ধারাবাহিক উপন্যাস
Published : 18 May 2025, 01:19 AM
মাথার উপর গাছের পাতা নড়েচড়ে ওঠে, সাপসহ ডালটা কেঁপে ওঠে। জিসান মুখ ফিরিয়ে আবার সেদিকে তাকায়। যা দেখে, তাতে তার দম আটকে যাওয়ার জোগাড় হয়। গলা চিরে সে দম চিৎকার হয়ে বের হতে গেলে, নিজেই এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। তারপর, নিজের চোখ উপরের দিকে রেখে মুখ থেকে হাত নামিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ইমরানের মাথাটা পেয়ে ঘুরিয়ে ওপরের দিকে দেখার ইঙ্গিত দেয়।
ইমরানের সাথে সাথে বাকি দুজনও চুপচাপ মাথা ঘুরিয়ে ওপরের দিকে তাকায়। ওপরের দৃশ্য দেখে ভয়ে তাদের অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। দাঁতের কপাট খুলে, গলা চিরে ভয়ার্ত চিৎকার বের হতে চায়। কিন্তু অনেক কষ্টে তারা নিজেদের ঠিক রাখে, মুখ বন্ধ রেখে চিৎকার চেপে রাখে। তারা দেখে- একটা সাপ অর্ধেক শরীর দিয়ে গাছের ডালটা পেঁচিয়ে রেখে মাথাটা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলে আছে। ঝুলে ঝুলে দোল খায় এবং ফণা তুলে তেড়ে আসতে চায়। কিন্তু পারে না।
সাপটা চাইলেই অনায়াসে ডাল বেয়ে নেমে আসতে পারতো, কিন্তু তা না করে এভাবে কেন ঝুলে আছে জিসান তা ভেবে পায় না। এসব নিয়ে বেশি ভাবার মানসিক অবস্থাও তখন নেই। তখন জিসান অথবা সবার মনে হয়, তারা কোনো একটা দুঃস্বপ্নে আটকে আছে অথবা জিসান তার বন্ধুদের নিয়ে কোনো একটা সিনেমা দেখছে। অথবা মনে হয়, প্রকৃতিতে বৃষ্টিমুখর নিশুতি রাতের অন্ধকারে সুন্দরবনের মতো গহিন অরণ্যে কোনো একটা ইংরেজি অ্যাডভেঞ্চার সিনেমার দৃশ্যায়ন চলছে। নিচে হিংস্র বাঘ, মাথার উপরে ফণা তোলা বিষধর সাপ, মাঝখানে নিরুপায় ও অসহায় চার কিশোর।
তবে কিশোররা সেই সিনেমার চরিত্রাভিনেতা নাকি দর্শক, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তারা পাণ্ডুলিপি জানে না, পরবর্তী দৃশ্যে কী হতে চলেছে তারা তা অবহিত নয়। এবং এই চলমান দৃশ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার বা বের হওয়ার উপায়ও তারা জানে না। এই দুঃস্বপ্ন কতক্ষণ চলবে বা সিনেমাটা কখন শেষ হবে, তারা কেউ তা বুঝতে পারে না। পৃথিবীর চলমান সময় চলে যেতে যেতে এখানে এসে থমকে থাকে। মাথার উপর ঝুলন্ত সাপ আর পায়ের নিচে গাছের গোড়ায় বাঘ নিয়ে নিরুপায় কিশোরদল, দৈব অথবা অতিপ্রাকৃতিক কিছু ঘটার অপেক্ষা করতে থাকে।
অপেক্ষার মধ্য দিয়ে কতক্ষণ সময় যায়- সে খেয়াল তাদের নেই। তারা যতটুকু সম্ভব নিশ্চল ও অনড় থাকে। একজনের হাতে হাতঘড়ি এবং দুজনের পকেটে মোবাইলে ঘড়ি থাকলেও এমন পরিস্থিতিতে তাদের সময় দেখার কথা মনে থাকে না বা ভাবনায় আসে না। কিন্তু জগতের সময় চলে যায়, রাত আরও গভীর হয়। ততক্ষণে বৃষ্টির জোর কমে আসে। ফোঁটাগুলো ছোট ও হালকা হয়। তাদের অবাক করে দিয়ে বাঘটা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং হাঁটতে শুরু করে।
চার কিশোর নিশ্বাস চেপে রেখে দেখে- বাঘটা এবার আর এক জায়গায় ঘুরে ঘুরে হাঁটে না। সোজা হাঁটতে হাঁটতে ঘন গহনবনের দিকে চলে যায়। যেতে যেতে একসময় তাদের সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যায়। সুন্দরবনের ভয়ংকর সুন্দর প্রাণীটাকে কোথাও আর দেখা যায় না। কিন্তু জিসান বাঘের চলে যাওয়া দেখতে পায় না। সে তখনও সাপটার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সাপটাকে চোখে চোখে রাখছে এবং নিজে সতর্ক অবস্থানে থাকছে।
সাপটা মোচড় খায় এবং মাথাটাকে গাছে ডালের ওপর তোলার চেষ্টা করে। এভাবে ঝুলে থেকে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। এসময় জিসানের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। এক হাতে গাছের ডাল ধরে রেখে আরেক হাতে পকেট থেকে সে মোবাইল ফোনটা বের করে। কিন্তু হায়! বিপদ যখন আসে তখন যেন সে দলবল নিয়ে সবদিকে থেকেই আসে। ভেজা হাত দিয়ে কল রিসিভ করে কানে ধরার সময়, হাত ফসকে মোবাইলটা নিচে পড়ে যায়।
বৃষ্টির পানি জমে থাকা জায়গায় পড়তেই মোবাইল স্ক্রিনের আলো নিভে যায়। সহজেই অনুমান করা যায় মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেছে। এত উঁচু থেকে পড়ে মোবাইল ঠিক থাকার কথাও নয়। সাথে থাকা দুটো মোবাইলের একটা নিচে পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অথবা একটা মোবাইলের স্ক্রিনের আলো নিভে যাওয়ায় চার কিশোরের এই বিপদসংকুল বন থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরার আশার আলোও যেন অর্ধেক নিভে যায়। কিন্তু এই তরুণপ্রাণ তো এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে পারে না।
তারা নিজেরাই আবার যোগাযোগ করতে উদ্যমী হয়, উদ্যোগী হয়। ইমরান নিচু কণ্ঠে আদনানকে বলে- ‘তোর মোবাইলটা বের করে ওসি সাহেবকে ফোন কর। দেখিস, বের করতে গিয়ে তুইও আবার মোবাইল ফেলে দিস না। তাইলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে’। আদনান সাবধানে মোবাইল ফোন বের করে। ডায়াল লিস্ট থেকে ওসি সাহেবের নম্বরে কল দেয়। কিন্তু তার মোবাইল আউট অফ নেটওয়ার্ক দেখায়। সে আবার চেষ্টা করে।
ওদিকে মাথায় ওপর থাকা সাপটা ততক্ষণে চেষ্টায় সফল হয়ে গেছে। সে আবারও ডালে গিয়ে অর্ধেক শরীর দিয়ে ডাল প্যাঁচিয়ে আছে। তবে আর এগিয়ে আসছে না, স্থির আছে। হয়তো এতক্ষণের চেষ্টায় যে পরিশ্রম হয়েছে, তার জন্য একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। এসবের মধ্যে মিঠু হঠাৎ সাহসী হয়ে ওঠে। সে আদনানকে বলে- ‘তোর মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটা একটু জ্বালা তো, আমি নিচে গিয়ে জিসানের মোবাইলটা নিয়ে আসি’। মিঠুর এমন কথায় বাকি তিনজন হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পায় না।
জিসান সাপটার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে- ‘তুই কী পাগল হলি মিঠু! মোবাইল তো বন্ধ হয়েই গেছে, তার জন্য তুই বাঘের মুখে যেতে চাস?’ আদনানও জিসানের কথায় সায় দিয়ে বলে- হ্যাঁ তাই তো, বাঘটা হয়তো আশপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তোকে দেখে ফেললে আর শেষ রক্ষা হবে না। গাছে উঠারও সময় পাবি না। আর গাছে থেকে আমরাও তখন রক্ষা পাবো না’। বন্ধুদের কথা শুনে মিঠু আর নামার সাহস পায় না। নিচে চারদিকে একবার চোখ বোলায়। গাছের নিচে ঝোপঝাড়ে ছোপ ছোপ গাঢ় অন্ধকার। একটা ঝোপ নড়ে ওঠে। বাঘ হয়তো ওদিকেই আছে।
এদিকে আন্দারমানিক ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে অস্থির পায়চারি করছেন নৌপুলিশদের দলনেতা ফিরোজ সাহেব। ওসি সাহেব এখনও কোনো খবর দিতে পারেননি। তবে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। বৃষ্টি থেমে গেলেই বনের ভেতর প্রবেশ করবেন। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। তবে আকাশ এখনো পুরোপুরি মেঘমুক্ত হয়নি। ঘন মেঘ গভীর রাতের আকাশকে ছাই রঙে ছেয়ে রেখেছে।
ওদিকে আহত ডাকাতকে বা ডাকাতদলের ট্রলারের মাঝিকে ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। সে এখন ব্যাঙের মতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। জেলের বাড়িতে তার উদ্ধারের খবর পৌঁছানো হয়েছে। আগামীকাল সকালে শরণখোলা নৌপুলিশ থানায় এসে জেলেকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু কিশোর পর্যটকদের উদ্ধার চিন্তা ফিরোজ সাহেবকে স্বস্তি দিচ্ছে না। তিনি কোথাও স্থির থাকতে পারছেন না।
শরণখোলা থানার ডিউটি অফিসার হাবিব সাহেব নিজের টিম নিয়ে বিসমিল্লাহ স্টোর থেকে বের হয়ে একটু পেছনে এসে জব্বার ডাক্তার বাড়ির সুন্দরবন জামে মসজিদে অবস্থান করছেন। ওসি সাহেব যখন তাকে নিজের প্ল্যান বুঝিয়ে বলেন, এটি তার খুব মনে ধরে। কিশোরদলের অবস্থান বোঝার জন্য এটি একটি যুক্তিসঙ্গত ও কার্যকর উপায় হতে পারে বলে মনে হয়েছে। প্ল্যান শুনে নিজের সিনিয়রের প্রতি আরও শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। এখন একটাই সমস্যা, তা কার্যকর করার জন্য কিশোরদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু সেটাই করা সম্ভব হচ্ছে না।
চলবে...