অনূদিত গল্প
Published : 01 Jun 2025, 02:37 PM
জাপানের অন্যতম খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯- ১৯৭২)। তিনি ওসাকায় জন্ম নেন। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম জাপানি লেখক হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কাওয়াবাতা স্কুলজীবনেই প্রথম গল্প প্রকাশ করেন এবং ১৯২৪ সালে টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক পাশ করেন।
কাওয়াবাতা বেশকিছু উপন্যাস লিখেছেন, যার মধ্যে ‘স্নো কান্ট্রি’ (১৯৫৬) তার খ্যাতি অমর করে তোলে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘থাউজ্যান্ড ক্রেইনস’ (১৯৫৯), ‘দ্য সাউন্ড অফ দ্য মাউন্টেন’ (১৯৭০), ‘দ্য মাস্টার অব গো’ (১৯৭২) এবং ‘বিউটি অ্যান্ড স্যাডনেস’ (১৯৭৫)। তিনি দীর্ঘদিন জাপানের পিইএন ক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৫৯ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে গ্যোটে মেডেল পুরস্কার পান। ১৯৭২ সালে মারা যান এ কীর্তিমান সাহিত্যিক।
কাল রাতের প্রবল বাতাসে ডালিম গাছটির সব পাতা ঝড়ে পড়েছে। পাতাগুলো গাছের গোড়ার চারপাশে চক্রাকারে বিছিয়ে আছে। সাত সকালে কিমিকো ন্যাড়া গাছটি দেখে খুবই অবাক হলো, পাতার বৃত্তটি একেবারে নিখুঁত।
কিমিকো ভাবলো, এমন ঝড়ে তো সব ওলটপালট হওয়ার কথা! তবুও, গাছে খুবই ভালো একটা ডালিম ফল রয়ে গিয়েছে। “মা এখানে একটু আসো, দেখে যাও”, সে তার মাকে ডেকে বলল। “ওহ! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।” মা এক পলক গাছের দিকে তাকালেন এবং ফের রান্নাঘরে চলে গেলেন। এই দৃশ্য কিমিকোকে মনে করিয়ে দিল তাদের নিঃসঙ্গতার কথা। বারান্দার ওপারের ডালিম ফলটিও যেন তাদেরই মত নিঃসঙ্গ ও বিস্মৃত।
দুই সপ্তাহ আগে, তার সাত বছরের ভাগনে এসেছিল, এসেই তার নজর পড়ল ডালিম ফলের দিকে। সে তৎক্ষণাৎ গাছে উঠে গেল। কিমিকোর স্বত্বায় যেন জীবনের উপস্থিতি অনুভূত হলো। “এখানে উপরে বড় একটা আছে,” কিমিকো বারান্দা থেকে চিৎকার করে বলল।
“কিন্তু ওটা ছিঁড়ে নিলে তো গাছ থেকে নিচে নামতে পারবো না”। এটা ঠিক। দুই হাতে ডালিম ফল নিয়ে গাছ থেকে নিচে নামা মোটেও সহজ নয়। কিমিকো মৃদু হাসলো। সে ছিল একটা আদরের বাচ্চা। আসার আগে বাড়ির সবাই ডালিমটির কথা ভুলেই গিয়েছিল। এখন আবার তারা ভুলে গিয়েছে।
তখন ফলটা ছিল পাতার আড়ালে লুকানো। আর এখন আকাশের পটভূমিতে স্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছে। ফলের ভেতরে আর গাছের গোড়ায় বৃত্তাকারে থাকা পাতায় লুকিয়ে আছে, যেন এক রহস্যময় শক্তি। কিমিকো একটা বাঁশের লগি দিয়ে ফলটি পেড়ে নিয়ে এলো। ওটা ছিল এতটাই পাকা যে বিচিগুলো জোর করে ফলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে যখন ফলটি বারান্দায় রাখল, সূর্যের আলোয় বীজগুলো ঝিকমিক করছে—মনে হচ্ছিল, আলোটা যেন তাদের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে।
কিমিকো কিছুটা অনুতপ্ত বোধ করলো। সকাল প্রায় ১০টার দিকে, সে যখন উপরে সেলাইয়ের কাজ করছিল, কেইকিচির কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। যদিও দরজা খোলাই আছে, মনে হলো সে বাগানের দিক দিয়ে আসছে। তার কণ্ঠে ব্যস্ততা। “কিমিকো, কিমিকো!” মা ডাক দিলেন, “কেইকিচি এসেছে।”
কিমিকোর সূঁচ থেকে সুতো খুলে গিয়েছে। সে সেটা পিনকুশনে গেঁথে রাখল। “কিমিকো তো বলছিল, তোমার যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।” কেইকিচি যুদ্ধে যাচ্ছিল। “কিন্তু আমরাও তো তোমার আমন্ত্রণ ছাড়া যেতে পারি না, আর তুমিও আসোনি। আজ তোমার আসাটা খুব ভালো হয়েছে।”
তিনি তাকে দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু কেইকিচির ভীষণ তাড়া। “তাহলে অন্তত এই ডালিম ফল খেয়ে যাও। ওটা আমাদের নিজেদের গাছে ফলেছে। মা কিমিকোকে আবার ডাকলেন।
সে আড়চোখে তাকে অভ্যর্থনা জানাল, যেন সে আর অপেক্ষা করতে পারছিল না কিমিকোর নিচে নেমে আসার। কিমিকো সিঁড়িতেই থেমে গেল। কেইকিচির চোখে উষ্ণ কিছু একটা চলে এলো এবং ডালিম ফলটি হাতে থেকে পড়ে গেল।
তারা একে অপরের দিকে তাকাল এবং মৃদু হেসে উঠল। যখন কিমিকো বুঝল সে হাসছে, তখন লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কেইকিচি বারান্দা থেকে উঠে দাঁড়াল।
“নিজের যত্ন নিও, কিমিকো।”
“তুমিও।”
সে ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে।
কেইকিচি চলে যাওয়ার পরও কিমিকো বাগানের দরজা পর্যন্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। “কী তাড়াতাড়ি চলে গেল,” মা বললেন। “এত সুন্দর একটা ডালিম ফল!”
ফলটি সে বারান্দায় রেখে গেছে। সম্ভবত, সেই উষ্ণ আবেগ যখন তার চোখে এসে জমেছিল এবং সে ডালিমটি খুলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সেটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফলটি পুরোপুরি ভাঙেনি—হালকা ফেটে গিয়েছে এবং মাটি ছুঁয়ে পড়ে আছে, যেন তার লালচে রসে ভেজা বীজগুলো আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে আছে।
তার মা সেটিকে তুলে রান্নাঘর থেকে ধুয়ে এনে কিমিকোর হাতে দিলেন। কিমিকো একটু ভ্রূ কুঁচকে পিছিয়ে এল, তারপর আবার লজ্জায় লাল হয়ে কিছুটা দ্বিধায় ফলটি হাতে নিল। দেখে মনে হচ্ছে, কেইকিচি এক কোনা থেকে কিছু ডালিমের দানা খেয়ে গেছে।
মা যখন তাকিয়ে আছেন, তখন না খাওয়াটা অস্বাভাবিক হতো। কিমিকো নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একটা কিছু দানা মুখে নিয়ে কামড় দিল। টক স্বাদে মুখ ভরে গেল। মনে হল একধরনের দুঃখময় আনন্দ যেন গভীরে প্রবেশ করেছে। মা উদাসীনভাবে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আয়নার সামনে গিয়ে বসলেন। “আমার চুলের দিকে দেখ! আমি কেইচিকে এই বিধ্বস্ত চুল নিয়েই বিদায় জানালাম।” কিমিকো চিরুনি আঁচড়ানোর শব্দ শুনতে পেল।
“তোমার বাবা যখন মারা গেলেন,” মা নরম স্বরে বললেন, “আমি চুল আঁচড়াতে ভয় পেতাম। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভুলে যেতাম আমি কী করছি। হঠাৎ হুশ ফিরলে মনে হতো, যেন তোমার বাবা অপেক্ষা করছেন আমি শেষ করব বলে।”
কিমিকোর মনে পড়ল, তার মা বাবার প্লেটে পড়ে থাকা খাবার খেতেন। তার মনে হলো কিছু একটা ভেতর থেকে টানছে, একরকম সুখানুভূতি যা তাকে কাঁদিয়ে দিতে চায়। তার মা সম্ভবত ডালিমটি তাকে দিয়েছিলেন, কারণ ওটা ফেলে দিতে তার মনে সায় দিচ্ছিল না।
শুধু এই কারণে, কোন জিনিস ছুড়ে ফেলে না দেওয়াটা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ নিয়ে, কিমিকো তার মায়ের সামনে লজ্জা বোধ করছিল। তার মনে হলো, এ বিদায়টা হয়তো কেইকিচির ধারণার চেয়েও বেশি অর্থবহ—কেইকিচি ফিরে আসার জন্য সে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারবে।
সে মায়ের দিকে তাকাল। সূর্যের আলো পড়েছে কাগজের দরজার উপর, ওপারে মা আয়নার সামনে চুপচাপ বসে আছেন। কোন এক অজানা আশঙ্কায় কিমিকো ডালিমটিতে কামড় বসাতে ভয় পাচ্ছে।