Published : 18 May 2025, 09:37 AM
জেন্ডার নিয়ে কাজ করার সুবাদে মাঝেমধ্যে স্কুলের কোনো কোনো প্রোগ্রামে ক্লাস নেয়ার সুযোগ হয়। কারণ সব সময় বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ কিছু শব্দে আমরা আমাদের চারপাশটা পুরোপুরি বুঝতে পারি না। অক্ষর তো সবসময়ই স্থির, কিন্তু জীবন ভারী অস্থির।
এরকম একবার একটি হাই স্কুলে একটা ক্লাসে নারী বলতে আমরা কী বুঝি, একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল, ‘শাড়ি পরে, ঘরের কাজ করে।’
‘আর?’ জানতে চাই।
‘আর আমাদেরকে পড়ায়, স্কুলে নিয়ে আসে, আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে, অসুখ হলে যত্ন নেয়।’
‘অন্য সময় নেয় না?’ জিজ্ঞাসা করতেই সবার হাসি।
সে বলল, ‘সবসময়ই করে। কিন্তু অসুস্থ হলে বেশি করে, অন্য সময় বকা দেয়, শাসন করে। কিন্তু অসুখ হলে তখন কম শাসন করে।’
এই ধরণের উত্তরগুলো আমার আলাপ শুরু করতে সহজ করে। একজন ব্যক্তির যে নানান রকম পরিচয় থাকে, আবার সেই পরিচয়গুলো যে নানান পরিসরে পরিবর্তিত হয়, সেই সঙ্গে ভিন্ন মাত্রিক অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতি তৈরি হয়– এই আপাত জটিল বিষয়গুলো অনুধাবণের মধ্য দিয়ে তা বুঝানো যায়।
যেমন, এরপর ওকে বলি, ‘তোমার মা তো তোমাকে শাসন করে, তোমার মাকে কেউ শাসন করে না?’
বলল, ‘বাবা, দাদা-দাদি, নানুরা মাকে শাসন করে, আবার মামাও করে।’
এরপর সবাইকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমাদের পরিবারে আশপাশে কে কাকে শাসন করে, আমরা কি সেটা খেয়াল করেছি?’
এরপর কাগজ কলম নিয়ে আলাপ করে পরিবার, সমাজে বিদ্যমান নানান ক্ষমতা সম্পর্কের নানান ডাইমেনশন নিয়ে আলাপ করি আমরা। পরে দেখা গেল, এই পদ্ধতিতে ওরা আরো বৃহৎ পরিসরে যে ক্ষমতা কাঠামো, সেটাকেও নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে। এরপর দেখা গেল তারা নিজেরাই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে বিদ্যমান ক্ষমতা সম্পর্কের বহুস্তরীয়তা নির্ণয় করে ফেলছে।
এই যে সামান্য একটা চিন্তাসূত্র বাচ্চাগুলোকে দেয়া হলো, তারা বুঝল নারীর কোনো একক সংজ্ঞা নেই কিংবা পরিচয়েরও কোনো একক সংজ্ঞা নেই। নারী হওয়ার অর্থ শুধুমাত্র শরীর বা আচরণ দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না, বরং তা নির্ধারিত হয় শ্রেণি, জাতিপরিচয়, সমাজ, দেশ, কাল, সংস্কৃতির নানানমাত্রিক প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে। তাই এক নারী সীমিত কিছু অধিকার পেলেও তা সকল নারীর অধিকার নিশ্চিত করে না।
আমার কাছে বড়দের সঙ্গে আলাপ করার চেয়ে বরং ছোটদের সঙ্গে আলাপ করাটা অনেক আনন্দের অনুভূতি দেয়। মনে হয়, তারা সহজে বুঝতে পারে। বড়দের মতন অত ষড়যন্ত্রতত্ত্ব করে সহজ বিষয়গুলো জটিল করে না।
‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ নামক সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক আয়োজনটি ঘিরে যে ধরণের অনুমানভিত্তিক নানান রকম সমীকরণ ও উদ্দেশ্যমূলক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এতে আবারও ওই অস্বস্তিটা কাজ করছে। মনে হচ্ছে, খুব সহজ বিষয়টাকে খামোকা জটিল করা হচ্ছে। মানুষের যে বহুমাত্রিক পরিচয়, বহুমাত্রিক নিপীড়নের অভিজ্ঞতা এবং তার বিরূদ্ধে বহুমাত্রিক লড়াই বিদ্যমান– তা যে একটা সরকার পরিবর্তন কিংবা একটা জুলাই অভ্যুত্থান দিয়ে সমাধান হয় না, সেটা বুঝতে পারার জন্য খুব জটিল সমীকরণে যেতে হয় না। এই সমালোচনা কিংবা বুঝতে না চাওয়া, নারীর সংগ্রামের বহুমাত্রিকতার বিরুদ্ধেই এক ধরণের আপত্তি।
এই মৈত্রীযাত্রাকে কেউ বলছেন বর্তমান সরকারের এজেন্ডা, কেউ বলছেন বিগত আওয়ামী আমলের লোকদের ছায়া প্রকল্প, কেউ বলছেন গ্রামীণ নারীর বাস্তবতা বিবর্জিত শহুরে নারীদের শো ডাউন, এনজিওর প্রকল্প, কেউ আবার বলছেন পশ্চিমা নারীবাদের প্রক্সি। অথচ এই আয়োজনই ছিলো নারীর অধিকারের ইন্টারসেকশনাল বাস্তবতার এক প্রকাশ, যেখানে নারী কেবল একটি শ্রেণির, একটি জাতিসত্তার, কিংবা একটি ভূগোলের প্রতিনিধি ছিল না।
যারা এ ধরণের আলাপ করছেন, তাদের অনেককেই দেখা গেছে জুলাই অভ্যুত্থানে জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হওয়া একাত্মতায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন, নানানভাবে সমর্থন জুগিয়েছেন। তাহলে নারীদের এই মৈত্রীযাত্রাকে কেন নানানভাবে বিশ্লেষণ, ক্ষেত্রবিশেষে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে?
নারীদের মৈত্রীযাত্রা এই সমালোচনা কিংবা ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, রাষ্ট্র ও সমাজে বিদ্যমান ‘ব্যাটাগিরি’ থেমে যায়নি। জুলাইয়ের পরে রাজনৈতিক দলগুলোর মঞ্চের চেয়ার যেভাবে ভাগাভাগি করা হলো, মিছিলে সামনে থাকা নারীমুখগুলোকে সরিয়ে আড়াল করার চেষ্টা চলল, তাতে তো স্পষ্ট রাষ্ট্রীয় পরিসরের ব্যাটাগিরির নমুনা। আর, মৈত্রীযাত্রা নিয়ে কন্সপিরেসি থিয়োরি করা লোকজনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে সামাজিক পরিসরের ব্যাটাগিরি নজরে আসে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যাটাগিরি থেমে যায়নি। কারোর দখলে আছে রাজনৈতিক ক্ষমতা, কারোর আছে জ্ঞানের বয়ান, কারোর আছে ধর্মীয় কর্তৃত্ব। এই ব্যাটাগিরি কেবল শরীরের না, তা ভাষা, চিন্তা এবং আন্দোলনেরও। তাই নারীর জন্য, নারীদের দ্বারা সংঘটিত আন্দোলন যতই স্বতঃস্ফূর্ত হোক না কেনো, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে।
অনলাইন পত্রিকার নিউজগুলোর কমেন্ট সেকশনে দেখলাম অনেকেই মিছিলে আগত পুরুষদের প্রতিনিধিত্ব দেখে ওই পুরুষগুলোর পৌরুষ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। অথচ, নারীর মুক্তির যে লড়াই সেটা কেবল নারীর জন্য না। কিংবা এটা শুধু লিঙ্গবিষয়ক কোনো রাজনীতিও না। নারীবাদ একটি বহুমাত্রিক অস্তিত্বের রাজনীতি।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এখানে কেন আদিবাসীদের কথা আসবে, কিংবা চা শ্রমিকদের কথা আসবে– ঢাকার রাস্তায় এদের কে এনেছে?’ একজন আদিবাসী নারী হিসাবে এই মৈত্রীযাত্রায় অংশগ্রহণের ফলে প্রশ্নটা আমাকেও করা হয়। আমার অবস্থান পরিষ্কার। বিগত কোনো সরকার, কোনো রাজনৈতিক দল আমার সমস্যার সমাধান করার কথা বলেনি, অথচ এই আন্দোলনে আমার দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। আমি আমার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আমার আদিবাসী নারী পরিচয়, জাতিগত পরিচয়, শ্রেণি, পুঁজি, রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্ব, ভাষার খবরদারি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী, পিতৃতন্ত্র, ভৌগোলিক অবস্থান– এসবের মধ্যে বরাবর নিজেকে খুঁজেছি এবং প্রশ্ন করেছি সকল ধরণের কাঠামোকে। কিন্তু কেউই সেটাকে আমলে নেয়নি। দেখেছি কেউ শুধু আমাদের পোশাক আর চেহারা ক্যামেরার সামনে দেখিয়ে তাদের ‘বহুত্ব’ দেখানোর চেষ্টা করেছে, কেউ আমাদেরকে বলেছে, ‘বাঙালি মুসলমানের দেশে আবার কিসের আদিবাসী’, কেউ বলেছে, ‘তোমরা বাঙালি হয়ে যাও’, কেউ বলেছে, ‘এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের মুক্তি ঘটলে, তবে তোমাদের মুক্তি’। আদিবাসীদের সঙ্গে যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতারণার ইতিহাস আছে, এতে প্রায়শ মনে হয়, আমাদের কথা কেউ বুঝবে না, শুনবে না, দেখবে না।
কিন্তু সেদিন মৈত্রীযাত্রায় যখন দলিত নারী, চা শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, গৃহকর্মী, ছাত্রদের সঙ্গে হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল এই প্রতারণা শুধু আমাদের মতো আদিবাসীদের সঙ্গে না, এই প্রতারণা অন্য অনেকের সঙ্গেও ঘটে চলেছে। এই যে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিন্ন ভিন্ন রকমের নারী শরীরকে সমবেত করে তাদের চোখে দেশকে দেখা, রাষ্ট্রকে দেখা, এটা স্পষ্ট যে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ঠিকঠাক ফাংশন করছে না। এই কাঠামোগুলোর মধ্যে আমরা যারা নানানভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছি, আমাদের সেই ভিন্নতাগুলোই আমাদের সংহতির জায়গা হয়ে উঠেছিল।
এই সংহতিযাত্রা নিয়ে যে প্রশ্ন, দ্বিধা সংশয়– তা থেকে বুঝা যায় রাষ্ট্রীয় নারীবাদ বনাম গ্রাসরুট নারীবাদের সেই চিরকালীন দ্বন্দ্ব। বিগত আওয়ামী সরকার যে রাষ্ট্রীয় নারীবাদকে মদদ দিয়েছিল উন্নয়নের নাম দিয়ে, দেখাতে চেয়েছিল তারা ছাড়া নারীর মুক্তি নেই এবং সারাক্ষণ গেইটকিপিং করে যাচ্ছিল কিসে নারীমুক্তি সেই সংজ্ঞা নির্ধারণে– সেই আওয়ামী ‘কো-অপশন’-এ এই মৈত্রীযাত্রা চপেটাঘাত দিয়েছে। বুঝিয়েছে উন্নয়নের পরিসংখ্যানের খাতায় নাম লেখালেও নারী প্রতিনিয়ত শোষিত হয়ে যাচ্ছে শ্রমিক হিসাবে, উন্নয়নের ভাগীদার সে হতে পারেনি। তাই নারী শ্রমিক স্লোগান দিয়েছে, ‘শ্রমিক যখন রাস্তায় মরে, রাষ্ট্র তখন কী করে।’
আবার আমাদের অনেক সাথী, বিশেষত আদিবাসী বা দলিত বা ট্রান্স কম্যুনিটির যারা কখনোই ‘নেত্রী’ হিসাবে গণ্য হন না, এই যাত্রায় তারাও অনেক সোচ্চার ছিলেন। চন্দ্রা মোহান্তি তার ‘আন্ডার ওয়েস্টার্ন আইস’ প্রবন্ধে বলেন, তৃতীয় বিশ্বের নারীদের অভিজ্ঞতা কখনোই একরৈখিক বা সমজাতীয় নয়– তাদের সংগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দাঁড়ানো।
নারীর ‘মুক্তি’ বা ‘অধিকার’– এই শব্দগুলো রাষ্ট্র প্রায়শ তার নিজের উন্নয়নের খুঁটি হিসাবে ব্যবহার করে। তবে এই মুক্তি আসলে কতটা মুক্ত? আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি, কীভাবে রাষ্ট্র– সমর্থিত কর্মসূচি বা উন্নয়ন প্রকল্পে নারীর কণ্ঠ কখনোই তীব্র নয়, বরং তারা সেখানে ‘সহযোগী’ হয়ে থাকে, যাদের ভাষা হতে হবে ‘সভ্য’, ‘নিয়ন্ত্রিত’ ও ‘প্রতিনিধিত্বযোগ্য’। এর বাইরে গেলেই তারা হয়ে যান ‘র্যাডিকাল’, ‘বিপজ্জনক’ ‘রাজনৈতিক’। তাই ‘চেয়েছিলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা’ স্লোগানে তাদের অস্বস্তি হয়।
নারীর জীবনের প্রত্যেকটা হিস্যা যে রাজনৈতিক এবং তার দায়ভার রাষ্ট্রসহ এই বৃহত্তর সমাজকে নিতে হবে– এই রাজনীতিকরণকেই রাষ্ট্র ভয় পায়। আর যারা ‘এইগুলো এনজিওর প্রকল্প’, ‘আপনারা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন’, ‘আপনারা পশ্চিমা নারীবাদ আমদানি করেন’ বলেন, তারা আসলে শেষমেষ ওই রাষ্ট্রীয় নারীবাদের আখ্যানকেই শক্তিশালী করেন।
আর সমাজকে প্রশ্ন করা অধিকারের দাবিতে– হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম এটা কি জোরে একটা চপেটাঘাত দিল সবকিছুকে খুব সরল করে দেখতে চাওয়া, আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকা ব্যক্তি, দল, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, সর্বোপরি এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে, যারা মনে করেছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সব সমাধান হয়ে গেছে কিংবা যাবে।
অবশ্য, মৈত্রীযাত্রা নিয়ে ষড়যন্ত্র খুঁজতে থাকার প্রবণতাতেই বুঝতে পারা যায়, ব্যাটাগিরি একরকম না, বহুরকম ব্যাটাগিরি আছে। এই যে অনাস্থা, অবিশ্বাস, এইগুলোও ব্যাটাগিরির সাক্ষর।
আমরা এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যখন কিনা প্রতিটি সম্পর্কে অনাস্থা জন্ম নিচ্ছে, যখন আন্দোলনগুলো কেবল গেইটকিপারদের ভাষ্য হয়ে উঠছে, তখন ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়– সংহতি কোনো মুখস্ত বুলি না, এটা অনুশীলন, দায়বদ্ধতা, ও চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। এটি নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করার পাশাপাশি অপরকে শোনা, শেখা এবং অপরের যন্ত্রণাকে নিজের যন্ত্রণার মতন ধারণ করার অনুশীলন।
যারা এই মৈত্রীযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাচ্ছেন, তাদের নিশ্চয়ই নিজেদের ব্যাটাগিরিকে একটু আমলে নেয়ার দরকার আছে। নাহলে বাংলাদেশে জুলাই বহুবার আসবে, কিন্তু জুলাই যে দাবিগুলো নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল, সেই দাবিগুলো কখনোই পূরণ হবে না। এছাড়াও, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আমাদের এইসব ব্যাটাগিরি আসলে ঔপনিবেশিক ও পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোরই এক্সটেনশন– যা নিপীড়নের ভাষাকে ভিন্নরূপে টিকিয়ে রাখে।