Published : 17 May 2025, 01:38 AM
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার ‘হস্তক্ষেপ বন্ধ’ হলেও ‘মবের’ হুমকির নতুন প্রবণতা দেখার কথা বলেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে তিনি বলেছেন, ‘মবের হুমকির’ কারণে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংশয়ে আছে; ফিরে এসেছে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’।
রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তার মধ্যে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন কামাল আহমেদ।
প্রায় চার দশক তিনি দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন, যার মধ্যে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস এবং জাতিসংঘ রেডিও রয়েছে।
ইনসাইড আউটের আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সমস্যা এবং কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশ; সম্পাদকীয় স্বাধীনতা এবং মালিকদের নিয়ন্ত্রণ; চাপ এবং সেন্সরশিপ; সাংবাদিকদের চাকরির অনিশ্চয়তা; প্রচার সংখ্যার ভূত এবং সংবাদপত্র ব্যবসার স্বচ্ছতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকীয় নেতৃত্বের কাছে তিনি শুনেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।
“৫ অগাস্টের আগে বিভিন্ন সময় সরকারের মন্ত্রীরা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষ করে নিরাপত্তা সংস্থা বা গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে টেলিফোন আসত- ‘এই শিরোনাম বদলান, এই শিরোনাম যাবে না, এই খবরটা দেখান, এই খবরটা যাবে না’।
“এখন সে ধরনের কোনো টেলিফোন আসছে না। কোনো জায়গা থেকেই না। সুতরাং সরকারের দিক থেকে এই যে হস্তক্ষেপটা বন্ধ হয়েছে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে, এটা এক বড় পবিবর্তন।”
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রতিবেদনে চলতি বছর বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর না থাকাকেও আরেকটি ‘ইতিবাচক পরিবর্তন’ হিসাবে তুলে ধরেন কামাল আহমেদ।
পরিবর্তনের এই সূচনাকে ধরে আরও অনেক দূর যেতে হবে মন্তব্য করে সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, “কেন যেতে হবে অনেক দূর? কারণ, এখনও পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের ওপরে এক ধরনের সেল্ফ সেন্সরশিপ, এটা রয়েছে। এবং এই সেল্ফ সেন্সরশিপের পেছনের কারণটা হচ্ছে যে, মানুষের মধ্যে, সংবাদকর্মীদের মধ্যে একটা ভয়, একটা অস্বস্তি, একটা অনিশ্চয়তার দোলাচল রয়েছে।”
এই ভয়টা কীসের? কামাল আহমেদ বলেন, “এই ভয়টা প্রধানত যেটা আসছে, সেটা হচ্ছে যে, হুমকি। শারীরিক লাঞ্ছনার হুমকি, পত্রিকা অফিসের সামনে কিংবা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সামনে হঠাৎ করে মব তৈরি হওয়ার হুমকি, সেই মব এসে এখানে জেয়াফতের মতো কাণ্ড করেছে। সেই মব এসে সেখানে বিক্ষোভ করেছে।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এসব হুমকি আসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেই যোগাযোগমাধ্যম থেকে বলা হচ্ছে, ‘তোমরা জুলাই স্পিরিটের বা গণঅভ্যুত্থানের যে চেতনা, সেই চেতনার পরিপন্থি কিছু করলে আমরা সেটা মেনে নেব না‘। ‘তোমাদের এই বক্তব্য, এটা ফ্যাসিস্টদের উৎসাহ দেয়, ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের চেষ্টা, আমরা এটা মানব না। আমরা আসছি’।
“এবং এ ধরনের হুমকি থেকেই কিন্তু আসলে ওই সেল্ফ সেন্সরশিপের ঘটনাটা আবার ফিরে আসছে।”
এই ‘অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা’ দূর করার ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে কামাল আহমেদ বলেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে দ্রুতই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। সেনাবাহিনী পর্যন্ত মোতায়েন করেছিল।
হুমকি আসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হুমকি মোকাবেলায় সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে কি-না, সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল কামাল আহমেদকে।
তিনি বলেন, “সেই প্রশ্ন নিশ্চয় রয়েছে। এবং আমরা আশা করব যে, সরকার এগুলো বন্ধ করার জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।”
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ (https://www.facebook.com/share/v/1ARgdnjXkY/) ও ইউটিউব চ্যানেলে (https://www.youtube.com/watch?v=Vrl81OGkhgo) অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
‘প্রশ্ন করে চাকরি গেল’
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে বাহাস ঘিরে তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির যে ঘটনা ঘটেছে, তার ফলে সৃষ্ট সংশয়ের নিরসন হওয়া দরকার বলে মনে করেন কামাল আহমেদ।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এ ধরনের ঘটনাগুলো কেন ঘটল, সেই কারণটা অনুসন্ধান করা জরুরি। এবং এ সম্পর্কে যে সংশয় তৈরি হচ্ছে, সেই সংশয় নিরসন করা দরকার। যদি সংশয়টা নিরসন না করা যায়, তাহলে এটাতে যেমন সরকারের ক্ষতি, তেমনি কিন্তু সাংবাদিকদেরও ক্ষতি।
“কারণ, সাংবাদিকদের মধ্যে ওই ভীতিটা কাজ করবে যে, আমাদের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে। আর সরকারের ক্ষেত্রে ক্ষতি হচ্ছে যে, সরকারের জন্যও এটা পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে যে, এই সরকারের সময়ে প্রশ্ন করার কারণে সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি ঘটেছে। দুটোর কোনোটি কারও জন্যই সুখকর নয়।”
নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সংশয় নিরসন করা দরকার মন্তব্য করে কমিশন প্রধান বলেন, “এ তদন্ত কে করবে? সরকার যদি তদন্ত করে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ‘ও আচ্ছা, সরকারকে বাঁচানোর জন্য… সরকারের পুলিশ তদন্ত করেছে’, কিংবা ‘সরকারের অমুক কর্মকর্তা তদন্ত করেছে’, এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না।”
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এ ধরনের ঘটনা নিরসনে স্থায়ী ‘গণমাধ্যম কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা তুলে ধরেন কামাল আহমেদ।
তিনি বলেন, “এখানে আসলে কী ঘটেছিল, এখানে সরকার কোনো ভুল করেছে? সরকারের দিক থেকে কোনো হস্তক্ষেপ ছিল কি-না? অথবা, এই সাংবাদিকদের মধ্যে, কোনো ধরনের—যে অভিযোগ উঠেছে যে, কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে–এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারকে বিব্রত করার একটা চেষ্টা ছিল—আদতে সে রকম কিছু ঘটেছে কি-না?
“কারণ, সে রকম কিছু ঘটে থাকলে সেটা সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থি হবে, অনৈতিক হবে। সেই রকম অনৈতিক কিছু ঘটেছে কি-না, সেটাও তারা নির্ধারণ করতে পারত। এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা সুপারিশ করতে পারত।”
সেই ব্যবস্থা কেমন হতে পারত, তার ব্যাখ্যা দিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, “এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পাদকীয় মানোন্নয়নের জন্য পরামর্শ দেওয়া, অথবা নির্দেশনা দেওয়া, অথবা জরিমানা করা- এই রকম কিছু একটা হত। কিন্তু এই বিতর্কের অবসান হওয়া দরকার এবং সেটার জন্য একটা কার্যকর ব্যবস্থা, পদ্ধতি অবশ্যই দ্রুত চালু হওয়া দরকার।”
‘বানোয়াট অভিযোগে হেনস্তা’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সাংবাদিকরা এর বিরুদ্ধে কোনো উসকানি দিয়ে থাকলে তার বিচারের পক্ষে বললেও হত্যার মত ‘বানোয়াট অপরাধ’ চাপিয়ে কাউকে আটক রাখাটা অন্যায় হবে বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান।
সরকার পরিবর্তনের পর অন্তত ২৬৬ জন সাংবাদিকের নামে মামলা হওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য অপরাধের অভিযোগ আছে, যে অপরাধের অভিযোগ আছে, সেই অপরাধে মামলা হোক, সেই অপরাধের তদন্ত হোক, সেই অপরাধের বিচার হোক।
“কিন্তু বানোয়াট অপরাধ চাপিয়ে দিয়ে কাউকে যদি আটক রাখা হয়, সেটা অন্যায় হবে এবং সেই অন্যায়ের প্রতিকার হওয়া উচিত।”
যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের সবাই সাংবাদিকতার জন্য মামলার শিকার হয়েছেন কি-না, সে প্রশ্নও করেন কামাল আহমেদ।
তিনি বলেন, “এই ২৬৬ জনের নামে যে মামলা হয়েছে, তার মধ্যে কতজন সাংবাদিক হিসাবে সাংবাদিকতার জন্য মামলার শিকার হয়েছেন, আর কতজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য মামলার শিকার হয়েছেন, সেটা কিন্তু আমরা জানি না।
“তাদের একটা পরিচয়ের কথাই বলা হচ্ছে যে, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা। কিন্তু এদের অনেকেরইতো দ্বৈত পরিচয় আছে। এদের অনেকেই কিন্তু ২৬ শে জুলাই গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বক্তৃতা করেছেন যে, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনি আরও শক্ত হোন’, ‘আপনার বাহিনী কেন এটা মোকাবেলা করতে পারছে না?’, ‘আপনাকে আরও শক্তি প্রয়োগ করতে হবে প্রয়োজনে’, ‘প্রয়োজনে আমরা মাঠে নামব’- এমন বক্তৃতাও করেছেন।”
এসব বক্তব্য যারা দিয়েছেন, তারা ‘শীর্ষস্থানীয়-সুপরিচিত সাংবাদিক’ ছিলেন বলে মন্তব্য করে কামাল আহমেদ বলেন, “কিন্তু তাদের বক্তব্যটা সাংবাদিকতার সাথে সম্পর্কিত নয়। ওটা পুরোপুরি রাজনৈতিক দলের কর্মীর বক্তব্য।
“এটা সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার মত অপরাধ। সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অপরাধে শাস্তি কিন্তু আছে, ফৌজদারি আইনে সেটা অপরাধ এবং সেই অপরাধের শাস্তি কী হবে, সেটা নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু দেওয়া হয়েছে হত্যা মামলা।”
সেই ‘অপরাধের’ অভিযোগ না এনে হত্যা মামলা দেওয়ায় সমালোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন, এই হত্যা মামলা দেওয়ার কারণেই কিন্তু একটা সমালোচনা হচ্ছে এবং সেই সমালোচনা অবশ্যই যৌক্তিক সমালোচনা। কারণ, যে অভিযোগের প্রমাণ নেই, বা যে অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য নয়, এমন অভিযোগে আপনি কাউকে আটকে রাখতে পারেন না।
“পুলিশের দিক থেকে সাধারণত এই কৌশল নেওয়া হয়, কাউকে দীর্ঘ মেয়াদে আটক রাখার জন্যই হত্যা মামলাটা দিয়ে দেওয়া হয়, এটা খুব সহজ। কিন্তু সেটা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত হয়নি। এবং সেটা দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার।”
সম্পাদকীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন ‘মালিকদের উদ্যোগে’
জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা অন্তর্বর্তী সরকারের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই গণমাধ্যম মালিকরা সম্পাদকীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন এনেছেন বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক কামাল আহমেদ।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “যখনই সরকার পরিবর্তন হয়, তখনই বার্তাকক্ষগুলোতে নেতৃত্বের পরিবর্তন আমরা দেখেছি। কারণ, এই পরিবর্তনগুলো হয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সাথে এক ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা থেকে।
“এবং সেই চেষ্টাটা কে করেন? কার নির্দেশে হয়? কার উদ্যোগে হয়? প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের উদ্যোগে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটির মালিকদের একেকটি স্বার্থ আছে। এবং তারা সেই স্বার্থ থেকে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান, লিয়াজোঁ প্রতিষ্ঠা করতে চান। এবং সেই লিয়াজোঁ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ওই দলের নেতাদের সাথে কার সম্পর্ক ভালো, তাকে আমাদের বার্তাকক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়।”
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ‘পুঞ্জীভূত ক্ষোভের’ কারণে এবার পরিবর্তনটা বেশি দৃশ্যমান হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
শুধু সম্পাদকীয় নেতৃত্বে এ পরিবর্তন আসার কথা তুলে ধরে কামাল আহমেদ বলেন, “বার্তাকক্ষগুলোতে পরিবর্তন আপনি লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু মালিকানায় পরিবর্তন হয়নি।”
‘ওয়ান হাউজ ওয়ান মিডিয়া’ কতটা বাস্তবসম্মত?
কোনো একটি কোম্পানির মালিকানায় কেবল একটি পত্রিকা বা টেলিভিশনই থাকতে পারবে–এমন নীতি প্রণয়নের সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা কতটা সম্ভব হবে, সেই প্রশ্নে কমিশন প্রধান বলেন, “এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই সম্ভব। সরকার এখনই একটা নীতি গ্রহণ করতে পারে এবং ঘোষণা দিতে পারে যে, এখন থেকে আর কাউকেই এই ক্রস-মিডিয়া ওনারশিপ বা মালিক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।
“অর্থাৎ এখন যদি কেউ পত্রিকার মালিক হন, দৈনিক পত্রিকার, তাহলে তিনি টেলিভিশনের মালিক হতে পারবেন না। আবার টেলিভিশনের মালিক দৈনিক পত্রিকার মালিক হতে পারবেন না। এখন থেকে নতুন যে কোনো আবেদনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম তারা কার্যকর করবেন। এটা হলো প্রথম সূচনা।”
বর্তমানে যেসব কোম্পানি একাধিক সংবাদমাধ্যমের মালিক, তাদের সেখান থেকে সরে আসতে সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন কামাল আহমেদ।
তিনি বলেন, “যেসব হাউজ এখনই আছে, একাধিক প্ল্যাটফর্মের মালিক, পত্রিকা প্রকাশিত হয়, টেলিভিশন আছে, রেডিও আছে, কিংবা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল আছে, কিংবা একাধিক একই ভাষার দৈনিক পত্রিকা আছে, তাদের জন্য সরকার একটা সময় নির্ধারণ করে দিতে পারে।
“সেই সময়টা এক বছর হতে পারে, সেই সময়টা ছয় মাস হতে পারে, সেই সময়টা দু’বছরও হতে পারে। এটা অংশীজনদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই করতে হবে।”
তিনি বলেন, “বিকল্প সমাধান হিসাবে, তারা তাদের যে মাধ্যমটা রাখতে চান, সেটা যদি টেলিভিশন হয়, টেলিভিশন রাখবেন; যদি দৈনিক পত্রিকা রাখতে চান দৈনিক পত্রিকা রাখবেন—অন্যটা ছেড়ে দেবেন। অথবা, এ দুটোর সম্মিলন ঘটিয়ে, মার্জার করে একটা বৃহত্তর টেলিভিশন করতে পারেন, অথবা একটা বৃহত্তর পত্রিকা করতে পারেন।”
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে নিউজ পেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (নোয়াব) সভাপতি এ কে আজাদ এমন প্রস্তাবে ‘সায় দিয়েছেন’ বলে জানান কামাল আহমেদ।
তিনি বলেন, “তার একটি টেলিভিশন চ্যানেল আছে, একটি দৈনিক পত্রিকা আছে, তিনি বলেছেন, তিনি একটা ছেড়ে দিতে রাজি। কিন্তু তিনি একটা শর্ত দিয়েছেন, সেই শর্ত হচ্ছে, স্বাধীনভাবে তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন কি-না, তিনি তার নিশ্চয়তা চান।
“তিনি নিশ্চয়তা চান যে, সেখানে কোনো সংস্থা থেকে ফোন আসবে না, সেখানে কোনো মহল থেকে তাকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চাপ দেওয়া হবে না।”
কামাল আহমেদ বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠানকে আমরা বন্ধ করতে বলিনি। আমরা বলেছি, ব্যবসাকে রিঅর্গানাইজ করার কথা। আপনি একটা রেখে আরেকটা ছেড়ে দিন।”
শেয়ারবাজারে গণমাধ্যমের তালিকাভুক্তি সম্ভব?
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।
ব্যাংক দখল হয়ে যাওয়ার যে ইতিহাস বাংলাদেশে আছে, সেই প্রেক্ষাপটে শেয়ার বাজারে গণমাধ্যমের তালিকাভুক্তি কেমন ফল দেবে, এমন প্রশ্ন করা হয় কমিশন প্রধানকে।
উত্তরে তিনি বলেন, ব্যাংক দখল হয়ে যাওয়ার ঘটনা সুশাসনের সমস্যা। দেশে আইন আছে, আইনের প্রয়োগ নেই।
“সেই আইন প্রয়োগ হয়, নিজের মতন, ব্যক্তির ইচ্ছামতন। এটা স্বেচ্ছাচারের ওপর নির্ভরশীল ছিল অনেকটাই। সরকার চেয়েছে বলে এটা (ব্যাংক দখল) হয়েছে। সরকার না চাইলে এভাবে দখল হত না।”
‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসন’ থাকলে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির নীতি কার্যকর করা সম্ভব মন্তব্য করে তিনি বলেন, “গণমাধ্যম কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসাবে বলা হচ্ছে যে, এই কোম্পানিগুলো লাভজনক নয়।
“গণমাধ্যম হচ্ছে রুগ্ন খাত, এখানে মুনাফা হয় না; সুতরাং বিনিয়োগকারীরা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হবেন না এবং সে কারণে এই সমাধান বাস্তবসম্মত নয়; এটা খুব আদর্শবাদী একটা সুপারিশ, প্রকৃত সমস্যার সমাধান করবে না–এমন সমালোচনা এসেছে।”
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের কাছ থেকে অন্তত দেড় ডজন গণমাধ্যমের লাভে থাকার তথ্য পাওয়ার কথা তুলে ধরে কামাল আহমেদ বলেন, “গণমাধ্যম কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষাকৃত হিসাব যাচাই করে দেখেছি। এই নিরীক্ষাকৃত হিসাব যাচাই করে আমরা দেখেছি, অন্তত দেড় ডজন প্রতিষ্ঠান যারা মুনাফা করে।
“অতএব এখানে ভালো প্রতিষ্ঠানের, সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানের, মুনাফার ভিত্তিতে চলার সম্ভাবনা এখনও আছে, বাস্তবতা এখনও আছে। এবং এসব প্রতিষ্ঠান যদি শেয়ারবাজারে শেয়ার ছাড়ে, তাহলে বিনিয়োগকারী পেতে সমস্যা হওয়ার কথা না।”
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বলছি এটা এই কারণে যে, মালিকদেরও এক ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা দরকার। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। কার স্বার্থে এই গণমাধ্যম, কার স্বার্থে এই প্রতিষ্ঠান- এটা যারা আমরা ভোক্তা, পাঠক-শ্রোতা-দর্শক, এটা আমাদের জানার অধিকার আছে। সেই জানার অধিকার আছে বলেই আমরা এগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
“আমরা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে প্রতিবছর আপনাকে নিরীক্ষাকৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে, আপনাকে শেয়ারহোল্ডারদের বার্ষিক সাধারণ সভা করতে হবে। সেখানে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে যে, তার নীতি ঠিক ছিল, কি ভুল ছিল। তারা সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছেন, বিরোধীদলকে ক্ষুব্ধ করেছেন; অথবা বিরোধীদলের দালালি করেছেন, সরকারকে ক্ষুব্ধ করেছেন… ভারসাম্যপূর্ণ, পেশাদারত্বের অভাব ছিল কি-না- এগুলোর সবগুলোর জবাবদিহি কিন্তু ওখানে করতে হয়।”
বিভিন্ন দেশে বড় বড় সংবাদমাধ্যমের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা তুলে ধরে কমিশন প্রধান বলেন, তাদের শেয়ারধারীরা জানতে পারে, ওই পত্রিকার আয়-ব্যয় কী রকম। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা জানতে পারি না। আমাদের দেশে এত মিডিয়া হাউজ হয়, বা হয়েছে, তাদের বিনিয়োগ কোথা থেকে আসছে, আমরা কি তা জানি? এই টাকার তারা কর দিয়েছেন কি-না।
তালিকায় সাড়ে ছয়শ, বিক্রি হয় ৫২টি
সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের যে তালিকাভুক্তি, তাকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান।
তিনি বলেন, “এই যে মিডিয়া লিস্টিং, সেটা ত্রুটিপূর্ণ এবং জালিয়াতিপূর্ণ। আমরা দেখেছি হিসাব করে যে, সরকারের বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য মিডিয়া তালিকাভুক্ত করতে হয় এবং মিডিয়া তালিকাভুক্ত করেছে সে কারণে ছয়শর উপরে পত্রিকা শুধুমাত্র ঢাকা শহরে। সারা দেশের সংখ্যা আরও অনেক বেশি, সাড়ে তিন হাজারের মত বোধহয়।
“ঢাকা শহরে যে ছয়শর বেশি পত্রিকা, এই পত্রিকাগুলোর ঘোষিত প্রচার সংখ্যার যোগফল দিয়ে আমরা দেখেছি, দেড় কোটির উপরে, এক কোটি ৫১ লাখ পত্রিকা দৈনিক প্রকাশিত হয়ে সার্কুলেশনে আছে, বা বিতরণ হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? যদি সেটা বাস্তব হত, তাহলে প্রতি ঘরে, এমনকি বাচ্চাদের নামেও একটা পত্রিকা প্রতিদিন কিনতে হত।”
ঢাকা শহরে সংবাদপত্র বিক্রি ও বিতরণের কাজে জড়িত দুই হকার সমিতিতে খোঁজখবর করার কথা তুলে ধরে কামাল আহমেদ বলেন, “তাদের কাছে বিক্রিত কাগজের রসিদ দেখেছি তিন মাসে তিনটি র্যান্ডম ডেট বেছে নিয়ে। সেই তিনটি ডেটের রসিদ দেখেছি, সর্বোচ্চ ৫২টা কাগজ মানুষ পয়সা দিয়ে কেনে।
“আর অন্য কোনো কাগজ তারা বিক্রি করে না, ওই তালিকায় নেই। এই বাকি ৫৪৮টা কাগজ, এই কাগজ কেন প্রকাশিত হয়? এই ৫৪৮টা কাগজ প্রকাশিত হয় সরকারি বিজ্ঞাপনে ভাগ বসানোর জন্য। এবং ওই সরকারি বিজ্ঞাপনে ভাগ বসিয়ে তারা আসলে এই ৫২টি পত্রিকার ক্ষতি করছেন। আমরা এটা সংশোধনের জন্য বলেছি।”
অডিট ব্যুরো অব সার্কুলেশন এক্ষেত্রে ‘দুর্নীতি করছে’ মন্তব্য করে কামাল আহমেদ বলেন, এই ব্যুরোর পরিদর্শন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন সাংবাদিক ইউনিয়নের কয়েকজন প্রতিনিধি। তারা সবাই যোগসাজশ করে এই ভুয়া সার্টিফিকেট দেন।
“আমরা বলেছি, এই যাচাই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। আমরা সবাই যাতে জানতে পারি যে, আসলে যে সংখ্যা ঘোষণা করা হচ্ছে, এই সংখ্যাটা সঠিক কি-না।”
এক্ষেত্রে সংবাদপত্র, সরকারের ব্যুরো, বিজ্ঞাপনদাতা এজেন্সি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির মাধ্যমে নিরীক্ষার সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেই নিরীক্ষায় প্রেসে গিয়ে ছাপার সংখ্যা যেমন দেখবে, তেমনি বিক্রিত কাগজের রসিদ যাচাই করে দেখবে।
“বিক্রিত কাগজের সংখ্যা যদি ঘোষিত সংখ্যার সাথে না মেলে, তাহলে সেই পত্রিকার সার্কুলেশন সংখ্যা সরকারি হিসাবে গৃহীত হবে না, গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ বিক্রিত পত্রিকার হিসাবের ভিত্তিতেই এই তালিকা তৈরি করতে হবে।”
অনলাইন সংবাদপত্রে ‘নৈরাজ্য’
অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে ‘নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি’ চলছে মন্তব্য করে এক প্রশ্নের উত্তরে কামাল আহমেদ বলেন, সাড়ে তিন হাজার অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে সরকারি নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
“এদের মধ্যে কয় ডজন অনলাইন পোর্টালের সংবাদমাধ্যম হিসাবে কাজ করার যোগ্যতা, সামর্থ্য, দক্ষতা আছে? আমরা বলেছি, অনলাইন পোর্টালকে আপনি যদি গণমাধ্যম হিসাবে নিবন্ধন দিতে চান, তাহলে এখানে একটা পূর্বশর্ত নির্ধারণ করা দরকার।
“প্রকাশকের পূর্ব যোগ্যতা নির্ধারণ করা দরকার। সেটা হচ্ছে, একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য যেই বার্তাকক্ষের দরকার হয়, যে ধরনের শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, ঠিক একই ধরনের শর্তপূরণ সাপেক্ষেই আপনি একটি অনলাইন পোর্টালকে গণমাধ্যমের স্বীকৃতি দিতে পারেন।”
তিনি বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ একটা অনলাইন পোর্টাল করতে পারে। কিন্তু সেটা গণমাধ্যম নয়। এবং গণমাধ্যমের জন্য সরকারের যে নীতিগত সহায়তা, বা সরকারের করনীতির সহায়তা, সে সমস্ত কোনো কিছুই পাওয়ার জন্য তারা যোগ্য হবে না, যদি ওই শর্তগুলো তারা পূরণ না করে।”
ইতোমধ্যে যাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই শর্তগুলো পর্যালোচনার সুপারিশ করেন কামাল আহমেদ।
বিগত সরকারের আমলে ‘রাজনৈতিক কারণ এবং ব্যক্তি যোগাযোগের ভিত্তিতে’ অনেক অনলাইন পোর্টালকে যে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল, সে কথাও তিনি বলেন।
সেসব পোর্টালকে এখন নিয়মের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, এ কাজটি যেন সরকার এককভাবে না করে।
“কারণ সরকার যদি করে, সরকারের হাতে যদি এই ক্ষমতাটা থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, সেই রাজনৈতিক দল ওই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আবারও সেই পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে যাবে।
“তাদের অনুগতদেরকে সুবিধা দেবে। এবং একই বৃত্তে আমরা ফিরে যাব। সে কারণে আমরা বলেছি যে, এই যাচাই প্রক্রিয়াটাও স্বচ্ছ হতে হবে এবং এখানে নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ থাকতে হবে।”
টিআরপির তথ্য ‘ভৌতিক’
পাঁচ হাজার রিসিভার থেকে টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) নির্ধারণ করার কথা থাকলেও এখন মাত্র ৩০০টি দিয়ে সে কাজ করার কারণে এটাকে ‘ভৌতিক’ বলছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ।
পত্রিকার সার্কুলেশনের মত এক্ষেত্রেও নাগরিক সমাজকে নিয়ে অংশীজনদের মাধ্যমে নিরীক্ষার সুপারিশ করার কথা বলেছেন তিনি।
টিআরপি রেটিং নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “টিআরপি আগে একটি বেসরকারি কোম্পানি করত। টিআরপির ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞাপনদাতারা সিদ্ধান্ত নেয়, কোন টেলিভিশনে কখন কোন বিজ্ঞাপন দেবে। বেসরকারি খাতের যে কোম্পানি এই টিআরপির বিষয়টি দেখভাল করত, তাদের কাজে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।”
কামাল আহমেদ বলেন, ওই সময়ে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) সরকারকে প্রস্তাব দেয় যে, তারাই কাজটি করতে পারে। তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি হয় এবং সেই চুক্তির ভিত্তিতে তারা এই টিআরপির কাজটা করছে।
কিন্তু যত সংখ্যক রিসিভারের ভিত্তিতে টিআরপি নির্ধারণের চুক্তি হয়েছিল, সেটা মানা হয়নি জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, “কত লোক কী প্রোগ্রাম দেখছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিয়েছিল, বা চুক্তি করেছিল, সে অনুযায়ী তারা কাজটি করতে পারেনি।
“মাত্র দুশ রিসিভারের ভিত্তিতে টিআরপি রেটিং নির্ধারণ করত। আমরা যেদিন এই কমিশনের রিপোর্ট জমা দিয়েছি, সেদিন পর্যন্ত তাদের সেই রিসিভারের সংখ্যা মাত্র তিনশ হয়েছে। কিন্তু তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে প্রথম বছরেই ৫০০০ হাজার রিসিভার দিয়ে এই টিআরপি রেট নির্ধারণ হবে। কোথায় পাঁচ হাজার, আর কোথা দুশ বা তিনশ?”
যে তিনশ রিসিভার বসানো হয়েছে, সেগুলোও ‘যথাযথভাবে’ বসানো হয়নি জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, “যে সংখ্যায় একটা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উপাত্ত পাওয়া সম্ভব, সেই সংখ্যায় রিসিভার দেয়নি, তার মাত্র একটা ভগ্নাংশ দিয়ে এই রেটিংটা তারা চালিয়ে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এটাকে ভৌতিক বলা ছাড়া আর কিছু বলা সম্ভব না।”
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে?
কামাল আহমেদ আশা করছেন, কমিশন থেকে যেসব সুপারিশ তারা করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি তাদের পর আসা সরকারও কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে।
তিনি বলেন, “সরকারের দিক থেকে কয়েকটি বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা আমাদের জানানো হয়েছে। শুধু আমাদেরকে না, প্রকাশ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন।”
প্রধান উপদেষ্টার কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও সুপারিশের সঙ্গে ‘সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন’ এবং ‘গণমাধ্যমে কমিশন অধ্যাদেশ’-এর খসড়াও জমা দিয়েছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। এগুলো চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সরকারের সায় পাওয়ার কথা বলেছেন কমিশন প্রধান।
তিনি বলেন, “দুইটা আইন করে দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাংবাদিকতার সুরক্ষা আইন যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি-না, সেটা তদারকিতে ওই গণমাধ্যম কমিশনের কিছু ভূমিকা আছে। সে কারণে গণমাধ্যম কমিশনও একইসময়ে হওয়া দরকার।
“আমরা সেটা সরকারকে বলেছি। সরকার বলেছে যে, তারা সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইনটা করার জন্য চেষ্টা করছে এবং ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তারা মতামত নেওয়ার জন্য বলেছে যে, তাদের কোনো মতামত আছে কি-না, ত্রুটি আছে কি-না, কোনো আইনগত ফাঁকফোকর থাকলে সেগুলো খুঁজে বের করার জন্য।”
কামাল আহমেদ বলেন, “গণমাধ্যম কমিশনের বিষয়েও অধ্যাদেশের খসড়া আমরা দিয়েছি, সেটার বিষয়েও তারা বলেছেন, সেটা নিয়ে তারা আলোচনা শুরু করবেন।
কমিশনের সুপারিশ তুলে ধরে কামাল আহমেদ বলেন, “আমরা বলেছি, সাংবাদিকদের পাশাপাশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেরও আর্থিক নিশ্চয়তা দরকার, যাতে তারা টিকে থাকতে পারে। অর্থাৎ টেকসই মডেল একটা দরকার। সে কারণে আমরা বলেছি যে, সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়িয়ে দিন।
“২০১৪ সালের পরে সরকারের বিজ্ঞাপনের রেট বাড়েনি। কিন্তু গত ১০ বছরে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি। সে হিসাবে এই ১০ বছরে বিজ্ঞাপনের রেট দ্বিগুণ হওয়া উচিত। সরকার বলেছে সরকার সেটা করবে।”
তিনি বলেন, বেতার-টেলিভিশনের একীভূতকরণের বিষয়েও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, সরকার এটা করতে চায়।
“সুতরাং আমার ধারণা, এই অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা হলেও কাজ এগিয়ে নিতে পারবে। পুরোপুরি কতটুকু সম্পন্ন করতে পারবে, আমি নিশ্চিত নই। তবে, বাকিটা নির্বাচিত সরকার আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবে, সেটা তাদের উপর নির্ভর করবে।”