ধারাবাহিক উপন্যাস
Published : 10 May 2025, 11:03 PM
থানায় বসে থেকে আদনানের বাবা বারবার মোবাইল ফোনে আদনানের কাছে থাকা নম্বরে সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রতিবার যান্ত্রিক কণ্ঠ জানিয়ে দেয়, ‘সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ শেষবার ওসি সাহেবের সাথে যা কথা হয়েছিল, সেখান থেকে তারা যা জানিয়েছে তাই শেষ খবর। ‘ওরা চারজন একসাথে আছে এবং ভালো আছে’ ব্যস এটুকুই। বাড়ির লোকজনও তাই জানে। তারপর এখন পর্যন্ত আর কোনো খোঁজখবর নেই। তাদের অবস্থান এখন পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি।
তাদের ফোনে লোকেশন সেবা চালু না থাকায় বা নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় ট্র্যাকিং সম্ভব হচ্ছে না। ঈদের দিনের পর এতরাতে টেকনিক্যাল বিভাগে তেমন কেউ না থাকায় এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও সেখানে থাকা কর্তব্যরত লোকজন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় চার কিশোরের পরিবারের লোকজন ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে, আশা নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু থাকে না। আশঙ্কা ও উদ্বেগ নিয়ে হাহুতাশ করা ছাড়া। ক্ষণে ক্ষণে কান্না করে চোখের পানি ফেলার পাশাপাশি তারা তাই করছে। এসবের মাঝে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে তাদের আশঙ্কা, উদ্বেগ আরও বাড়ে।
এই বৃষ্টিতে গাড়ি নিয়ে আগানোও সম্ভব হয় না। তাই শরণখোলা থানার ডিউটি অফিসার হাবিব সাহেব তার দল নিয়ে ‘বিসমিল্লাহ স্টোর’-এ আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। ঈদের দিন ছিলো বলে এখনও কয়েকজন ক্রেতা দোকানে বসে গল্পগুজব করছে। পুলিশের লোকজন দেখে তারা সবাই সম্ভ্রম দেখায়, বসার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। হাবিব সাহেব দোকানিকে, ছয় কাপ রঙ চা দিতে বলেন। বৃষ্টির কবলে পড়ে ওসি সাহেবের দলেরও একই অবস্থা। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে ঠান্ডায় কেউ আর বনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে তারা রাস্তার পাশের টগড়া বাড়ি জামে মসজিদের বারান্দায় আশ্রয় নেন।
নৌপুলিশদের দলনেতা ফিরোজ সাহেবের ফোন আসে। ডাকাতদলের সাথে গোলাগুলি, একজন বাদে সব ডাকাতের পলায়ন, এক জেলেকে উদ্ধার ও ডাকাত কাম ট্রলারের মাঝিকে আহত অবস্থায় আটকের বিষয়টা সংক্ষেপে বলেন। তারপর তিনি ছোট্ট পর্যটকদলের বিষয়ে আপডেট জানতে চান। কিন্তু ওসি সাহেব কোনো আপডেট দিতে পারেন না। বরং ফিরোজ সাহেবের কাছ থেকে ঘটনা শুনে ছেলেদের নিয়ে তিনি আরও বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েন। বনের ভেতরে নৌকা নিয়ে ঘোরাফেরা করলে ওৎ পেতে থাকা এমন ডাকাতদলের নজরে পড়ে যাওয়াও বিচিত্র কোনো ঘটনা নয়। পর্যটকদল মাঝেমধ্যেই এরকম ডাকাতদের কবলে পড়ে জিম্মি হন।
‘তাছাড়া এই বৃষ্টিতে গহিন অন্ধকার বনে নিশ্চয়ই ওরা এখন খুব ভয় পাচ্ছে। অন্ধকারে বনের ভেতর কত কত হিংস্র জীব-জানোয়ার ঘুরে বেড়ায়, ডাকে। কোনো একটার সামনে পড়ে গেলে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। আর ভিজে গেলে এমনিতে ঠাণ্ডায়ও খুব কষ্ট পাবে’, ওসি সাহেব আর বেশি ভাবতে পারেন না। কিশোরদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সম্ভব হয় না। বৃষ্টিতে নেটওয়ার্ক বাধাগ্রস্ত হয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল, আর কোনো খোঁজ-খবর নেওয়া যায়নি। কীভাবে কী করছে ওরা, কিছুই জানা নেই।
বুকের ভেতর অস্থিরতা দানা বাঁধে। সাথে থাকা ইমরানের শিশির মামার কাঁধে হাত রাখেন ওসি সাহেব। নিজের অস্থিরতা দিয়ে শিশির মামার অবস্থাটাও অনুভব করেন হয়তো। কাঁধে হাত রেখে মামাকে ভরসা দেওয়ার নীরব আশ্বাস দেন। দুজনে মিলে ফোনে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে থাকেন। চেষ্টা করতে করতে ওসি সাহেব মসজিদের বারান্দায় পায়চারি করেন।
আধখোলা জানালা দিয়ে মসজিদের ভেতরে তার চোখ যায়। যা দেখেন তাতে মাথায় একটা বুদ্ধি, বাইরের বিদ্যুৎ চমকানোর মতো করে এক ঝলক খেলে যায়। তারপর তিনি সে বুদ্ধি খাটিয়ে ছেলেদের অবস্থান জানার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও দুটি সমস্যা উপস্থিত হয়। এক, বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে গেলে তাদেরকে কিছু সময়ের জন্য মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। মসজিদের দরজা তালাবদ্ধ। তিনি তখনই একজন পুলিশ সদস্যকে রেইনকোট পরে আশপাশে খোঁজ নিয়ে মসজিদ কমিটির কাউকে এনে দরজা খোলার ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে দেন। দুই, এই বুদ্ধিতে কাজ করতে গেলেও কিশোরদলের কারও সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলা দরকার। কিন্তু মোবাইলে তাদের কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টিতে তাদের মোবাইল ফোন দুটো ঠিক আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না!
ওপরের ডাল থেকে একটা সাপ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। সাপের পুরো শরীর দেখা যায় না, শুধু কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত অংশটুকুই দেখা যাচ্ছে। চোখ সয়ে আসা আবছায়া আলোয় দেখা যায়, সাপটার হিংস্র চোখ দুটো লোভে পিট পিট করে জ্বলছে। এই চোখের দিকে জিসান বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। সে ইমরান, আদনান ও মিঠুকেও ওপরে তাকাতে হাত দিয়ে খোঁচা দেয়। মুখ দিয়ে শব্দ করে ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু ওদের এদিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনজনই নিচের দিকে তন্ময় হয়ে কী যেন দেখছে। এমনভাবে দেখছে যেন দুনিয়ায় আর কোনোকিছুই ঘটছে না।
কিন্তু নিচু হয়ে থাকায় ওদের চোখে-মুখে কী খেলা করছে তা জিসান দেখতে ও বুঝতে পারে না। সে ওপরের দিকে মুখ করে আতঙ্ক ও আশঙ্কা নিয়ে সাপের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাপের চোখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারে না। সে স্থির ও অনড় হয়ে সাপটার একটু একটু করে এগিয়ে আসা দেখতে থাকে। এটা কী সাপ হতে পারে! চেনার চেষ্টা করে। সুন্দরবনে পৃথিবীর অন্যতম এক বিষধর সাপের বসবাস, কোনো এক বইয়ে পড়েছিল জিসান। কিন্তু সেই সাপের নামটা এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না। এটাই সেই ভয়ংকর বিষধর সাপ কি-না সেটাও বুঝতে পারছে না।
সাপটার গায়ের রঙ কালচে, ফণার ওপাশের রঙ কেমন দেখা যায় না। গোখরা, রাসেল ভাইপার, দাঁড়াশ, অজগরসহ আরও অনেক সাপের নাম মনে ভাসছে। ভয়ে ও উদ্বেগে এ মুহূর্তে সুন্দরবনের সেই বিষধর সাপের নামটা কী! তা মনে পড়ছে না। সময় যেন সাপের চোখে স্থির হয়ে আছে। সময়ও সাপটার মতো অথবা তার অনড় দৃষ্টির মতো থেমে আছে। কিন্তু জিসানের মন খচখচ করে। তার তিন বন্ধু এত মগ্ন হয়ে নিচে কী দেখে! সাপটা আর নড়ছে না বা এগিয়ে আসছে না। অনেকক্ষণ ধরে সাপটা স্থির হয়ে আছে। পাতা বেয়ে বৃষ্টির পানি, ফোঁটায় ফোঁটায় সাপের মাথায় পড়ে। শরীরে পড়ে।
বৃষ্টির পানি পড়ে জিসানের গায়েও। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন সাপের বিষবিন্দুর মতো জিসানের ঘাড়ে পড়ে, ঠান্ডা আর আতঙ্কে জড়সড় করে তোলে। সুযোগ বুঝে জিসান মাথা নিচু করে তিন বন্ধুর মাথার ফাঁক গলে নিচে মাটির দিকে তাকায়। তারপর ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে যা দেখে তাতে জিসানের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল ঠান্ডা স্রোত নিচের দিকে নামতে শুরু করে। তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। বুকে ঢিপ ঢিপ বাদ্য বাজে। তার বড় হয়ে যাওয়া চোখে নিচের বাঘটাকে যেন আরও বড় দেখায়। আর মনে পড়ে বড়দের কাছে গল্পে গল্পে শোনা ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়’। আজকের রাত এমন এক জায়গায় হয়েছে- যেখানে বাঘের ভয়, সাপের ভয় সব একসাথে এসে জুটেছে। এখানে উপরে-নিচে ডানে-বামে শুধু ভয় না, সাক্ষাৎ সব যমদূত।
বাঘটা তাদের গাছের নিচে অল্প একটু ফাঁকা জায়গায় তার স্বভাবজাত অভিজাত ভঙ্গিতে পায়চারি করে। থেকে থেকে তার চোখ ঠিকরে আলো বের হয়, জ্বলজ্বল করে। আর এমন ভঙ্গিতে হাঁটে- যেন বুঝতে পেরেছে, উপরে অসহায় শিকার, এত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। শিকারদের যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই, পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। একটুপর গাছের নিচে, যেখানে বৃষ্টির পানি কম পড়ছে, সেখানে গিয়ে বাঘটা গাছটাকে পেছনে রেখে সামনের দিকে মুখ করে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে।
চলবে...