Published : 08 Jun 2025, 06:03 PM
আমরা যখন ঈদের ছুটি কাটাচ্ছি তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার বন্ধু ইলন মাস্ক কিছু চমকপ্রদ খবরের জন্ম দিয়েছেন। সেগুলো আমরা যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসে আমেরিকায় থিতু হয়েছি, তাদের অনেকের কাছে উপভোগ্য হয়েছে। হয়েছে বিনোদনের খোরাক।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের কথায় বা টুইটের খোঁচায় সংবাদ তৈরি হয়। এই সংবাদ মাঝে মাঝে বাস্তবের সীমারেখা ছাড়িয়ে বৈজ্ঞানিক কল্পকথা বা ছোটদের রূপকথার মতো শুনায় । সেইরকম একটা সংবাদ প্রাণ পেয়েছে ট্রাম্পের আজগুবি এক টুইট থেকে।
বাইডেনের রোবোটিক ক্লোন
ইন্টারনেটে কত যে সংবাদ ভেসে বেড়ায় মানুষের ফেইসবুক, ইউ টিউব বা টুইটে । কয়জনাইবা এইসব পড়ে আর কয়জনেইবা এইসব দেখে ? তেমনি একটা পোস্ট- ট্রুথ সোশ্যালের অন্য একজন ব্যবহারকারীর করা, পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে ‘ক্লোন ডাবলস এবং রোবোটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে নিষ্প্রাণ ও নির্জীব' এক নকল বাইডেন আসল বাইডেনের পরিবর্তে এসেছে এবং আসল বাইডেনকে ২০২০ সালেই খুন করা হয়েছে।
এই পোস্টটা ৩১ মে ট্রাম্প তার নিজের ট্রুথ সোশ্যালের একাউন্ট থেকে পুনরায় পোস্ট করেন। ট্রাম্পের এক মিলিয়ন অনুসারীর একাউন্ট থেকে রিপোস্ট করার পর এটা নতুন প্রাণ প্রায় এবং প্রেসিডেন্টের মেগাফোনের মতো এটা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্য্ ষড়যন্ত্র তথ্যগুলোর মতো এটাও প্রাণ পেয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে, যদিও সবাই জানতো পুরা ব্যাপারটা একটা মিথ্যা।
যুক্তরাষ্ট্রের নেটওয়ার্কগুলোর রাত্রের কমেডিয়ানেরা ট্রাম্পের এই পোস্ট লুফে নিলো । বিখ্যাত কমেডিয়ান জন স্টুয়ার্ট, স্টিভেন কালভার্ট এবং জিমি কিমেল নিজের মতো করে ট্রাম্পের পোস্ট নিয়ে মজা করলেন । বললেন, 'আর যাই হোক, যে নকল জো বাইডেন রোবটটি তৈরি করেছে সে রোবট তৈরিতে খুবই খারাপ। আমি বলতে চাইছি, যদি কারো স্থানে সত্যি কোনো রোবোটিক ক্লোন থাকে, তাহলো মেলানিয়া, তাই না?' স্পষ্টতই কিমেল ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়ার কঠিন চাহনি ও শক্ত চলাফেরার দিকে ইঙ্গিত করেছেন ।
নিউ ইয়র্ক টাইমস ৭ জুনের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, '২০২৪ সালে ছয় মাস ধরে ট্রাম্পের হাজার হাজার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এবং রিপোস্টের বিষয়গুলো নিউ ইয়র্ক টাইমস বিশ্লেষণের দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৩০টিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তার নিজের বা আমেরিকান জনগণের বিরুদ্ধে মিথ্যা, গোপন ষড়যন্ত্র এবং এর জন্য দায়ী একটি অজানা শক্তিকে দায়ী করে বর্ণনা দিয়েছেন।’ সুতরাং ডনাল্ড ট্রাম্পের জন্য এটা নতুন কিছু নয়। কয়দিন পরেই জনগণ এটা ভুলে যাবে এবং ট্রাম্পের টুইটের পরবর্তী মিথ্যা ষড়যন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করবে।
মাথা নত করেনি হার্ভার্ড
গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অভিযোগ করেন আমেরিকার অভিজাত ও আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইহুদি-বিদ্বেষের ফলে এই বিক্ষোভ হয়েছে। একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিদ্বেষ বন্ধ করার জন্য কি কি করণীয় তা-ও জানিয়ে দিল । বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাম্পের দাবি মেনে ক্যাম্পাসে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন এবং সবরকম ইহুদি সমালোচনা ইত্যাদি বন্ধ করে দিল। কারণ ট্রাম্পের কথা না মানলে, ট্রাম্প তাদের ফেডারেল অনুদান, রিসার্চ গ্রান্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভর্তির জন্য ভিসা দেওয়া ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ট্রাম্পের বিরুদ্ধাচারণ করে প্রতিষ্ঠানগুলো সুস্থভাবে চালানো সম্ভব ছিল না।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) সম্প্রতি ট্রাম্পের নীতিমালার প্রতি অতিরিক্ত বাধ্যতা দেখিয়ে, মেগা ভেমুড়ি নামে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীকে তার স্নাতক সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাধা দিয়েছে। গাজা যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদ, ফিলিস্তিনের প্রতি তার সমর্থন এবং ইসরায়েলের সঙ্গে এমআইটির সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি এমআইটি প্রশাসনের রোষানলে পড়েন । শিক্ষার্থীরা অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে, এমআইটির চ্যান্সেলর মেলিসা নোবেলস যখন তার বক্তৃতা শুরু করেন, তখন তাকে বাধা দিয়ে স্লোগান দেযন।
বিশ্ববিখ্যাত আইভি লীগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যে বিশ্ববিদ্যালয়টি ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আবদারে মাথা নত করেনি। মার্কিন প্রশাসনের দাবি, শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী বলে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। হার্ভার্ডের এই সিদ্ধান্তের পরেই তাদের ওপর একের পর এক ‘শাস্তির খাঁড়া’ নামিয়ে এনেছে ট্রাম্প প্রশাসন। হার্ভার্ডকে ২২০ কোটি ডলারের সহায়তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’ জানিয়েছে, ওই ২২০ কোটি ডলারের সাহায্য বন্ধের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ৬ কোটি ডলারের একটি চুক্তিও স্থগিত রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ডে বিদেশি ছাত্রদের জন্য ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয। এর অর্থ হলো, হার্ভার্ডে যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তাদেরকে নিজ দেশে চলে যেতে হবে এবং নতুন কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে না। হার্ভার্ড অবশ্য প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করেছে। এই মামলার রায়ের ওপর নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধিকার ও শিক্ষার্থিদের মুক্তমনে শিক্ষার পরিবেশ।
মাস্ক কি নতুন রাজনৈতিক দল গড়বেন?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও টেকনোলজি আইকন ইলন মাস্কের বন্ধুত্বে যে শত্রুতা ভর করেছে, সেই খবর মাত্র তিন-চার দিনের পুরানো। এর মধ্যেই তাদের দু জনের সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম ও রাজনীতির অঙ্গন মুখর হয়ে উঠেছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর, আমেরিকার রক্ষণশীল রাজনীতির যারা প্রতিপালক তারা এই দুইজনকে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে আসর জমিয়েছিলেন। মনে করা হচ্ছিল ইলন মাস্ক জাতীয় ব্যয় তিন ট্রিলিয়ন ডলার কমিয়ে রিপাব্লিকানদের অনেকদিনের দাবি ব্যায় সংকোচকে বাস্তবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। ইলন মাস্ক হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়াতে তারা খুব নিরাশ হয়েছেন । এর মধ্যেই শুরু হয়েছে দুজনের তুমুল বাকযুদ্ধ । রিপাবলিকান নেতারা , রক্ষণশীল থিঙ্কট্যাংকগুলো এবং রবার্ট মারডকের 'ফক্স নিউজ চ্যানেল’ যারা ট্রাম্প ও মাস্ককে উগ্রভাবে প্রচার করে তাদের জন্য একটা বিরাট ভক্ত শ্রেণি তৈরি করেছে , তারা সবাই হিমশিম খাচ্ছে এই বিচ্ছেদকে কিভাবে মেনে নেবে এবং প্রচার করবে ভেবে।
ইলন মাস্ক বলেছেন, ডনাল্ড ট্রাম্প 'একজন অকৃতজ্ঞ লোক’l মাস্কের সাহায্য ছাড়া ট্রাম্প দিত্বীয়বার নির্বাচিত হতে পারতন না, তা মোটামুটি সবাইর জানা। মাস্ক অকৃপণভাবে অর্থদান করেছেন ট্রাম্পকে, ওয়াল স্ট্রিট ও সিলিকন ভ্যালিতে অন্যদের থেকেও ট্রাম্পের জন্য অর্থ চেয়ে নিয়েছেন। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে মাস্কের বড় গলা অনেক আমেরিকানকে আশ্বস্ত করেছিল । হাজার হোক, ইলন মাস্কের বুদ্ধি ও ক্ষমতা নিয়ে আমেরিকানদের রয়েছে অনেক আস্থা ।
ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে যাবার পর মাস্ককে বড় দায়িত্ব দেন, সরকারের ফেডারেল ব্যয় কমিয়ে আনতে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ (ডিওজিই) প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল মাস্ককে। তবে মাস্ক সম্প্রতি ডিওজিইর প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এই পদে তিনি অল্প কয়মাসে অনেক অজনপ্রিয় সিন্ধান্ত নিয়েছেন, অনেক লোকজনকে চাকুরিচ্যুত করে গালিগালাজ শুনেছেন। কিন্তু মাস্ক যখন হোয়াইট হাউস ছেড়ে যান, তিনি ছিলেন খুব অসন্তুষ্ট । তিনি শেষ পর্যন্ত বুঝেছিলেন, ট্রাম্প খরচ কমানোর ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না এবং তাকে তেমন সহযোগিতা করেননি। বিনা কারণে তাকে কাদায় নামিয়ে হেনেস্তা করেছেন। তার এই ধারণা বদ্ধমূল হয়, যখন ট্রাম্প তার 'অতীব সুন্দর' বাজেট ঘোষণা করলেন। মাস্ক এটাকে বললেন, 'ধিক্কারজনক ', কারণ এতে ট্রাম্প তার পরিচিত লোকজনদের জন্য প্রজেক্ট করে 'পর্ক' রেখেছেন যা ফেডারেল খরচ আরো বাড়িয়ে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রে বাজেটের বাড়তি খরচকে ‘পর্ক' বলা হয়।
ট্রাম্প বলেছেন , তিনি আর কখনো ইলন মাস্কের সঙ্গে কথা বলবেন না। তার ধারণা, মাস্ক ড্রাগ করে তার বুঝ-বুদ্ধি হারিয়েছেন।
এদিকে ইলন মাস্ক নতুন পার্টি গঠন করতে যাচ্ছেন কিনা তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। কারণ তিনি এর মধ্যেই এনিয়ে অনলাইন জনমত গ্রহণ করা শুরু করেছেন।
'এখন নতুন দল করা ঠিক হবে কিনা?'– এই প্রশ্নের জবাবে এ পর্যন্ত যারা অভিমত জানিয়েছেন, তার আশি ভাগের বেশি নতুন দল গড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। নতুন দল গড়লেও, মাস্ক নিজে কোনোদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না, কারণ তিনি জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক নন । তবে তিনি কংগ্রেস ও সিনেট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে অনেক প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন।
কথায় আছে, সবচেয়ে বড় শত্রু হলো সেই, যখন বন্ধু শত্রু হয়ে যায়। ট্রাম্প ও মাস্কের ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে, যদি তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বাড়তে থাকে । তবে তাদের সম্পর্ক নিশ্চয়ই বিখ্যাত বাংলা গানের চরণটির মতো হবে না– ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার, শত্রুও তুমি একজন, তাই।’ কেননা, দুজনের আরও অনেক বন্ধু এবং শত্রু রয়েছে।