Published : 13 Jun 2025, 12:19 AM
চন্দ্রাবতী ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর কবি। তাকে বলা হয় ‘প্রথম বাঙালি’ নারী কবি। চন্দ্রাবতীর জন্ম আনুমানিক ১৫৫০ সালে, কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে পাতুয়াইর গ্রামে। তিনি ষোড়শ শতকের ‘মনসামঙ্গল’-এর কবি দ্বিজ বংশীদাস আর সুলোচনা দেবীর মেয়ে।
কবি চন্দ্রাবতীর সমকালীন অপর দুজন বাঙালি নারী কবি হলেন শ্রীচৈতন্যের কৃপাপাত্রী মাধবী আর চন্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামী বা রামতারা। চন্দ্রাবতী জীবন চরিত প্রকাশ করেছেন প্রথমে নয়ানচাঁদ ঘোষ, পরবর্তীকালে চন্দ্রকুমার দে। প্রথমটি পালাগান হিসেবে এবং পরেরটি প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। চন্দ্রকুমার দে’র প্রবন্ধটি ১৯১৩ সালে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত হয় কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায়।
দীনেশচন্দ্র সেন এ সম্পর্কে লিখেছেন, “গ্রন্থাকার চন্দ্রাবতীর কাহিনীর মর্ম্মাংশটি মাত্র দিয়াছিলেন। কিন্তু যেটুকু দিয়াছিলেন, তাহা একেবারে চৈত-বৈশাখী বাগানের ফুলের গন্ধে ভরপুর।” দীনেশচন্দ্র সেন এর চেয়ে বেশি অপেক্ষায় ছিলেন নয়ানচাঁদের লেখা পাঠের। তিনি লিখেছেন, “চন্দ্রকুমার বাবুর স্বরচিত ‘চন্দ্রাবতী’র উপাখ্যান অপেক্ষা নয়ানচাঁদ ঘোষ বিরচিত ‘জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতী’র পালাটি জানিবার জন্যই আমি বিশেষভাবে লালায়িত হইয়াছিলাম।”
“নয়ানচাঁদ কবে নাগাদ এটি রচনা করেন, তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় নাই। যেহেতু চন্দ্রাবতীর মৃত্যুর পর লেখা, তাহলে ১৬০০ সালের পরে নিশ্চয়। গাথাটির ছত্রসংখ্যা মোট ৩৫৪টি।” দীনেশচন্দ্র সেন প্রকাশের সময়ে এটিকে ১২ অঙ্কে বিভক্ত করেন। তার ওপর ভিত্তি করেই সমকালে নাট্যমঞ্চে, লোককবির পালাগানে, এমনকি চলচ্চিত্রে চন্দ্রাবতী অমর হয়ে আছেন।
চন্দ্রাবতীর পিতামহের নাম যাদবানন্দ এবং পিতামহী অঞ্জনা ভট্টাচার্য্য। ধারণা করা হয়, দারিদ্রের শুরু এদের সময় থেকে। তাদের বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরেই চন্দ্রাবতীর পিতা কবি দ্বিজ বংশীদাসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বংশীদাসের পিতা-মাতা ঘট বসিয়ে মনসার পূজা করতেন। চন্দ্রাবতীর অভিযোগ, “এ কারণে রাগ করে লক্ষ্মীদেবী তাদের ছেড়ে চলে যায়।” যাপিত জীবনে দারিদ্র্যের ছোবল এভাবেই চন্দ্রাবতী তার রামায়ণে প্রকাশ করেছেন।
তিনি উল্লেখ করেন, “মনসার বরে চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজ বংশীদাস জন্মেছিলেন এবং ভাসান শিল্পী হিসেবে জগৎ-সংসারে নন্দিত হয়েছেন।” কবি দ্বিজ বংশীদাস যখন দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত, সেসময় মা মনসা তাকে স্বপ্নে নির্দেশনা দেন মনসার ভাসান গেয়ে অর্থ-উপার্জনের। বংশীদাস ভাসান গেয়ে যে দু-চার পয়সা আয় করতেন, তা দিয়েই চন্দ্রাবতীদের ভরণপোষণ চলত। বিকল্প কোনো রোজগারের ব্যবস্থা আর ছিল না। সেক্ষেত্রে চন্দ্রাবতীর কাব্য প্রতিভার বিকাশ পিতার স্নেহে-প্রশ্রয়ে যে বিকশিত হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মধ্যযুগের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমাজপতিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কবি চন্দ্রাবতী বোধ করি প্রথম নারী, যিনি পেরেছিলেন নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনগাথা সাহিত্য সাধনার অন্তর্গত করতে। সীতার জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন নিজের অন্তর্গত দুঃখ-বেদনার আর কষ্টের তিলককেও। চন্দ্রাবতী রচিত ‘রামায়ণ’ পালায় তার দারিদ্রপীড়িত যাপিত জীবনকথা আর বংশ পরিচয় খানিকটা প্রকাশ পেয়েছে।
চন্দ্রাবতী বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলে পিতার নির্দেশে লিখেছিলেন ‘রামায়ণ’। এটি কিশোরগঞ্জ ও পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঘরে ঘরে আজও মায়েদের কণ্ঠে গাওয়া হয়। এ এক ভিন্নধারার পালা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পালার সঙ্গে কৃত্তিবাস ওঝার কিংবা বাল্মীকি রামায়ণের তুলনা করার সুযোগ নেই। চন্দ্রাবতী এখানে রাম-সীতার কাহিনির ভেতর দিয়ে তার সময়ের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ বাংলার সুখ-দুঃখ-প্রেম-বিরহকেও বৃহত্তর পরিসরে তুলে ধরেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি হয়ত এটার নাম ‘রামায়ণ’ না রাখলেও পারতেন। সাত খণ্ডের রামায়ণের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে চন্দ্রাবতী লিখলেন তিন খণ্ডের ‘রামায়ণ’।
এখানে কিশোরগঞ্জ কিংবা বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক লোকভাষা বা উপভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি প্রান্তিক মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যেতে চেয়েছিলেন। পৌরাণিক আতিশয্যকে পরিহার করে তখনকার সমাজ ব্যবস্থার আটপৌরে জীবনকথাকে নিজের ভাষাশৈলী ব্যবহার করে প্রকাশ করেছেন। ফলে পাঠকমাত্রই এ গ্রন্থের পরতে পরতে চন্দ্রাবতীর জীবনকথা, এমনকি প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের নানা প্রতিচ্ছবি দেখতে পান।
‘রামায়ণ’ ছাড়াও ‘মলুয়া’, ‘পদ্মপুরাণ’ ও ‘দস্যু কেনারামের পালা’সহ অপরাপর রচনাতেও চন্দ্রাবতী তার চারপাশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। ব্যক্ত করেছেন প্রান্তিক ও নিম্নবর্গীয় মানুষের সুখদুঃখ, প্রতিবাদ আর বীরগাথা। এখানে তিনি তার সমকালের লেখকদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী ছিলেন। চন্দ্রাবতী তার কাব্যে সবসময় নারীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করেছেন। এই শ্রেষ্ঠত্বটুকু বিজয়ের মাধ্যমে নয়, পরাজয়ের মাধ্যমে। শর্তহীন আত্মসমর্পণ করেননি কোথাও। মধ্যযুগে এ ধরনের সাহসী ভূমিকা আর কেউ নিয়েছেন বলে জানা নেই। এছাড়া জয়ানন্দকে বিয়ে করার ঘোষণা, পরবর্তীকালে কুমারী থাকার দৃঢ়তাও চন্দ্রাবতীর সাহসী পদক্ষেপের অন্যতম। কারণ সময়টা ছিল মধ্যযুগ।
ক্ষেত্রগুপ্ত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা: লোকসাহিত্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “দস্যু কেনারামের পালা- অন্তত তার যে সাহিত্যিক রূপ আমাদের হস্তগত- অন্য গীতিকাগুলির ন্যায়ই একটি উৎকৃষ্ট রোমান্স। এ পালায় জনশূন্য জালিয়ার হাওর যতটা না ভৌগোলিক সত্য, রোমান্স কাহিনির পরিবেশ-রচনায় তার দান তার চেয়ে অনেক বেশি।”
চন্দ্রাবতীর রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রকুমার দে’র একটা বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি যেসব মৈমনসিংহের পালা এবং গান সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্রাবতীর রচনাবলী এর মধ্যে অন্যতম। তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে এ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন। চন্দ্রাবতীর ‘মলুয়া’ সম্পর্কে আশুতোষ ভট্টাচার্য গীতিকা প্রবন্ধে লিখেছেন, “মলুয়ার পালাটি একটু বর্ণনাত্মক, সেইজন্য অন্যান্য পালা অপেক্ষা ইহা দীর্ঘ। ... এই পালাটি ‘কুড়া শিকারীর গান’ নামে পূর্ব মৈমনসিংহের সর্বত্র পরিচিত, ইহার ‘মলুয়া’ নামটি সম্পাদক প্রদত্ত।” এ সম্পাদক হলেন দীনেশচন্দ্র সেন। তিনি লিখেছেন, “এই গাথার মোট ছত্রসংখ্যা ১ হাজার ২৪৭, আমি ইহাকে ১৯ অঙ্গে বিভাগ করিয়াছি। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের তেসরা অক্টোবর এই গীতিকা আমার হস্তগত হয়।”
চন্দ্রাবতী রামায়ণে সব ধরনের মান-অভিমান, অপ্রাপ্তি-অসঙ্গতিকে নিয়তির নির্মম পরিহাস হিসেবে মেনে নিয়েছেন। অভিযুক্তদের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও চূড়ান্ত বিচারে কেমন জানি ক্ষমার একটা মনোভাব ফুটে ওঠে। এ কারণে কবি চন্দ্রাবতী লিখেছেন, “বসুমতি কয়, মাগো আইস আমার কোলে/ দুঃখিনী কন্যারে লয়্যাগো/ আমি যাইব পাতালে/ সুখে থাউক রাজা রামগো রাইজ্য প্রজা লয়্যা/ আমার কন্যা সীতারে আমিগো/ লয়্যা যাই চলিয়া/... দুষ্ট লোকের কথা শুইনাগো কী কাম করিলা/ জন্মের মতন রামগো সীতারে হারাইলা/ চন্দ্রাবতী কাইন্দা কয়গো কাহারো দোষ নাই/ কর্মফল সুখ–দুঃখগো দাতা/ বিধাতা গোঁসাই।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্ত্তী লিখেছেন, “তিনি প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত কৃত্তিবাসী বা বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ কাহিনিকে অনুসরণ করেননি, বরং এ বিষয়ে গ্রাম্যগল্পকে প্রাধান্য দিয়ে এক ব্যতিক্রমী ‘রামায়ণ’ পালা রচনা করেন। চন্দ্রাবতী তাঁর ‘রামায়ণ’ পালাগানে কোনো প্রকার ভক্তিরস, বীররস, শৃঙ্গার রস তুলে ধরেননি। কেবল মধুর আর করুণরসকে উপজীব্য করে গড়ে তুলেছেন কাহিনি। কবি তাঁর রচনায় সীতাকে দেখিয়েছেন মুখ্যরূপে। প্রচলিত রামায়ণকারদের পথে না হেঁটে সীতার জীবনকেই পাঠককুলের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন চন্দ্রাবতী। তাই রামকে তিনি কোনো কোনো স্থানে সমালোচনা করতেও পিছপা হননি।”
১৯৩২ সালে দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর লেখা ‘রামায়ণ’ প্রকাশ করেন পূর্ববঙ্গ-গীতিকার চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় ভাগে। পিতা-পুত্রী একত্রে ১৫৭৫ সালে লিখলেন ‘মনসা ভাসান’। সেসময় চন্দ্রবতী ২৫ বছরের যুবতী। এই ভাসান আজও গ্রামবাংলায় প্রাচীন পুথি হিসেবে নন্দিত হচ্ছে। পরবর্তীকালের লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়, সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যর্কীতি স্মরণে রেখেও বলতে পারি, বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের ঘটনা আজ বিরল। এছাড়া চন্দ্রাবতীর অজস্র লোকগীতি রচনা আজও নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়ে এবং গ্রামীণ জীবনের প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে মায়েদের কণ্ঠে শোনা হয়।
আমাদের সাহিত্য-সমালোচকরা চন্দ্রাবতীর গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত রচনাবলীর বিচার-বিশ্লেষণ বিশেষভাবে করেননি। অল্পবিস্তর যা হয়েছে, তাও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেনি। আমরা অনেক বেশি জেনেছি চন্দ্রাবতীর প্রণয়োপাখ্যান। কারণ এটাই বেশি প্রকাশিত হয়েছে নয়ানঘোষ বিরচিত ‘জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতী’র পালার মাধ্যমে, যা কিনা মৈমনসিংহ গীতিকায় প্রকাশিত। যদিও এখানে চন্দ্রাবতী প্রণীত ‘দস্যু কেনারামের পালা’ ও ‘মলুয়া’ ইত্যাদি পালাও প্রকাশিত হয়েছে।
চন্দ্রাবতীর সাহিত্যচর্চার চেয়ে তার প্রণয়োপাখ্যান বেশি প্রচার পায়, কারণ চন্দ্রাবতী সুন্দরী ছিলেন। আখ্যানটি বিয়োগান্তর। তার স্বপ্নের মানুষও তেমন ছিলেন। চন্দ্রাবতীর প্রণয়োপাখ্যানের নায়কের নাম জয়ানন্দ। জয়ানন্দের বাড়ি করিমগঞ্জ উপজেলার সুন্ধা গ্রামে। চন্দ্রাবতীদের পাশের গ্রাম। জয়ানন্দ ছিল চন্দ্রাবতীর শৈশবের বন্ধু ও খেলার সাথি। প্রতিদিন ভোরে দুই বন্ধু মিলে পূজার ফুল তুলত। জয়ানন্দ ফুল গাছের ডাল নুইয়ে ধরত। আর চন্দ্রাবতী ফুল তুলত। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে দুজনে খেলাধুলা করত।
চন্দ্রাবতী পিতার উৎসাহে কাব্য রচনায় মনোনিবেশ করলে, জয়ানন্দও তাতে উৎসাহী হয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন। সেসময় দুজনকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখতেন, পাঠ করে শুনাতেনও। দুজনের এ বন্ধুত্ব বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়ের দিকে মোড় নেয়। বিষয়টা পরিবারের মধ্যে বিশেষ করে চন্দ্রাবতীর বাবা জানার পর বললেন, তিনি জয়ানন্দের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর যথাসময়ে বিয়ের আয়োজন করবেন।
বিয়ের দিন-ক্ষণও ঠিক হয়। ততদিনে চন্দ্রাবতীর মতো ‘ধর্ম্মশীলা সংযমশীরা তপস্বিনী নারী... জয়চন্দ্রকে স্বামীরূপে হৃদয়ে গ্রহণ’ করে ফেলেন। এসময় জয়ানন্দের জীবনে চলে আসেন আরেক নায়িকা। হ্যাঁ নায়িকাই তো। নায়িকার নাম আসমানি। এক কাজী সাহেবের মেয়ে। ধর্মান্তরিত হন জয়ানন্দ। বিয়ে করেন তাকে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল চন্দ্রাবতীর মাথার উপর। চরমভাবে মর্মাহত হলেন। বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন চন্দ্রাবতী। পিতার নির্দেশে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে শিবের উপাসক হলেন। একই সঙ্গে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।
একসময় জয়ানন্দ নিজের ভুল বুঝতে পারেন। ছুটে আসেন চন্দ্রাবতীর কাছে। অভিমানী চন্দ্রাবতী গ্রহণ করলেন না জয়ানন্দকে। চন্দ্রাবতীর দর্শন লাভ করতে একদিন জয়ানন্দ ছুটে যান ফুলেশ্বরী নদীর তীরে সেই শিবমন্দিরে। সেসময় চন্দ্রাবতী পূজা করছিলেন। মন্দিরের দরজা ছিল বন্ধ। অনেক ডাকাডাকি করলেন। চন্দ্রাবতী মন্দিরের বন্ধ দরজা খুললেন না। নিরুপায় জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর প্রিয় ফুল সন্ধ্যামালতী রস নিঙড়ে শিব মন্দিরের দরজার সামনে চার লাইনের একটি কবিতা লিখলেন “শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৈবন কালের সাথী/ অপরাধ ক্ষমা করো তুমি চন্দ্রাবতী/ পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হৈলা সম্মত/ বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো।” তারপর জয়ানন্দ ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
পূজা শেষ করে একসময় চন্দ্রাবতী মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন। বুঝতে পারেন জয়ানন্দ এসেছিলেন। জয়ানন্দের লেখা কবিতা পাঠ করলেন। তারপর ফুলেশ্বরী নদীতে গেলেন পানি আনতে। নদীর ধারে গিয়ে চন্দ্রাবতী জানতে পারলেন, জয়ানন্দ আত্মহত্যা করেছেন। চন্দ্রাবতী এবার চূড়ান্তভাবে ভেঙ্গে পড়েন। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। জয়ানন্দের মৃত্যু চন্দ্রাবতী খুব আঘাত পেলেন। ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে তিনিও আত্মহত্যা করলেন।
চন্দ্রাবতীর এই মৃত্যু নিয়ে ভিন্নমত আছে। কেউ বলেন, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আবার কারো মতে, শিববদর্শনের কিছুদিন পর হৃদরোগে মারা যান তিনি। আবার কেউ বলেন, জয়ানন্দের মৃত্যু সংবাদ শুনে চন্দ্রাবতী মন্দিরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন। তারপর আর বের হননি। ওখানেই চন্দ্রাবতীর মৃত্যু হয়। সে সময়টা ছিল আনুমানিক ১৬০০ সাল।
ক্ষেত্রগুপ্ত তার প্রবন্ধে লিখেছেন, “চন্দ্রাবতীর মনের উপরে যে আঘাত এলো তা একটু বিচিত্র ধরনের। এ কেবল বাইরের কতকগুলো ঘটনার আঘাত নয়, জয়ানন্দ তাঁর হৃদয়ের প্রেমকে আঘাত করেছে- এ আঘাত হৃদয় দ্বারা হৃদয়ে আঘাত। তাই সে গীতিকার অন্যান্য নায়িকার ন্যায় বিনিয়ে বিনিয়ে বারমাসী কাঁদল না: না কান্দে না হাসে
চন্দ্রা নাহি বলে বাণী/ আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।” সত্যিই তিনি পাষাণ হয়ে গেলেন, “নির্মাইয়া পাষাণ শিলা বানাইয়া মন্দির/ শিবপূজা করে কন্যা মন করি স্থির।”
এই মনস্থির করার চেষ্টাই চন্দ্রাবতীর জীবনের বড় ট্র্যাজেডি। চন্দ্রাবতী কেবল ‘রামায়ণ’ রচয়িতা নন, ছিলেন প্রান্তিক নারীর কণ্ঠস্বর, সাহিত্যের নিরব বিপ্লবী। তার জীবন ও সাহিত্য এখনও বাঙালির স্মৃতিতে এক মৃদু জলছাপ হয়ে বেঁচে আছে।