Published : 12 Jun 2025, 01:15 AM
গ্রেটা থুনবার্গের পায়ের কাছে বসে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানবতার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে ডনাল্ড ট্রাম্প, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তাদের সহযোগীদের। অথচ তারাই কথায় কথায় এই সুইডিশ মেয়েটিকে শিক্ষা দিতে যায়। ট্রাম্পের গত রাজত্বকালে তার অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মানচিন সে সময়ের ছোট্ট মেয়ে গ্রেটাকে বিশ্বনেতাদের পরামর্শ দেওয়ার বদলে কলেজে গিয়ে ভালো করে অর্থনীতি পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মানচিনকে জবাব দিয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত একটি লেখায় আর টুইট করেছিলেন (এখন হলে এক্স করতেন ট্রাম্পের সাবেক বন্ধু বা এক্সফ্রেন্ড মাস্ক বর্তমানে টুইটারের মালিক হয়ে নাম বদলানোর ফলে): “মানচিনের কথায় দুঃখজনক হলেও সত্য লুকিয়ে আছে। গ্রেটা মূলধারার অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা করলে তার কয়েক সেমিস্টার কাটবে বাজারের মডেল পড়তে পড়তে যাতে সে দেখবে জলবায়ু দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক সংকট বলে কিচ্ছু নেই।”
ভারাওফ্যাকিস প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের ওই লেখাটি (গ্রেটা থুনবার্গ, ডনাল্ড ট্রাম্প অ্যান্ড দ্য ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম, ২৯ জানুয়ারি ২০২০) শেষ করেছিলেন এভাবে: “অসুন্দর ও অগ্রহণযোগ্য হলেও ট্রাম্পবাদ ঐতিহাসিক মুহূর্তের এক সত্য প্রকাশ করে যখন শেষবেলার পুঁজিবাদ মানবজাতিকে এমন জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব হবে না। ট্রাম্প আমাদেরকে বলছে, এগিয়ে চল। আর মানচিন থুনবার্গকে উপদেশ দিচ্ছে মূলধারার অর্থনীতির আফিম খেয়ে আত্মাকে নির্জীব করে ফেল। তাদের দ্বারা এই ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন, তেলের ও ফাইন্যান্সের অভিশাপ যা পুঁজিবাদের চালিকাশক্তি, তার বিকল্প একটাই–আজকের টেকনোস্ট্রাকচারকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে ফেলা।”
এবার আর তার অর্থমন্ত্রী নয়, সরাসরি ট্রাম্পই পরামর্শ দিলেন গ্রেটাকে রাগ কমানোর এবং স্কুলে ভর্তি হওয়ার। কেন? ভারাওফ্যাকিস যা বলেছিলেন সেই উদ্দেশ্যে–রাগ কমানোর আফিমে আত্মাকে নির্জীব করে ফেলতে–যাতে গাজায় চলমান গণহত্যাকে লাইভস্ট্রিমে দেখেও পশ্চিমা নেতাদের মতই তার কোনো রাগ হবে না, বরং মনে হবে নেতানিয়াহুর দখলিকরণ ও ট্রাম্পের বিলাসবহুল হোটেল তৈরির মহাপ্রকল্পের কোল্যাটারাল ড্যামেজ বা সামান্য ক্ষতি মাত্র। তবে ইসরায়েলের বন্দীত্ব থেকে ফেরার পথে ফ্রান্সের বিমান বন্দরে এবার ট্রাম্পকেও জবাব দিয়েছেন গ্রেটা নিজেই: আমার মত রাগী মেয়ে পৃথিবীতে এখন আরও আরও প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল পরিচালিত পশ্চিমা রাজনীতি বর্তমানে নির্লজ্জতা, অমানুষিকতা ও বর্বতার যে উদাহরণ তৈরি করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল, যা চলছে সন্ত্রাস বন্ধের নামে, সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী, প্রকাশ্যে ঘোষিত, বিশ^বাসীর চোখের সামনে এবং ছোট্ট একটি ভূখণ্ড দখলের লোভে। এই গণহত্যা প্রকাশ করছে পশ্চিমা রাজনীতির সাম্রাজ্যবাদী, অর্থলোলুপ, দখলদারি, অনৈতিক ও অমানবিক চরিত্র। আাপন আপন দেশের জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের শাসকগোষ্ঠির গাজা গণহত্যায় এই অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সমর্থনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে পশ্চিমা গণতন্ত্রের কার্যকারিতা। পশ্চিমা রাজনীতির এই অন্ধকারের মাঝে আলো জ্বালাচ্ছে সেখানকার জনগণ, বিশেষ করে তরুণেরা। গাজায় বিশ মাস ধরে প্রতিদিন ইসরায়েলি সেনা কর্তৃক এই নির্বিচার শিশু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামছে অসংখ্য তরুণ-তরুণী, হয়তো নামতে হবে বিশ্বের সব তরুণ ও শিশুকেই।
সুইডেনের বাইশ বছর বয়সী তরুণী গ্রেটা থুনবার্গ ও তার এগারোজন সঙ্গীকে নিয়ে জুনের ১ তারিখ ইতালির সিসিলি থেকে গাজা অভিমুখে সামান্য কিছু মানবিক সাহায্য নিয়ে যাত্রা করেছিলো ম্যাডলিন নামের ছোট্ট একটা নৌকা। আর তাতেই আঁতকে উঠল বিশ্বের অতি শক্তিমান ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। রীতিমত যুদ্ধের কায়দায় হামলা করে সেই নৌকার সব যাত্রীকে আটক করল তারা। ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ডের নাগরিকও আছে এখানে, অথচ লজ্জাহীন নীরবতা অবলম্বন করল সেসব রাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পেরও মাথা খারাপ হয়ে গেল, ফোঁস করে উঠলেন তিনি গ্রেটার বিরুদ্ধে।
গত বিশ মাস ধরে লাইভ স্ট্রিমে সারা বিশে^র সবার চোখের সামনে গাজায় এই গণহত্যা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থা করছে। জাতিসংঘ বলছে প্রতিদিন গাজায় ৫০০ ট্রাক খাদ্য সাহায্য প্রয়োজন। অথচ মে মাস থেকে ২০ লাখ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। একদিকে চলছে মাথার ওপর বোমা বর্ষণ, অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে হত্যা। আবার খাদ্য সাহায্যের জন্য ঘোষণা দিয়ে ডেকে এনেও চলছে গুলি করে মারার চরম পাশবিকতা। অথচ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি চুপ। আমেরিকা ও ইংল্যান্ড তো ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে গণহত্যায় অংশগ্রহণ করছেই, এই নীরবতা অবলম্বনের মাধ্যমে গণহত্যার অংশীদার এখন পুরো পশ্চিমা সাম্রাজ্য।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন পরিচালিত এই নৌকা থেকে গ্রেটাও তাদের সবাইকে গণহত্যার সহযোগী বলে আখ্যা দিয়েছেন। একইভাবে আক্রান্ত হওয়ার কিছু আগে ম্যাডলিন থেকে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ফ্রেঞ্চ সদস্য রিমা হাসান জ্যাকোবিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আন্তর্জাতিক আইনে অবরোধ অবৈধ. ওখানে জাতিগত নিধন ও গণহত্যা চলছে। মানবিক সাহায্য দেওয়া আমাদের অধিকার।” ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপিয়ান দেশগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা গণহত্যার সহযোগী। তিনি অভিযোগ করেন যে, ম্যাক্রোঁ যখন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার কথা মুখে বলছেন, তখন ফ্রান্সের আকাশ সীমা দিয়ে নির্বিঘেœ উড়ে যাচ্ছেন যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহু।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা গাজা অবরোধ ভাঙতে তাদের সমুদ্র অভিযান শুরু করে ২০১০ সাল থেকে। সে বছর তাদের জাহাজে অভিযানে অংশগ্রহণকারী ১০ জন মানবতাবাদী কর্মী ইসরায়েলি হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। আবার সম্প্রতি মে মাসে মাল্টায় তাদের জাহাজ কনশেন্সে হামলা চালিয়ে সে অভিযানও বন্ধ করে ইসরায়েল। এবার ম্যাডলিনের ভাগ্যেও একইরকম ঘটল, শুধু সরাসরি হামলাটুকু বাদে। গ্রেটারা আগেরবারের মতো করে সাবধানতা অবলম্বন না করার সিদ্ধান্ত নেন, বরং তাদের কৌশল ছিলো বিশ্ববাসীকে জানানো যাতে হামলা থেকে সরাসরি ইসরায়েলকে বিরত রাখা যায়। কিন্তু মাথার ওপর ইসরায়েলি ড্রোনের আনাগোনায় তাদের রাত কেটেছে আতঙ্কে।
মাথার ওপর যখন ড্রোন চক্কর দিচ্ছিল সেই মুহূর্তে ম্যাডলিনে গ্রেটার সহযাত্রী ইয়াসেমিন আচার মোবাইলের ভিডিওতে বর্ণনা করেন যে, দুই রাত ধরে এই ড্রোন দিয়ে ইসরায়েল তাদের সঙ্গে মানসিক যুদ্ধে নেমেছে ও ভয় দেখিয়ে থামানোর চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, এই ড্রোন ইসরায়েলের তৈরি আর এটি চালাচ্ছে গ্রিস। গ্রিস হচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ খরিদ্দার। সুতরাং তারা কেবল ইসরায়েলের সামরিক শক্তির মুখোমুখি নয়, তার মিত্রদের শক্তিকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবু এসব দমাতে পারবে না তাদেরকে কেননা, গাজার শিশুদের মাথার ওপর প্রতি মুহূর্তে ড্রোন উড়ছে। ফিলিস্তিন স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তাদের অভিযান চলবে।
সুইডেনে ফিরে গ্রেটাও একইভাবে বলেছেন যে, ইসরায়েল তাদেরকে কিডন্যাপ করে এবং তাদের সঙ্গে মোটেও ভাল ব্যবহার করেনি। কিন্তু “প্রতিদিন ফিলিস্তিনের মানুষকে যা পোহাতে হয় হয় সে তুলনায় আমাদের কষ্ট কিছুই না।”
ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিসের এখনকার এক্স (সাবেক টুইটার) মন্তব্যটি শোনা যাক: “আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় একটি নৌকায় উঠে পড়ার ইসরায়েলি অনধিকার চর্চা এবং জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে তার নাবিক ও যাত্রীদের আটক করার এই প্রক্রিয়ায় পুরো পশ্চিমের সমর্থনে আমরা আবারও সাক্ষী হলাম আন্তর্জাতিক আইনের মৃত্যু দৃশ্যের।”
ভরসা এই—থামবে না গ্রেটা, রিমা, ইয়াসেমিন ও তাদের অকুতোভয় সঙ্গীরা–ইসরায়েল কর্তৃক গণহত্যা বন্ধ না হওয়া, নেতানিয়াহুকে হাতকড়া না পরানো এবং ফিলিস্তিনের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত।