Published : 16 Jun 2025, 04:26 PM
রাতে আরামদায়ক ঘুমের জন্য বিছানার চাদরের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা যে চাদরের ওপর ঘুমাই, সেই কাপড়টি যদি শরীর, পরিবেশ বা ঘুমের অভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে ভালো ঘুম পাওয়া কঠিন হতে পারে। তাই চাদর বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু রং বা নকশা নয়, উপাদান, বুনন পদ্ধতি এবং আঁশের ঘনত্ব সব কিছুই বিবেচনায় রাখতে হবে।
মাইক্রোফাইবার এবং তুলা দিয়ে তৈরি চাদরের মধ্যে কোনটি ভালো? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে কীভাবে ঘুমানোর হয়, ত্বকের প্রকৃতি কেমন এবং কোন বসবাসের পরিবেশ কেমন।
তুলার চাদর: প্রাকৃতিক ও আরামদায়ক
তুলা হচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আঁশজাত উপাদান। এটি প্রাকৃতিক, নরম এবং নিশ্বাস-নেওয়ার মতো গঠনবিশিষ্ট হওয়ায় সহজেই শরীরের বাতাস চলাচলে সহায়তা করে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিছানা সম্পর্কিত সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দ্য কোম্পানি স্টোর-এর পণ্য উন্নয়ন পরিচালক মেলানি ক্যাপলান রিয়েল সিম্পল ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানান, “তুলা মূলত সেলুলোজ দিয়ে তৈরি, যা তুলা গাছের ফল থেকে সংগ্রহ করা হয়।”
তুলার বিশেষ সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে এটি ত্বক-বান্ধব, নিঃশ্বাসযোগ্যতা (বাতাস চলাচলের সুবিধা) ও সহজ পরিষ্কারযোগ্যতা।
মেলানি ক্যাপলান আরও জানান, “তুলার চাদর বিভিন্ন ধরনের বুননে পাওয়া যায় যেমন পার্কেল, স্যাটিন, জার্সি নিট, ফ্ল্যানেল ইত্যাদি। যা বিভিন্ন ঋতু ও ব্যক্তিগত পছন্দের জন্য উপযুক্ত।"
তবে তুলার কিছু অসুবিধাও রয়েছে যেমন সহজেই এটি ভাঁজ পড়ে যেতে পারে। আবার নিম্নমানের তুলা দ্রুত ছিঁড়ে যেতে পারে বা বলক পড়তে পারে। তবে ভালো মানের তুলার চাদর বেশ ব্যয়বহুল।
বুননের ধরন ও আঁশঘনত্ব
বুননের ধরন ঘুমের সময় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। যারা গরম তাপমাত্রায় ঘুমান, তাদের জন্য পার্কেল বুনন উপযুক্ত, কারণ এটি বাতাস চলাচলে সহায়তা করে। ঠাণ্ডা পরিবেশে জার্সি বা ফ্ল্যানেল বেছে নেওয়া ভালো। মাঝামাঝি অবস্থায় স্যাটিন বুনন আরামদায়ক।
আঁশঘনত্ব মানে প্রতি বর্গইঞ্চিতে কতটি আঁশ আছে। বেশি আঁশঘনত্ব মানেই সবসময় ভালো নয়। কাপড়ের মান ও বুনন ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত আঁশঘনত্ব বেছে নেওয়াই শ্রেয়।
মাইক্রোফাইবার চাদর: সহজলভ্য ও মসৃণ
মাইক্রোফাইবার হলো একটি কৃত্রিম আঁশ, যা প্রধানত পলিয়েস্টার, নাইলন কিংবা কাঠের গুঁড়া থেকে তৈরি হয়। এই চাদরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সহজে ভাঁজ পড়ে না, ধোয়ার পরে আকার ছোট হয় না এবং অত্যন্ত মসৃণ ও কোমল অনুভূতি দেয়।
তুলার মতো মাইক্রোফাইবার চাদরেরও বিভিন্ন বুনন পদ্ধতি রয়েছে। পার্কেল বা স্যাটিন, যা ঘুমের সময় তাপমাত্রা ও আরামের ওপর প্রভাব ফেলে।
মাইক্রোফাইবারের অসুবিধা
মেলানি ক্যাপলান জানান, “মাইক্রোফাইবার চাদর গরম ধরে রাখে, তাই যারা অতিরিক্ত ঘামেন বা গরমে ঘুমান, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত নয়।”
আরেকটি বড় সমস্যা হলো পরিবেশগত দিক। ধোয়ার সময় এই চাদর থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়ায়, যা নদী, সমুদ্র এবং হ্রদে পৌঁছে জলজ পরিবেশের ক্ষতি করে। যদিও মাইক্রোপ্লাস্টিক ধরার জন্য ওয়াশিং মেশিনে আলাদা ফিল্টার ব্যবহার করা যায়, তবু এই উপাদানগুলো অজৈব এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিবেশে থেকে যায়।
তুলা বনাম মাইক্রোফাইবার: কোনটি শ্রেয়
কোমলতা
চাদরের কোমলতা ঘুমের মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উভয় উপাদানই কোমল হলেও শুরুতে মাইক্রোফাইবার তুলনায় বেশি ‘সিল্কি’ ও মসৃণ অনুভূতি দেয়। এটি পলিয়েস্টার, নাইলন কিংবা কাঠের পাল্প থেকে প্রস্তুত বলে এর তন্তুগুলো নিখুঁতভাবে কাটা ও মসৃণ হয়ে থাকে।
তবে তুলার এক বিশেষ গুণ হলো, এটি যত বেশি ধোয়া হয়, তত বেশি নরম হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সুপিমা কিংবা মিশরের উচ্চমানের তুলা দিয়ে তৈরি চাদর প্রতিবার ধোয়ার পর আরো কোমল হয়ে যায়। তবে নিচু মানের তুলা কিছুদিন ব্যবহারের পর তুলার আঁশ উঠে যেতে পারে।
নিঃশ্বাসযোগ্যতা
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এমন চাদর স্বাস্থ্যকর ঘুমে সহায়ক। এই দিক থেকে তুলা স্পষ্টভাবেই এগিয়ে। এর প্রাকৃতিক তন্তু বাতাস চলাচলের সুযোগ রাখে, ফলে অতিরিক্ত ঘাম বা গরম লাগার প্রবণতা কমে যায়। বিশেষ করে গ্রীষ্মপ্রধান দেশ যেমন বাংলাদেশে, তুলার চাদর শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে, মাইক্রোফাইবার চাদর অত্যন্ত ঘন এবং এতে বাতাস চলাচলের পথ রুদ্ধ থাকে। ফলে এটি গরম ধরে রাখে। যারা স্বভাবতই ‘হট স্লিপার’ অর্থাৎ ঘুমের সময় বেশি ঘেমে যান, তাদের জন্য মাইক্রোফাইবার আরামদায়ক নাও হতে পারে।
রক্ষণাবেক্ষণ
চাদর যত ভালোই হোক না কেন, যদি সেটি পরিষ্কার ও ব্যবহার উপযোগী রাখা কঠিন হয়, তবে তা দৈনন্দিন জীবনে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাইক্রোফাইবার চাদর সহজে ধোয়া যায় এবং সহজে শুকিয়ে যায়। এটি বলক পড়ে না এবং সাধারণত আকার ছোট হয়ে যায় না। এ ছাড়া এই চাদরগুলো আয়রন না করেও প্রায় সোজা থাকে, তাই ব্যবহারকারীকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না।
তবে তুলার ক্ষেত্রে একটু যত্ন দরকার হয়। তুলার চাদর ধোয়ার সময় সঠিক তাপমাত্রায় ধোয়া জরুরি, না হলে এটি সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে বা রং ফিকে হয়ে যেতে পারে। তবে ভালো মানের তুলা টেকসই এবং বারবার ধোয়ার পরও তা নরম এবং আরামদায়ক থাকে।
পরিবেশগত প্রভাব
বর্তমানে ক্রেতারা শুধু আরামের কথা নয় বরং পণ্যের পরিবেশগত প্রভাবও বিবেচনায় নেন। এই দিক থেকে তুলা নিঃসন্দেহে বেশি পরিবেশবান্ধব। এটি একটি পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং জৈবভাবে নষ্টযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশেষ করে জৈব তুলা চাষে কোনো ধরনের কীটনাশক, রাসায়নিক সার বা হার্বিসাইড ব্যবহার করা হয় না।
অন্যদিকে, মাইক্রোফাইবার চাদর একটি কৃত্রিম ফাইবার দ্বারা তৈরি যা ধোয়ার সময় অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা তৈরি করে। এই কণা পানি দিয়ে নদী, হ্রদ এবং মহাসাগরে প্রবাহিত হয়ে পরিবেশে ভয়াবহ দূষণ ঘটায়। এই ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায় এবং জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।