Published : 18 Jun 2025, 12:25 AM
এরমধ্যে অন্য আরেকটা দিক থেকে হাঁক শোনা যায়। এবার ওরা চার বন্ধু একসাথে একদম স্পষ্ট শুনতে পায়। দেরি না করে মিঠু আবারও জবাব দেয়। মিঠুর হাঁকের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই, প্রথমবার ওরা যেদিকের হাঁক শুনতে পেয়েছিল সেদিক থেকে হাঁক আসে।
ওরা বুঝতে পারে দুদিক থেকে দুটি দল চার বন্ধুকে উদ্ধার করতে আসছে। মিঠু পরপর আরও একবার জোরে হাঁক দেয়। দুপক্ষের হাঁক-ডাকে এবার বনের কিছু প্রাণীও তাদের স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আশপাশে কেমন একটা শোরগোল পড়ে যায়। মাথার ওপর থাকা বানরগুলোও হইচই শুরু করে। তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত দেখায়। কিশোররা তাদের আশ্বস্ত করতে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে।
বৃষ্টি এখন পুরোপুরি থেমে গেছে। ঘন বনের গাছগাছালি উপরের দিকে গিয়ে ডালপালায় জড়াজড়ি করে আকাশকে ঢেকে দিয়েছে। তাই আকাশ পরিষ্কার হয়েছে কিনা বোঝা যায় না। তবে ঘন আঁধার কেমন একটু পাতলা হয়ে এসেছে। আবছা আলোতে আশপাশের অনেক কিছু এখন চোখে ধরা দেয়।
এসময় কোনোকিছু মনে পড়ার মতো করে হঠাৎ আদনানের মাথায় একটি জিনিস আসে। এমন একটি অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করা খুব দরকার। সে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ক্যামেরা অন করে ভিডিও করতে শুরু করে। ফ্ল্যাশ লাইট মুড অন করাই ছিলো। আলোর ঝলকানি চোখে পড়তেই সাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বানরটা মুখ তুলে তাকায়। কিন্তু তার হাতের কাজ বন্ধ হয় না। সাপের মাথাটা গাছের ডালের সাথে ঘষেই যাচ্ছে। ঘষে ঘষে সাপের মাথাটা তখন অনেকটাই থেঁতলে ও ক্ষয়ে গেছে।
বানরের অবস্থাও খারাপ। প্যাঁচানো সাপের চাপে তার সারা শরীর কুঁকড়ে আছে। জায়গায় জায়গায় হাড়-মাংস এক হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবু সে হার মানছে না। তবে মনে হচ্ছে সাপটার আর হার মানতে বেশি দেরি নেই। টপটপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। আদনান ভিডিও করা থামাচ্ছে না। সে শেষ পর্যন্ত ভিডিও ধারণ করে রাখতে চায়। একটি বানর কীভাবে তাদেরকে সাপের কামড় বা ছোবল থেকে বাঁচিয়েছে, সেটার সম্পূর্ণ প্রমাণ সে রাখতে চায়।
তাদের জন্য একটি বানর কীভাবে একটি বিষধর সাপের সাথে প্রাণপণ লড়াই করেছে, সেটা সে সবাইকে দেখাতে চায়। তবে এই লড়াইয়ের শেষ সময় প্রায় উপস্থিত। সাপের প্যাঁচ কিছুটা ঢিলে হয়ে এসেছে বলে দেখা যায়।
তখনই কাছাকাছি কোথাও থেকে হাঁক আসে। কিশোরদের কারও কারও নাম ধরে ডাক আসে। তাদের সংবিৎ ফিরে। তারা হাঁক-ডাকের দিক অনুসরণ করে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। গহনবনের অন্ধকার ভেদ করে বেশকিছু আলোক রেখা এসে চার বন্ধুর চোখে লাগে। ভিনগ্রহ থেকে নিজেদের গ্রহের কোনোকিছুর সাথে যেন তাদের প্রথম দেখা হয়। মিঠু খুশিতে গলা ছেড়ে সাড়া দেয়।
মিঠুর সাড়া পেয়ে একসাথে দুপাশ থেকে পুনরায় হাঁক-ডাক আসে। এদিক থেকে এবার চার বন্ধু একসাথে সমস্বরে চিৎকার করে সাড়া দেন। দুদিক থেকে এগিয়ে আসা আলোক রেখাগুলো এখন প্রায় আলোর ঝলকানি হয়ে ওঠে এবং সবার হাঁক-ডাক এবার গহনবনে শোরগোল ফেলে দেয়।
আদনানের ক্যামেরায় তখন দীর্ঘ এক অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক লড়াইয়ের অন্তিম দৃশ্য ধারণ চলছে। ধীরে ধীরে বানরের গা থেকে সাপের প্যাঁচ খুলে যাচ্ছে। সাপের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। সামান্য নড়াচড়াটুকু বন্ধ হতে আর বেশি দেরি নেই। বানরটাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। শরীর থেকে সাপের প্যাঁচ খুলে গেলেও, সাপের মাথা ধরে থাকা হাত দুটো ছাড়া সে আর কিছুই নাড়াতে পারছে না। সাপটা মরেই গেছে। তার পুরো শরীর এখন বানরের হাত থেকে ঝুলছে।
সাপের মাথা বলতে অবশিষ্ট আছে কেবল উপরের চ্যাপ্টা তালুর শক্ত অংশটা। মাথার বাকি অংশ বানরটা গাছের সাথে ঘষে ঘষে ক্ষয় করে ফেলেছে। এমন দৃশ্য যখন আদনানের ক্যামেরাবন্দি হচ্ছে তখন বানরের বীরত্বে উপস্থিত আশপাশের অন্যান্য বানরগুলো, খুশিতে নাচের মতো বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে আনন্দ প্রকাশ করছে। আদনান মোবাইলের ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেসব দৃশ্যও ধারণ করে। ওরা চার বন্ধুও সেসব আনন্দনৃত্যে যোগ দেয়। হাততালি দিয়ে জয়ী বানরকে বাহবা জানায়।
কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে তাদের সে হাততালিতে তেমন একটা আনন্দ বা খুশি প্রকাশ পায় না। হয়তো ওরা সাপটার মৃত্যুতে নিজেদের অজান্তেই দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়। ওদের কারণে এই সুন্দরবনে নিজেদের মতো করে সহাবস্থানে থাকা একটি প্রাণী আরেকটি প্রাণীর সাথে লড়াইয়ে নেমেছে। আর ওদেরকে বাঁচাতে গিয়ে সে লড়াইয়ে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলেছে। এমন একটি অনুশোচনা তাদের পীড়া দেয়। তারা খুশিতে লাগাম টানে, শেষ পর্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
কিশোর চার বন্ধুর এমন অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায় না। হাঁক-ডাকের সাড়া ফেলে, আলোর ঝলকানি তুলে, ওসি সাহেবের নেতৃত্বে থাকা দলটি এসে প্রথম হাজির হয়। তারা এসে নিচে জমায়েত হতেই বানরটি তার হাতে ধরে রাখা মৃত সাপটিকে নিচে ফেলে দেয়। ওপর থেকে সাপ পড়ার কাণ্ডে একজন পুলিশ কনস্টেবল ভয়ে চিৎকার দিয়ে পড়িমরি করে লাফিয়ে কয়েক হাত পিছিয়ে যায়।
এটা দেখে চার বন্ধু একসাথে ফিক করে না হেসে পারে না। ওপরে তাকিয়ে কিশোরদের হাসতে দেখে সবারই আনন্দ-খুশিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এতক্ষণের সব ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়। তারপর তারা একে একে চারজনকে গাছ থেকে নামিয়ে আনে।
এরই মধ্যে ফিরোজ সাহেবের নেতৃত্বে নৌপুলিশের দলটিও এসে উপস্থিত হয়। তারপরের ঘটনা খুব স্বাভাবিক ও অনুমেয়। ছেলেদেরকে বুকে জড়িয়ে নেন একে একে উপস্থিত অনেকেই। ইমরান ও মিঠুকে বুকে জড়িয়ে শিশির মামার কান্না, আবেগ তাড়িত করে সবাইকে। এ দৃশ্যে দু'একজনের চোখের কোণে আনন্দাশ্রুও চিকচিক করে ওঠে। অন্যরা তখন ঠান্ডা, ভয় ও ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়া চার কিশোরকে প্রাথমিক সেবা-যত্ন ও খাবার দিয়ে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে শুরু করেন।
আদনান ও জিসান এসবের ফাঁকে ওপরের দিকে একবার চোখ বোলায়। বিজয়ী বানরটাকে নিয়ে তখনো তাকিয়ে আছে অন্যান্য বানরগুলো। তারা হাত নেড়ে বানরদেরকে বিদায় জানায়। দু-একজন পুলিশের চোখ যায় তখন বানরের দিকে। তারা বানরগুলোকে তাড়িয়ে দিতে উদ্যত হলে জিসান তাদের থামিয়ে দেয়। সাপের সাথে যুদ্ধ করা বানরটাকে দেখিয়ে বলে, “জানেন, ওই বানরটার জন্যই হয়তো আমরা এখনো বেঁচে আছি। ও এমন বীরত্ব না দেখালে আপনারা হয়তো আমাদেরকে জীবিত উদ্ধার করতে পারতেন না।”
সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে চার কিশোর পর্যটককে সুন্দরবনের ঘন গহন অঞ্চল থেকে উদ্ধার করে ফিরতি পথ ধরেন। পুলিশের দল, পেশাদারিত্ব ও সাহসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চার কিশোরকে উদ্ধার করে ফিরে। কিন্তু চার বন্ধু, কিশোর বয়সের কৌতূহল মিটাতে পৃথিবীর সুবৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন দেখতে এসে একদিন একরাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় শত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে।
মৃত্যুর মুখ থেকে প্রাণে বেঁচে, বাকি জীবন গল্প করার মতো অনেক কিছু সঙ্গে নিয়ে ফিরে। জীবনে যত বড়ো বিপদই আসুক না কেন, হাল না ছাড়ার শিক্ষা নিয়ে ফিরে। বানরের কাছ থেকে পরোপকারে নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই করার মানসিকতা নিয়ে ফিরে। সর্বশেষ পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে পেশাদার মনোভাব নিয়ে ফিরে।
শরণখোলা থানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে পূর্ব আকাশ ফরসা হয়ে ভোরের আলো ফোটে ওঠে। অনুমিতভাবেই থানায় অপেক্ষারত পরিবারের সদস্যদের সাথেও কিশোরদের এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়। তারপর সবাই মিলে মিষ্টিমুখ করেন। রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করলে পুলিশ সদস্যদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পরিবারের লোকজন ছেলেদের নিয়ে রওয়ানা হন। ওসি সাহেব তাদেরকে বারবার বলে দেন- “কেউ এই বিষয় নিয়ে ছেলেদের সাথে কোনোপ্রকার রাগারাগি করবেন না এবং বেশিকিছু জিজ্ঞেস করবেন না। কথাটা মনে রাখবেন এবং মানবেন প্লিজ।”
এই উদ্ধার অভিযান নিয়ে ওসি সাহেব যে রিপোর্ট জমা দেন, তার শিরোনাম লিখেন- ‘অপারেশন সাউন্ড লাইট’।
সমাপ্ত