Published : 14 Jun 2025, 09:17 PM
বিগত মাস দুয়েক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিল, যাতে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহৃত না হয়। পরপর ছয়টি বৈঠক হয় দুপক্ষের মধ্যে। এই আলোচনা চলাকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বারবার ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, যেন নেতানিয়াহু কোনোভাবেই ইরান আক্রমণ না করেন। যারা ট্রাম্পকে চেনেন, তারা ইরানের প্রতি তার এই ‘নতুন ভালোবাসা’ দেখে হতবাক হয়েছেন। সম্ভবত ‘গুড কপ-ব্যাড কপ’ খেলার ভান করে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু অনেক দিন ধরেই এই বড় হামলার পরিকল্পনা করছিলেন।
ইরান বুঝতেই পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চলাকালীন এমন বড় একটি হামলা আসতে পারে। প্রথম যখন হামলা শুরু হয়, তখন ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও চালু ছিল না।
রয়টার্সের সঙ্গে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, “আমরা প্রায় সবকিছুই জানতাম। এতটাই জানতাম যে ইরানকে চুক্তির জন্য ৬০ দিন সময় দিয়েছিলাম, এবং আজ ৬১ দিন—তাই না? তাহলে বুঝতেই পারছেন।”
তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েলি হামলার পরও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। কেউ জানে না। এটি ছিল একেবারে বিধ্বংসী আঘাত।”
এটা যে ইরানের ওপর বিধ্বংসী আঘাত–তা নিঃসন্দেহে সত্য । আর ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি এই সম্বন্ধে সবই জানতেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ মন্তব্য করেছে, “ঘুরেফিরে দেখলে বুঝতে পারা যাবে যে ইরানের সঙ্গে মার্কিন কূটনীতি ইসরায়েলি আকস্মিক আক্রমণকে আড়াল করে রাখছিল।”
ইরানের জাতিসংঘ প্রতিনিধি আমির সাইদ ইরাভানি অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েল কূটনীতিকে প্রতিহত করা, আলোচনাকে ভণ্ডুল করা এবং অঞ্চলকে বড় ধরনের সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটন যে এতে জড়িত, তা ‘সন্দেহাতীত’।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল। ডানপন্থী দুটি ছোট দল—যাদের সমর্থনে নেতানিয়াহু এতদিন কনেসেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলেন—তারা ঘোষণা করে যে তারা নেতানিয়াহুকে আর সমর্থন করবে না।
ইসরায়েলি ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নেতানিয়াহু পদত্যাগ করে কনেসেট ভেঙে দেবেন এবং নতুন নির্বাচন হবে। এই জটিল পরিস্থিতিতে, যখন নেতানিয়াহু নিজেই পদত্যাগ করতে যাচ্ছিলেন, তখন ইসরায়েল এমন বড় যুদ্ধে জড়াবে—তা ইরান বা অন্য কোনো দেশ কল্পনাও করেনি।
হামলার মাত্র ১২ ঘণ্টা আগে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকার জন্য আরও কয়েক দিনের সময় চান। এখন মনে করা হচ্ছে, পদত্যাগের ঘোষণা ছিল কেবল ইরানকে বিভ্রান্ত করার একটি ‘চাল’। ইরানের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য তিনি এই চালটা চেলেছেন।
এই হামলায় ইরানের জাতীয় গর্বে বড় ধাক্কা লেগেছে। ইসরায়েল ইরানের শীর্ষ কয়েকজন জেনারেলকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, রেভলিউশনারি গার্ডের প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান এবং একজন প্রাক্তন নিরাপত্তা প্রধান। আরও নিহত হয়েছেন নয় জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও উচ্চপদস্থ ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প কর্মকর্তা।
হামলার বড় অংশটি চালানো হয় যুদ্ধবিমান থেকে। তবে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের ভেতরেও অস্ত্রাগার ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপণ কেন্দ্রে গুপ্ত হামলা চালায়। মোসাদ তিনটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে ইরানের অভ্যন্তরে তাদের ‘ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড’ দেখা যায়।
ইরান পরে পাল্টা হামলা চালায়, বিপুল সংখ্যক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইসরায়েলের দিকে। কিন্তু সমস্যা হলো, ইসরায়েলের রয়েছে শক্তিশালী ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—যা ড্রোন, বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশেই ধ্বংস করে দিতে পারে।
তারপরও যে কয়টি ক্ষেপণাস্ত্র আয়রন ডোম ভেদ করে আঘাত হানে, তাতে দুজন নিহত এবং অন্তত ৭০ জন আহত হয়েছেন। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, ইরান যদি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া না থামায়, তাহলে ‘তেহরান জ্বলবে’।
আসলে ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তি এখন ইরানের নেই। এককালে লেবাননে নাসারুল্লাহর হিজবুল্লাহ বাহিনী ছিল ইরানের প্রধান মিত্র। তারা ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে আঘাত হানতে পারত। কিন্তু ইসরায়েল এখন হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে ফেলেছে এবং নাসারুল্লাহকে হত্যা করার দাবি করছে। অবশ্য নাসারুল্লাহ নিহত হয়েছেন কিনা এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পাওয়া যায়নি।
এখন মনে হচ্ছে, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর যোগসাজশে অগ্নিপরীক্ষায় পড়েছে ইরান। ইরানের উচিত হবে আগে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা—যাতে ইসরায়েল যখন-তখন হামলা চালাতে না পারে। তবে ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর জোট—আমেরিকার আলোচনার ছায়ায় ইসরায়েলের হামলার ছক, কেবল ইরানকে বিপদে ফেলে, মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ ঘিরে অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিবায়ু বইয়ে দিয়েছে।
ইসরায়েলি হামলার পর ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলেছে, “ইসরায়েলি কর্মকর্তারা যখন সামরিক সফলতা উদযাপন করছেন, তখনও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইরানকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের কৌশলগত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি। বরং মধ্যপ্রাচ্যকে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আরব প্রতিবেশীদের বিরূপতা বাড়িয়েছেন এবং ট্রাম্পের মাধ্যমে পারমাণবিক আলোচনার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা ধ্বংস করে দিয়েছেন।”
ইসরায়েলি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহুর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি বলেন, “ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি একেবারে ধ্বংস করা যাবে না। তবে আমরা বিলম্ব ঘটাতে পেরেছি।”
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইরানের বেশিরভাগ পারমাণবিক কার্যক্রম ভূগর্ভস্থ এবং সেখানে ইসরায়েল কোনো হামলা চালাতে পারেনি।
দেখার বিষয়, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর এই জোটবদ্ধ আক্রমণাত্মক কূটনীতির মুখে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কতদূর এগোতে পারে? ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে, “হামলা সফল হয়েছে, কিন্তু এরপর কী? পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা কার্যকর ছিল, কিন্তু এটি কি আমেরিকাকে যুদ্ধে টেনে আনতে পারে?”
আসলে ইরানে ইসরায়েলি হামলা কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং তা পৃথিবীজুড়ে আরও নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিতে যাচ্ছে।