপক এ কে আজাদ খান।
“তখন যে ডাক্তার সময় নিয়ে দেখবে না রোগীরা তার কাছে যাবে না। এখন তো রোগীরা তার কাছে যেতে বাধ্য হচ্ছে।”
ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও সুশাসনের অভাবে রোগীরা অর্থ খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পাচ্ছে না।
“কথা হচ্ছে যতটুকু খরচ হয় সেই সেবাটা রোগী পায় কি না। আমি মনে করি সেই সেবা পায় না। সেবার মানও দুর্বল। কিন্তু যে খরচ হয় বাংলাদেশে তা দিয়ে খুব উন্নত সেবা পাওয়াও সম্ভব না, সেটাও সত্যি।”
কোভিডের শিক্ষা
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর দেশের স্বাস্থ্য খাতের নানা রোগের খবর বেরিয়ে আসতে থাকে। চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতা থেকে শুরু করে দুর্নীতির চিত্র আরো স্পষ্ট হয়।
অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলছেন, মহামারীর পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ‘একটা বড় পরিবর্তন’ এসেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ টিকার আওতায় এসেছে। তাতে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কোভিডের কারণে বাংলাদেশে টিকা তৈরির সক্ষমতার বিষয়টিও সামনে এসেছে।
“আমি মনে করি, সরকার এবং জনগণ বুঝতে পেরেছে যে ভ্যাকসিন প্রোডাকশনে আসতে হবে। কারণ আমরা ১৮ কোটি লোক, আপনি এত টিকা কোথা থেকে কিনবেন। বর্তমানে নতুন নতুন ভাইরাস আসছে, যে ভাইরাস আমাদের এখানে এসেছে অন্য কোথাও আসেনি। তারা তো ভ্যাকসিন বানাবে না।”
তিনি বলেন, টিকা তৈরির প্রযুক্তি বাংলাদেশের আছে। এটা কাজে লাগানো উচিত।
“সরকারের উচিত ভ্যাকসিন প্রজেক্ট নেওয়া। যেখানে ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তবে শুনেছি যে সরকার এমন একটা প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে।”
দুর্বলতা গবেষণায়
১৯৭৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি ফিল ডিগ্রি নেওয়ার সময় তরুণ এ কে আজাদ খান ৫-এএসএ ভিত্তিক যে ওষুধ উদ্ভাবন করেছিলেন, আজও তা প্রদাহজনিত অন্ত্র রোগের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
দেশে তিনি বারডেমের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তার তত্ত্বাবধানেই বারডেম একটি গবেষণা দল গড়ে তুলেছে।
কিন্তু তিনিও মানছেন, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে দেশে প্রয়োজনীয় গবেষণা হয় না। গবেষণার মান খুবই দুর্বল এবং গবেষণার জন্য সঠিক অবকাঠামাও তৈরি হয়নি।
“আমি বিশ্বাস করি গবেষণার সাথে অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমস্যা আপনার, অন্য দেশের লোকেরা এটা নিয়ে গবেষণা করবে না। আপনার সমস্যা আপনাকে গবেষণা করেই সলিউশন করতে হবে। সরকার যদি চায় মানুষ ধূমপান করবে না। তো সেটা কীভাবে করলে মানুষ শুনবে, সেই উপায় বের করতে হবে। গবেষণা করার জন্য ট্রেইনড লোক থাকতে হবে, সময় থাকতে হবে।”
অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, মেডিকেল শিক্ষা কোনো ‘পার্টটাইম এবং বদলিযোগ্য’ চাকরি হতে পারে না। তাদের বেতনভাতা এমন হবে যেন তারা শিক্ষাদানের পাশাপাশি গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারেন।
“কোনো একটা ডিপার্টমেন্ট ট্রান্সফারের জব দিয়ে গ্রো করতে পারে? কারণ বিলঙ্গিং হবে না। সুতরাং যে মেডিকেল কলেজ আছে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলা টিচার প্র্যাকটিসিং জব হওয়া উচিত, ট্রান্সফারেবল হওয়া উচিত না। অ্যাপয়েন্টেড ফর দি টিচিং।
“তাদের পে স্কেল এমন হবে যাতে সে কমফর্টেবল থাকতে পারে। সমাজে ভদ্রভাবে চলতে গেলে যা লাগে সেটা সে পাবে। তাহলে পরে তারা গবেষণায় সময় দেবে।”
কমিউনিটি ক্লিনিক ‘চালু রাখতে হবে’
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে কমিউনিটি ক্লিনিক বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তবে ডা. এ কে আজাদ খান মনে করেন, মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে যে কোনোভাবেই হোক, এ সেবা চালু রাখতে হবে।
“কোনো একটা ফর্মে চালু রাখতে তো হবে। আপনি কমিউনিটি ক্লিনিক নামে রাখবেন, না এটা অন্য নাম দিয়ে আরো উন্নত করবেন–সেটা ঠিক করতে হবে।”
তিনি বলেন, বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকের কোনো ‘অভিভাবক নেই’। কমিউনিটি ক্লিনিককে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার শুরুর ধাপ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রকে একটি ‘সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায়’ আনতে হবে।
“এগুলোকে একটা রেগুলেশনের মধ্যে আনতে হবে। কম্পিটেন্ট হেলথকেয়ার প্রোভাইডার থাকতে হবে। এখন যেভাবে আছে তা শুধু নামে। ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দারের মত আছে।”
এ কে আজাদ খান বলেন, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সেই অর্থে গড়ে ওঠেনি। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার মতো দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
“আমি ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি, প্র্যাকটিস করি গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি। আমাকে যদি একটা ক্লিনিকে প্রাইমারি হেলথকেয়ার দিতে বলেন আমি তা পারব না। আমি ওই লাইনের লোক না। সুতরাং ওই লাইনের লোক সৃষ্টি করতে হবে।
“আজকে যদি সিদ্ধান্ত নেন করবেন, এই মুহূর্তে করে ফেলতে পারবেন না। সিদ্ধান্ত নিলে পাঁচ সাত বছর পর করতে পারবেন।”
দুর্নীতির চিকিৎসা কী
বাংলাদেশের সব খাতের মত স্বাস্থ্যখাতেও দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন প্রয়োগে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ডা. এ কে আজাদ খান।
তিনি বলেন, “দুর্নীতি খালি স্বাস্থ্য খাতে হচ্ছে তা কিন্তু না, এটা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিটা গায়ে লাগে। দুর্নীতি কমাতে হলে আইনের প্রয়োগ ঠিকমত করতে হবে। তাহলে দুর্নীতি কমে যাবে।”
এই চিকিৎসকের পরামর্শ, দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হলে ডাক্তারদের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।
“ডাক্তারদের কোড অফ কন্ডাক্ট তো কন্ট্রোল করছে বিএমডিসি। বিএমডিসিকে পাওয়ারফুল এবং নন পলিটিক্যাল বডি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তারা যেন ফুলটাইম এবং ননপলিটিক্যাল পিপল হয়।”
পুরনো খবর
স্বাস্থ্যে সংস্কার কতটা সম্ভব?
চিকিৎসকদের কর্মস্থলে থাকা নিশ্চিত করতে হবে: ইউনূস
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সংবিধানে 'মৌলিক অধিকার' ঘোষণার সুপারিশ