Published : 17 May 2025, 09:40 AM
দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যখন দুর্নীতির দায়ে প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্নীতি একটা স্বাভাবিক আচারে পরিণত হয়েছে সর্বত্র। উন্নয়নের নামে শত শত প্রকল্প, হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ বিফলে যাচ্ছে। উল্লেখ করার মতো কোনো অর্জন নেই বললেই চলে। যে কোনো কাজে জনসাধারণকে কাঠখড় পোড়াতে পোড়াতে নিজ বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলতে হয়, তবু কামিয়াব হবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সচিবালয়কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তো আমজনতার কোনো কাজ দূর, প্রবেশই দুস্তর পারাবার।
এর বিপরীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কোনো বিশেষ বরাদ্দ ছাড়াই জনবান্ধব ও সাধারণের স্বার্থরক্ষা করে এমন অনেক নিয়ম-নীতির প্রবর্তন করেছে। সাধারণ মানুষ আজ চাইলে ঘরে বসে কর দিতে পারছে। আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর প্রয়োগ ও আদায়ে এই ভূমিকা রাখার পাশাপাশি তারা সাধারণের জন্য সর্বদাই উন্মুক্ত অবারিত ছিল। আমলাতান্ত্রিক, উন্নয়ন প্রতিবন্ধী ও জনবিমুখ কোনো দিনই ছিল না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
এই বাস্তবতার বাইরে গিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এমন নিখরচায় (বাড়তি কোনো বরাদ্দ বা বিশেষ প্রকল্প ব্যয় ছাড়া) সাফল্য উপেক্ষা করে তাদের সঙ্গে বৃহত্তর আঙ্গিকে মতবিনিময় ছাড়া অকস্মাৎ রাতের আঁধারে এমন সংস্কার কখনোই ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। এহেন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সরকারের একটা শীর্ষ সফল প্রতিষ্ঠানকে দুমড়ে দেয়ার প্রচেষ্টাই ফুটে ওঠে। নিয়ত ও বক্তব্য যতই মহৎ হোক, রাতের আঁধারে জনসম্পৃক্তি বিবর্জিত (জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বস্তরের সম্পৃক্তি পরিপূর্ণ উপেক্ষা করে) নিয়মের খড়গ নামিয়ে দেয়া– সর্বোচ্চ মহৎ নিয়তটিকেও ভূলুণ্ঠিত করে, লক্ষ্যচ্যুত করে। আপাত বিবেচনায় এমন সংস্কার ঘোষণা দেশের শীর্ষ সফল একটি প্রতিষ্ঠানকে তার সাফল্যের পথ থেকে বলপ্রয়োগে নামিয়ে দেয়া বা থামিয়ে দেয়ার প্রয়াস বলেই ধরে নিতে হচ্ছে। উদ্দেশ্য সৎ হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কাজটা হতে পারত। নির্মোহ ও জনমুখী বিবেচনায় বিস্তৃত আঙ্গিকে এর স্টেকহোল্ডারদেরও এই আলাপ-আলোচনায় সম্পৃক্ত করা যেত। কেননা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের যুগ-যুগ ধরে যত সাফল্য ও অর্জন তা এর অন্তর্গত জনবলের দ্বারাই অর্জিত, এমন অকস্মাৎ পরিবর্তনের খড়গ নামিয়ে দেয়া কর্তৃপক্ষের কারোই তাতে কিছুমাত্র অবদান নেই, ছিল না। তো এমন এলিয়েন হস্তক্ষেপ কি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রণোদনা হবে? নাকি নিরুৎসাহিত ও হতাশ করার জোরালো কারণ হবে?
ওপরের বিষয়গুলো বাদে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নতুন পদ্ধতির জন-গণবিমুখতা। এবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও সচিবালয়ের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা দুর্গ হয়ে উঠবে। সাধারণের সম্পৃক্তি হারানোর ফলশ্রুতিতে দীর্ঘকাল ধরে জনমুখী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জনবিমুখ একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা মানে যে কোনো উদ্যোগে ইতিবাচক ফলাফল উঠে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা বাস্তবসম্মত নয় এমন সব নীতিমালা প্রণয়নের আশঙ্কা জোরালো করা।
এসবের সঙ্গে আরো নেতিবাচক প্রভাব রাখবে বিদ্যমান কর্মীকাঠামোর বাইরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতির পথ রহিত করে অন্য বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগের নীতিমালা। যে কোনো প্রয়োজনে সরকারের অন্য যে কোনো সংস্থা বা বিভাগের সঙ্গে যৌথ কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগ সবসময়ই থাকতে পারে, পারত, পারবে। কিন্তু অন্যত্র থেকে সরাসরি নিয়োগ আসলে আগামীতে রাতের আঁধারে অকস্মাৎ কোনো নতুন নিয়মনীতি জারি করে বিশেষ কোনো শ্রেণি-গোষ্ঠীর ফায়দা লোটার সুযোগ করে দেয়ার নজির তৈরি করবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টা গোচরে এলে অকস্মাৎ নিয়োগ দেয়া লোকজনকে আবার অকস্মাৎ সরিয়ে নেয়া হবে। এসব এদেশের আপামর জনসাধারণই যেখানে বুঝতে সক্ষম, সেখানে নিয়ম-নীতির প্রয়োগকারীরা যে বোঝেন না, তা নয়। বরং বেশ ভালো বোঝেন বলেই এই সুযোগের ক্ষেত্রটি তৈরি করে নিচ্ছেন, তাই কি?
এমনিতেই আমাদের দেশের মতো সদ্য উন্নয়নশীল তকমা পাওয়া দেশের জন্য পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, সুদের হার এসব বিবিধ পরিবর্তনের পাশাপাশি বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহের সাত রাজ্যের বাহানা ও শর্তের মারপ্যাঁচ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার পথ আরো কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে, হবে। এর মধ্যে দেশের সফল একটা প্রতিষ্ঠানকে হ্যাচকা টানে দৌড় থামিয়ে পরিবর্তনের লাগাম পরিয়ে দেয়ার পেছনে আন্তর্জাতিক স্বার্থগুলো খুঁজে দেখাও দেশের সকল অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ ও চিন্তকদের অতীব জরুরি দায়িত্ব।
পরিবর্তন আসবে, সকল কিছুতেই আসবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন একটা অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া-প্রকরণ। কিন্তু সেই পরিবর্তনটা স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হতে না দেয়া ইতিবাচক পরিবর্তন পরিপন্থী। সর্বোপরি মনে রাখা দরকার যে উপেক্ষা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রভাব রাখার বিষ। সেই উপেক্ষা যদি কোনো অর্থকরী বা প্রবৃদ্ধি অর্জনকারীর প্রতি হয়, তখন সঙ্কটটিও সেই মাত্রায় শঙ্কার।