Published : 02 Jun 2025, 08:14 PM
“সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। গত এক দশক ধরে দেখা গেছে বরাদ্দ বাজেটের গড়ে ৭৮ শতাংশ খরচ হয়েছে।” কয়েক মাস আগে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান একটি ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে এমনটাই বলছিলেন।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অদক্ষতা ও অর্থায়নের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন বাস্তবায়ন গড় থেকে কমে ৭২ শতাংশ হতে দেখা গেছে। গেল অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ ছিল ২,৬৫,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু পরে এডিপির খরচ কমিয়ে ২,১৬,০০০ টাকা ধরা হয়। ওই অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করেছে বরাদ্দের মাত্র ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন। গত মাসের ১৯ তারিখে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকেই সবাই প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী করছেন। তবে বাংলাদেশে এডিপি বাস্তবায়নের হার সবসময়ই কম ছিল। অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার তথ্য বিকৃত করে ও অতি উচ্চ মাত্রার খরচ (যেটিকে সরাসরি দুর্নীতি বলা চলে) দেখিয়ে উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন বেশি বেশি করে দেখাত বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৮০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এটি গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। মোট ২ লাখ ৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। বরাদ্দের ১৯ শতাংশেরও বেশি অর্থ শেষ পর্যন্ত অব্যবহৃত থেকেছে। বছরটিতে এডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।
কেন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ছে না?
কয়েক বছর আগে, ইন্টান্যাশনাল স্টাডিজ কোয়ার্টার্লি সাময়িকীতে তিনজন গবেষক উন্নয়নশীল দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হবার পেছনে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও ব্যাংকগুলোকে মূলত দায়ী করেছেন। ‘Aiming Wrong Targets: The Domestic Consequences of International Efforts to Build Institutions’ প্রবন্ধে ক্যালিফের্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্তা বারবারা ক্যাম্পাসের মার্ক টি. বানটেইন, স্টান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঞ্জামিন পি. বাক ও উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি কলেজের ব্র্যাডলি সি পার্ক্স বলছেন, প্রকৃত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণের পরিবর্তে এসব আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ‘প্রসাধনী’ পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বা কর্মদক্ষতা সেভাবে বাড়ছে না।
এর গবেষকগণ বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো চুরি হওয়া সরকারি তহবিল সনাক্ত বা পুনরুদ্ধার করার কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই দুর্নীতি দমন কমিশন তৈরি করে। তারা এমন আইন প্রণয়ন করে যা কিনা মানব পাচারে অপরাধী চক্র গড়ে তোলে আর আসল যে উদ্দেশ্য– পাচারকারীর তদন্ত বা বিচার, তা করতে করতে ব্যর্থ হয়। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করার আইনি প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য ওয়ান-স্টপ-সার্ভিস তৈরি করে কিন্তু কোনও ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ কী তা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। একইভাবে, তারা আদালত প্রতিষ্ঠা করে এবং বিচারককে নিয়োগ করে কিন্তু বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপকে মোকাবিলা করতে পারে না–‘উন্নয়নশীল দেশে বিচার বিভাগ তেমন স্বাধীন নয়।’
এই গবেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের উন্নয়নশীল দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা না বাড়িয়ে তা বরং কমিয়ে দেয়। তারা টার্গেট দেশে প্রতিষ্ঠানের গঠনকে উৎসাহিত করে কিন্তু তার কর্মক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দেয় না। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত অক্ষমই রয়ে যায়। যেসব উন্নয়নশীল দেশ অনুদান পাওয়ার যোগ্য এবং বাজার হারের নিচে ঋণ নেয় তাদের প্রকল্পের লক্ষ্য পূরণের জন্য উন্নয়নকামীরা খুবই উৎসাহিত। কেননা লক্ষ্য পূরণ হলেই তারা আবারও ঋণ নিতে পারবে। ফলে যা হয়, তাহলো তারা প্রায়শই সহজ লক্ষ্য নির্বাচন করে এবং দিনশেষে উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে দেখায় যে তারা পারঙ্গম। কিন্তু প্রকল্পে চ্যালেঞ্জিং বিষয় না থাকায় জনগণের প্রকৃত সমস্যা সমাধান হচ্ছে কি না তা ধোঁয়াশাতেই থেকে যায়। আর, এদিকে, যে দেশগুলো এই ধরণের শিথিল অর্থায়ন গ্রহণ করে না তারা কিন্তু তাদের নাগরিকদের জীবনের সঙ্গে আরও অনেক প্রাসঙ্গিক প্রকল্প বেছে নেয় এবং সেগুলো সম্পন্ন করতে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়। গবেষকগণ তাদের যুক্তি প্রমাণের জন্য ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সম্পন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা খাতে বিশ্ব ব্যাংক-অর্থায়িত প্রকল্পগুলোর ডেটা সংগ্রহ করেন। এসব প্রকল্পে এক হাজারেরও বেশি নির্দিষ্ট এবং পরিমাপযোগ্য লক্ষ্য ছিল। তারা দেখলেন, যে সব দেশ ছাড়ের অর্থায়নের ওপর নির্ভর করেছিল তাদের প্রকল্প শেষ হয়েছে সাদামাটাভাবে, কেবল প্রসাধনী লক্ষ্যগুলো অর্জন করার মাধ্যমে। যদি বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত ও কর্মক্ষম পাবলিক সেক্টর প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির বিষয়ে আগ্রহী হতো, তবে তারা উন্নয়নশীল দেশের এসব ‘উন্নয়ন খেলা’ বাদ দিয়ে সঠিক স্থানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করত। সেই সঙ্গে তারা প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উপযুক্ত নির্দেশনা দিত। কিন্ত দুঃখজনকভাবে সেটি করা হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়ন কি বলছে?
এদিকে, বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়ন রিপোর্টে ‘Implementation Challenges and Promising Approaches for the Comprehensive Development Framework’ নামক প্রবন্ধে লেখক নাজি হেনা বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশে প্রকল্পগুলোর প্রভাব নিরীক্ষনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের বোর্ডই যেন দুর্বল হয়ে পড়েছে। নানা উন্নয়ন খাত বা প্রকল্প যেমন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি খাত ও প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিবেশ, গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাঠামোগত পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন সহজ বিষয়। কিন্তু দাতা সংস্থার মূল্যায়নকারীরা ধারাবাহিকভাবে দুর্বল পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নকে চিহ্ণিত করে বলেছেন এগুলোতে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
গবেষক নাজি হেনা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে বিকেন্দ্রীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন তাদের জন্য (বিশ্বব্যাংক) নতুন চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করেছে। চিলির বিদ্যুৎ খাতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারিকরণের পর তার যে রূপান্তর ঘটেছে, তারপর দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নেরও অবনতি ঘটেছে। এখানে বিশ্বব্যাংকের জন্য পরিষ্কার শিক্ষাটি হলো তাদের নিয়ন্ত্রক কাঠামো ব্যবস্থাকে উন্নয়নশীল দেশের সহায়তার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে দেখতে হবে। আর, সকল খাতের জন্য একই মনিটরিং ব্যবস্থার আওতায় না এনে বিভিন্ন খাতকে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বাজেটে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা
জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সরকার এসেছে তার রাজনৈতিক ম্যান্ডেট অনেক সুদৃঢ় ও সুদূরপ্রসারী হবার কথা। ফলে জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈষম্য, বঞ্চনা ও আর্থ-রাজনৈতিক অবহেলা দূর করাও এই সরকারের অন্যতম ম্যান্ডেটের মধ্যে পড়ে। আমাদের মনে রাখা দরকার, বৈষম্যবিরোধী ছা্ত্র-জনতা অন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আগমন ঘটেছে। ছাত্র-জনতার অনেকেই এই সরকারের কর্ম-পরিধি শুধুমাত্র সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মধ্যে রাখতে রাজি নন। এটি গণ-অভ্যুত্থানের চেতনারও পরিপন্থী। তাই নানাবিধ কর্মসূচি, যেমন, অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রকাশ, সংস্কার কমিশন গঠন ও তার আলোকে প্রয়োজনীয় বহুমুখী সংস্কার কার্যক্রম নেওয়ার এখতিয়ার এই সরকারের রয়েছে বলে আমি মনে করি। আমার মতো আরও অনেকেই মনে করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কোনোটি যে এমনটা মানতে নারাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এসব কিছু সঠিকভাবে করতে গেলে একাধিক যুৎসই বাজেট দরকার। বাজেট হলো সরকারের আয় ও ব্যয়ের একটি হিসাব, যেখানে উন্নয়নের স্বার্থে যুক্তিযুক্ত ব্যয়কেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। গত ১৫ বছরে দেশের সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যেভাবে বিনষ্ট করা হয়েছে, তাতে আগামী বেশ কয়েকটি বাজেট ও অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম যৌথভাবে নেওয়ার মাধ্যমে এদেশটিকে এগিয়ে নিতে হবে। কেন বাজেটের মাধ্যমে টেকসই উন্নতি হচ্ছে না, তা সরকারে ও সংশ্লিষ্ট সকলকে উপলব্ধি করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে, জুলাইয়ের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের বিশেষ কোন মানে থাকবে না। আমরা এধরণের সুযোগ ১৯৭১ সালে এবং ২০ বছর পর ১৯৯০ সালে পেয়েছিলাম। সেগুলো কাজে লাগাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এবার ব্যর্থ হলে এই রাষ্ট্রটিই একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।