Published : 03 Jun 2025, 06:25 PM
পিরিয়ড’ উচ্চারণে অস্বস্তি হলেও ব্লাড মানিতে ভাগ বসাতে অস্বস্তি হয় না কেন?
‘মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে’ পালিত হয়েছে মাত্র কয়েকদিন আগে– গত ২৮ মে। কিন্তু এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা দেখলাম খুবই নগণ্য। এই দিবসের বদৌলতেই হয়তো ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে আট মাস আগের এক ভিডিও প্রতিবেদন নজরে এল যেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে নারীদের পিরিয়ড ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে হতাশাজনক তথ্য পাওয়া গেছে।
কিশোরী থেকে শুরু করে বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে ৮০ শতাংশ দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলের মেয়েরা পরিষ্কার পানি ও পিরিয়ড হাইজিন প্রোডাক্ট ও জ্ঞানের অভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খেয়ে মাসিক বন্ধ রাখছে। একই অঞ্চলের ফার্মেসিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের চাইতে জন্মনিরোধক পিল বা ‘সুখিবড়ির’ বিক্রয় হয় বেশি। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এহেন ঘটনা দীর্ঘদিন চললে বন্ধ্যাত্ব, অঙ্গহানি, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও সিলেবাসের বাইরের আলাপ থেকে যায় না।
কিন্তু এর পেছনে কারণ কি? যে স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়ার কারণে প্রতিটি মানুষের মানবজন্ম নিশ্চিত হচ্ছে, তা রোধেই এত ঝুঁকি নিয়ে এই কাটাছেড়ার কারণ কি শুধুই জ্ঞানের অভাব নাকি আরও কিছু? ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী বলছে, ডোবার নোংরা ও লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে অসুস্থ হতে চায় না বলে পরিবারের অগোচরে পিল খেয়ে ৫ মাস পিরিয়ড বন্ধ রেখেছে। সংগ্রহ করেছে পাশের বাসার ভাবির কাছ থেকে এবং তার কথায় তার কয়েকজন বান্ধবীও এভাবে পিল নিচ্ছে। কিশোরীটি তার মাকে জরায়ু রোগে ভুগতে দেখেছে। মায়ের কষ্ট দেখেছে, তাই নিজে এমন কষ্ট সে পেতে চায় না।
আরেক কিশোরী বলছে, কোনো এক কর্মশালায় গিয়ে জানতে পেরেছে, একই কাপড় দীর্ঘক্ষণ ও বারবার ব্যবহারের ফলেও রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু তার বা তার পরিবারের স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে ব্যবহারের সক্ষমতা নেই। এজন্য সে পিল খায়।
এটাই হচ্ছে আমাদের উপকূলীয় নারীর চিত্র! দুঃখজনক হলেও সত্য, উপকূলের নারীদের এই গাঁথা যেমন পুরাতন, তেমনি এ নিয়ে লেখালেখিও বহু পুরাতন। কিন্তু বাস করছি পরিবর্তনহীন এক সোশ্যাল ইনারসিয়াল দুঃস্বপ্নে।
অথচ দেশের টিভিতে ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনে হরদম হাইজিন প্রোডাক্টের বুস্টিং চলছে। আবার দেখা যায় বিভিন্ন পেইজে এ সময়ে হরমোনজনিত মুড সুইং বা পিএমএসিং ‘ফাইটে’ বিভিন্ন প্যাকেজের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু একই দেশের উপকূলে সাইড ইফেক্টসম্বলিত পিলের অনিয়ন্ত্রিত ছড়াছড়ি অন্যদিকে হাইজিন থেকে শুরু করে পিএমএসিং প্যাকেজের মার্কেটিং আসলে কিসের ইঙ্গিত দেয়? দীর্ঘদিন ধরে লালিত হতে থাকা পিরিয়ড ট্যাবুর সংস্কার নাকি নিছক মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি? নাকি শহুরে, শিক্ষিত, আর্থিক ও ডিজিটালি সক্ষম মেয়েদের রোগবালাই– মুড সুইং হয় আর উপকূলীয় সোশ্যাল মিডিয়ার আড়ালে বাস করা ভাসমান পরিবারের মেয়েদের এসব পরিস্থিতি গোনাগুণতির সময় নেই কারোর? আসলে সমাজের প্রান্তবর্গীয় নারীর স্বাস্থ্য কখনোই আলোচ্য বিষয় নয়। সবকিছুই রংচঙে মোড়কে দিনরাত ব্লাড মানি ইনকামের পাঁয়তারা।
অবশ্য শহুরে সমাজও এই মার্কেটিং হলোকাস্টের পুরোপুরি বাইরে নয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বহুল প্রচলিত লং লাস্টিং এবং সুগন্ধিযুক্ত প্যাড ব্যবহারেও রয়েছে জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি। এই ধরনের ঝুঁকির কথা না ভেবেই এ ধরণের সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রোডাক্ট বাজারজাতকরণ হয় কিভাবে? অথচ জানলে অবাক হবেন, যেই জন্মনিরোধক পিল নিয়ে এত কথা, সেই প্রোডাক্ট ১৯৭০ সালে পুরুষদের জন্যও তৈরি হয়েছিল, যা টেস্টোস্টেরন ও অন্যান্য হরমোন ব্যালেন্স করে জন্মনিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। কিন্তু তা প্রচার-প্রসার তো দূর; ২০১৬ সালের এক এনপিআর রিপোর্ট মোতাবেক বিভিন্ন সাইড ইফেক্ট যেমন, ব্রন, মুড সুইং, লিবিডো কমে যাওয়া, ওজন বাড়া, উচ্চরক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগের আশঙ্কার কারণে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নারীদের জন্মনিরোধক পিলের কি এর থেকে কম সাইড ইফেক্ট রয়েছে বলেই এর এত বহুল গ্রহণযোগ্যতা? উত্তর হলো, ‘না, নারীদেহে এই পিলগুলোর সাইড ইফেক্ট কম তো নয়ই, বরং বেশি।’ তাহলে কি আঙুল আবারও সেই পুরুষকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার দিকেই তোলা উচিত?
আরেক হাস্যকর দিক হচ্ছে, কর নীতির মারপ্যাঁচে বাংলাদেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন ‘লাক্সারি প্রোডাক্ট’ বা ‘বিলাসবহুল পণ্য’ বলে বিবেচিত হয়। ২০১৯ সালের বাজেটে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল যদিও পরে সমালোচনার মুখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর কমানো বা মওকুফ করা হয়েছে। এবার ২০২৫-২৬ সালের বাজেটেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো হেরফের হয়নি বলে জানলাম। বরং স্যানিটারি ন্যাপকিনকেও প্রসাধনীর মতো বিবেচনা করা হয়েছে। এইতো সেদিন মানে ২০২১ সালে প্রথমে স্কটল্যান্ড এবং পরে ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কিছু কিছু প্রদেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন স্কুল, কলেজ ও অফিসে ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ ২.০ তে দাঁড়িয়ে, আমার দেশের মেয়েদের জন্য একই স্বপ্ন দেখাটা কি খুব একটা আকাশ কুসুম কল্পনা হবে? উত্তর আমার জানা নেই।
এই সব তথ্য-উপাত্ত এককভাবে নারী ও তার অনাগত শিশুর বিরুদ্ধে পরোক্ষ হলোকাস্ট বা কাঠামোগত গণহত্যাকেই সাপোর্ট করছে। যেমন, একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক প্রক্রিয়াকে ‘ট্যাবু’ বানিয়ে রেখে এ নিয়ে সামাজিকভাবে বিশ্লেষণ অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া, গ্ল্যামারাইজেশনের মোড়কে পিরিয়ড প্যাকেজের বিপণনকে সৌন্দর্য্যের প্রতীক বানিয়ে এর স্বাস্থ্যগত গুরুত্বকে কমিয়ে আনা এবং ফোকাস মূলস্রোতের ভোক্তাদের ওপর রেখে প্রান্তিক ‘কথা-না-বলা’ জনগোষ্ঠীর প্রতি উদাসীনতা এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনকে প্রচলিত ধারায় বিলাসবহুল পণ্যের ক্যাটাগরিতে রাখা কি নির্দেশ করে? এখানে কতোটুকু পুঁজিবাদী ও বস্তুবাদী আচরণ আর কতোটুকু কাঠামোগত নিষ্পেষণ? এ রকম প্রেক্ষাপটে বড়ো হয়ে ওঠা সদ্য কিশোরী পিরিয়ডকে তার শত্রু ভেবে এড়িয়ে যেতে চাইবে ‘পিল’ খেয়ে। চিন্তা করবে এই ‘গ্ল্যামারাস আর বিলাসবহুল’ প্রোডাক্ট শুধু শহুরে চকচকে জীবনের অংশ। দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত পিল সেবন আর আন-হাইজিনিক কাপড়চোপড় ব্যবহারে চল্লিশের আগেই জরায়ুজনিত রোগ, স্বাভাবিক যৌনজীবনে ব্যাঘাত, সুচিকিৎসার অভাব, অসহায় অবস্থায় পরিত্যক্ত হওয়া ইত্যাদি খুবই সাধারণ ঘটনা। ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে তখন যখন সচেতনতা ও সুচিকিৎসার অভাবে বন্ধ্যাত্ব, মিসক্যারেজ এবং ক্রিটিকাল স্টেজে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এখন এটি কি একটি স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি নীরব, সুপিরিকল্পিত কাঠামোগত গণহত্যা? প্রশ্নের মাঝেই উত্তর লুকিয়ে আছে।
এর উত্তর আরও তাত্ত্বিকভাবেও দেয়া যেতে পারে মিশেল ফুকোর বায়োপলিটিক্সের ধারণা থেকে। বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র যেহেতু সমাজব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে, সেহেতু রাষ্ট্রই এখানে নারীদেহের স্বাভাবিক চক্রকে বিভিন্ন পিল, হাইজিন সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা, বিশুদ্ধ পানির অভাব ও পুঁজিবাদী ন্যারেটিভের মাধ্যমে বিঘ্নিত করছে। হ্যাঁ, কিছু ক্যাম্পেইন হচ্ছে কিন্তু তা পৌঁছাচ্ছে না তৃণমূল পর্যায়ে। কিশোরী অবস্থায় একজন ভুল জানছে, সেভাবেই সে মা হচ্ছে, সেই ভ্রান্ত ধারণা দিচ্ছে তার সন্তানকে আর এভাবেই এই বিষাক্ত চক্র চলছে।
যদিও উন্নয়নশীল দেশ হয়েও সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে যেমন, বিভিন্ন এনজিও ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, শুল্ক চাপ কমাতে দেশীয়ভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুতকরণ ও বাজারজাতকরণ, উপকূলে বিশুদ্ধ পানির জন্য বিভিন্ন পানির ট্যাংক স্থাপন, স্বল্প পরিসরে স্কুলে ফ্রি প্যাড বিতরণ ইত্যাদি। তবে এই পদক্ষেপগুলোর ব্যাপ্তি খুবই নগণ্য ও ধীরগতির। প্রায়শই এনজিওগুলোর লোকদেখানো প্রকল্প। এই পদক্ষেপকে গতিশীল করতে হলে আগেই, পিরিয়ড যে একটি ট্যাবু এই চিন্তা ভাঙতে হবে। তৃনমূল পর্যায় থেকে সচেতন মা তৈরি করতে হবে যে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে তার সকল সন্তানকে লুকোছাপা না করে বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে জানাতে পারবে। ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে মাত্র ৩৭ শতাংশ মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। এই সমীক্ষা শুধুই নির্ধারিত কিছু মানুষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে করা তার মানে আসল সংখ্যা জানা আপাতত সম্ভব নয়। আর হাইজিনজনিত কারণে জরায়ু আক্রান্তের সংখ্যাও কিন্তু কম না। কাজেই সরকারসহ বিভিন্ন এনজিওভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের উচিত বাণিজ্যভিত্তিক বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে খুব দ্রুত কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে এই সংখ্যা আসলেই একটি দৃষ্টান্তমূলক হলোকাস্টের সংখ্যায় পোঁছতে না পারে।
পরিস্থিতিটাকে কেন ‘মার্কেটিং হলোকাস্ট' বলতে চাই, তার একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার এই লেখায়। হলোকাস্ট যেমন ছিল একটি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ভর গণবিনাশ, তেমনি প্রান্তবর্গীয় নারীর ক্ষেত্রেও সামাজিক ট্যাবু, বাজারের গ্ল্যামারাইজড বিভাজন ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা মিলেমিশে এক ধরনের কাঠামোগত নিশ্চিহ্নীকরণ ঘটাচ্ছে। এখানে ধ্বংস হচ্ছে কেবল স্বাস্থ্য নয়, বরং নারীর মর্যাদা, জৈবিক অধিকার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। হলোকাস্ট যেমন ছিল একটি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ভর গণবিনাশ, তেমনি এই ক্ষেত্রেও সামাজিক ট্যাবু, বাজারের গ্ল্যামারাইজড বিভাজন ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা মিলেমিশে নারীর প্রতি এক ধরনের কাঠামোগত নিশ্চিহ্নীকরণ ঘটাচ্ছে। এই গণবিনাশ হত্যাযজ্ঞে নয়, বরং নীরবতায় ঘটে—প্রতিটি অচিকিৎসিত জরায়ু, প্রতিটি ভয় পেয়ে গিলে ফেলা মেয়েলি প্রশ্ন, প্রতিটি প্রান্তিক নারীর অপ্রকাশিত মৃত্যু এটাই প্রমাণ করে। যখন স্বাস্থ্যকে পণ্যে রূপান্তর করা হয়, তখন তা শুধু পুঁজিবাদ নয়, একপ্রকার সুপরিকল্পিত কাঠামোগত শোষণে পরিণত হয়—যেখানে মেয়েদের শরীরই হয়ে ওঠে বিপণনের যুদ্ধক্ষেত্র। ঠিক এই কারণেই, শহুরে চকচকে বিজ্ঞাপন আর উপকূলীয় কিশোরীর গোপন মৃত্যু যেন একই চিত্রনাট্যের দুটি বিপরীত দৃশ্য, যার কেন্দ্রে রয়েছে এই ভয়াবহ ‘মার্কেটিং হলোকাস্ট’।