Published : 10 Jun 2020, 03:42 PM
বিশ্বখ্যাত দৈনিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অভিযোজন সংক্রান্ত গ্লোবাল সেন্টারের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার প্যাট্রিক ভেরকুইজেনের যৌথ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে বুধবার। ভয়ঙ্কর কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেই বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানের চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করেছে, সেটাই প্রতিপাদ্য। বাংলায় প্রবাদ আছে- বিপদের কাঁধে চেপে বড় বিপদ আসে। এটাও বলা হয়, বিপদ একা আসে না। করোনাভাইরাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ইতালিসহ গোটা উন্নত বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের জন্য প্রস্তুত ছিল, এটা বলা যাবে না। কোনো দেশই প্রস্তুত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি, যে সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তিতে কাউকে পরোয়া করে না- সেখানে কী করে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু ঘটেছে? বাংলাদেশের শহর-গ্রাম সর্বত্র করোনাভাইরাসের ছোবল। এ এমন এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি, আক্রান্তের কাছে গেলেই বিপদ। কত চিকিৎসক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। রোগীর তালিকায় সংসদ সদস্য, পুলিশ, বুদ্ধিজীবীসহ কত বরেণ্য ব্যক্তি। অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি শাখা বিপর্যস্ত। কোটি কোটি মানুষ ত্রাণের জন্য অপেক্ষমান। এমন পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশ কী করে ২৪ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়েছিল? তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছিল সাবান-স্যানিটাজার এবং খাবার। গার্ডিয়ান অন্য যে সব দেশ একই ধরনের বিপদ মোকাবেলা করছে কিংবা ভবিষ্যতে এমন কঠিন সময়ের মধ্যে পড়তে পারে, তাদের জন্য অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা তুলে ধরতে চেয়েছে। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে নয়, মাত্র এক-দেড় দিনের মধ্যেই এত বিপুল সংখ্যক লোককে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া! এ তথ্যও আমাদের জানা- বিশ্বে অন্তত ১৮০টি দেশ রয়েছে, যার কোনোটিতেই ২৪ লাখ লোক নেই।
করোনাকালেই আম্পান মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার যা করেছে, সেটাকে জায়গানটিক এফর্ট বললেও কম বলা হবে। প্রকৃতই এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমে কি বিষয়টি এভাবে এসেছে? গার্ডিয়ান যে কাজটি করেছে, আমাদের এত এত গণমাধ্যম, তারা কি সেটা করতে পারত না? গার্ডিয়ান অন্য দেশের জন্য শেখ হাসিনাকে কর্মপ্রয়াসকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে। আমরাও তো সেটা করতে পারি।
মে মাসের প্রথম দিকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার, ব্রিটেনের হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসনসহ কয়েকজন দূত বাংলাদেশে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে একযোগে টুইট করেছিলেন। বিষয়টি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না, সেটা সঙ্গে সঙ্গেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কিংবা বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিনিধি আমাদের সরকার কী নীতি অনুসরণ করবে এবং কী করবে না, সে বিষয়ে যা বলতেন সেটাই শিরোধার্য ছিল। আমাদের জাতীয় বাজেট পেশ করার আগে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী ছুটে যেতেন প্যারিসে। সেখানে 'দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর' মাঝারি মানের 'বিশেষজ্ঞরা' অর্থের প্রতিশ্রুতি দিলে তার ভিত্তিতে প্রণীত হতো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্যারিস কনসোর্টিয়াম বৈঠক বাতিল করে দিলেন। বৈঠক আয়োজন হলো ঢাকায়। পরে সেটাও বাতিল। এখন তো পরিস্থিতিতে আরও পরিবর্তন। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক প্রকল্পে অর্থ জোগান বন্ধ করে দেয়, অজুহাত হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের প্রসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার দাপুটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে 'শত্রুর' তালিকায় ফেলেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যেন নির্মূল করা যায়, সেজন্য পাকিস্তানি বর্বর সৈনিকরা পেয়েছিল আমেরিকার সর্বাধুনিক অস্ত্র। স্বাধীনতা অর্জনের পর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে সরাসরি জড়িত পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যদের যেন বঙ্গবন্ধু সরকার বিচার না করে, সে জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল তারা। হেনরি কিসিঞ্জার এখানেই থামেননি। বাংলাদেশকে উপহাস করেছিলেন বাস্কেট কেস হিসেবে। বলেছিলেন, এটা তলাবিহীন ঝুড়ি, ঋণ-অনুদান দেওয়া যাবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাদের ষড়যন্ত্র এখন অনেকেরই জানা।
২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা সেতুতে অর্থ জোগান বন্ধ করে দেওয়াও ছিল গভীর এক ষড়যন্ত্রের অংশ। আমরা স্মরণ করতে পারি, সে সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক ফের অর্থ জোগানোর সিদ্ধান্ত তখনই নেবে যখন শেখ হাসিনা রাজনীতি ও অর্থনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতকে গুরুত্ব দেবেন। এমনকি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হবে, সে বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মাথা নত করেননি। ইতোমধ্যে নিজস্ব অর্থে নির্মিত সেতুটিতে সাড়ে চার কিলোমিটার স্প্যান বসেছে। প্রমত্ত পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে গর্বিত, শির উন্নত- বাংলাদেশ। 'পদ্মা সেতু স্পিরিট' জন্ম দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে কয়েকটি দেশের টুইট বার্তায় ঔদ্ধত্য, অবজ্ঞা ছিল স্পষ্ট। দুর্ভাগ্যজনক ছিল, আমাদের কোনো কোনো গণমাধ্যমে এ টুইট বার্তার খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এক সময়ের বিশ্ব মোড়লরা যা বলে, তার চেয়ে সত্য যেন আর কিছু নেই। তারা ভুলে যায়, করোনাভাইরাস বা ঘূর্ণিঝড় আম্পান নিয়ে মিথ্যা রটনা, গুজব ছড়িয়ে দেওয়া কিংবা পোশাক শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য উস্কানি প্রদানের অপচেষ্টা মেনে নেওয়া উচিত নয়। এতে দেশ আরও বিপদে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে কী হচ্ছে? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সে অভিযোগ উঠছে সে দেশের ভেতর থেকেই। ব্রিটেনেও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর গোটা আমেরিকা জুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। বর্ণ বিদ্বেষ এখনও রয়েছে- এ হত্যাকাণ্ড তারই সাক্ষ্য দেয়। তবে এটাও আমরা লক্ষ্য না করে পারি না যে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কারফিউ ও অন্যান্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যারা রাজপথে নেমেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছেন শ্বেতাঙ্গ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলপ্রয়োগ করে এ বিক্ষোভ দমন করতে চেষ্টা করছেন। বিবিসি বলেছে, আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক পুলিশের দমন নীতির শিকার হয়েছেন। মরিচের গুড়া ও টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝে তাদের চোখ জ্বলছে। বিক্ষোভকারীদের দমনে ছোড়া রাবার বুলেটে সাংবাদিকরাও বিদ্ধ হচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও তাদের রেহাই মিলছে না পুলিশ ও হোম গার্ড সিকিউরিটির হাতে। প্রেস ফ্রিডম ট্রাকার নামে একটি বেসরকারি সংস্থা জানিয়েছে, মাত্র তিনদিনেই সাংবাদিকদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী ৯০টি হামলা চালিয়েছে।
টেলিভিশনে লাইভ কভারেজ চলাকালে মিনেসোটা পুলিশ সিএনএন-এর সাংবাদিক ও ক্রুদের গ্রেফতার করে। কেন গ্রেফতার করেছে, এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। গোটা বিশ্ব দেখেছে, সাংবাদিকদের হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. মিলার নিশ্চয়ই এ দৃশ্য দেখেছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. মিলার তার দেশের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এ ধরনের জঘন্য কার্যকলাপের সমালোচনা বা নিন্দা করবেন, এটা ভাবা যায় না। এজন্য তাকে পদত্যাগ করতে হবে আগে। সেটা তিনি করেননি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করেছিল, তখন বাঙালি অনেক কূটনীতিক পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন। তেমনটি মি. মিলার করবেন কি? এ প্রত্যাশা তার কাছে করাই যায়। কারণ তিনি তো বাংলাদেশে প্রেস ফ্রিডমের ব্যাপারে উচ্চ কণ্ঠ। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করেই তিনি টুইট বার্তা দিয়েছেন। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন ব্রিটেনের হাইকমিশনার ডিকসন সাহেবসহ আরও কয়েকজনকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ করেছেন তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে মার্কিন দূতাবাসকে প্রশ্ন করে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটা, সেটা পরিমাপের জন্য যারা সর্বক্ষণ দাড়িপাল্লা নিয়ে বসে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র্রে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনা নিশ্চয়ই তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলবে।