Published : 18 Jun 2025, 09:31 PM
এনসিপির দুজন নেতার ফোনালাপ নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। এর মধ্যে একজন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। মঙ্গলবার দলের যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত নোটিশে সারোয়ার তুষারের উদ্দেশে লেখা হয়েছে, ‘আপনার বিরুদ্ধে একটি নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। উক্ত বিষয়ে আপনার সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও ব্যাখ্যা আহ্বায়ক জনাব মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব জনাব মো. আখতার হোসেন জানতে চেয়েছেন।’
এমতাবস্থায় নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগের কারণে সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, আগামী পাঁচদিনের মধ্যে ‘রাজনৈতিক পর্ষদ’ এবং এই বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে তার লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত সারোয়ার তুষারকে দলের সকল সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি সারোয়ার তুষার এবং এনসিপির এক নেত্রীর একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়— যেখানে শোনা যায়, ওই নারীটি সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব (এই প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষেত্রে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা এখানে উল্লেখ না করাই ভালো) দেওয়ার অভিযোগ করেছেন এবং এটি নিয়ে উভয়ের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এই ফোনালাপের সূত্র ধরে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, সারোয়ার তুষার তার দলের একজন নেত্রীকে ‘কুপ্রস্তাব’ দিয়েছেন।
ফোন কল ফাঁস বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। বস্তুত প্রতিটি কল ফাঁসের পেছনে একটি রাজনীতি থাকে। একটি উদ্দেশ্য থাকে। তবে এর সঙ্গে যতটা না রাজনীতি, তার চেয়ে বেশি জড়িত ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রশ্ন। এর সঙ্গে যুক্ত দেশের বিদ্যমান আইন ও সামাজিক কাঠামো।
একটু পেছনে ফেরা যাক। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কয়েকটি আলোচিত ফোনালাপ নিয়ে দেশে তোলপাড় হয়েছিল। তবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ফোনালাপ ফাঁসের মধ্য দিয়ে। ওই ফোনালাপটি যে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকেই ফাঁস হয়েছিল বা ফাঁস করা হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারা কেন ফোনকলটি ফাঁস করেছিল, তাও রাজনীতিসচেতন মানুষেরা জানেন। বোঝেন। ফলে এই নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই।
২০১৫ সালে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপও ফাঁস হয়। ডাকসুর সাকেব ভিপি নুরুল হক নুরের একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। যেটি নিয়েও বেশ তোলপাড় হয়। ২০২১ সালের এপ্রিলে সেই তালিকায় যুক্ত হন হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক—যিনি নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’কে নিয়ে আটক হয়েছিলেন এবং ওই সময়ে তিনি তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যে কথা বলেছেন, সেটিও তখন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলেন এনসিপি নেতা সারোয়ার তুষার এবং একই দলের আরেকজন নেত্রী। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুষারের সঙ্গে নারীটিকেও ট্রল করা হচ্ছে। হেনস্তা করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
প্রশ্ন হলো, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়ান, তারা যদি ফোনে কথা বলেন, তাতে আরেকজনের কী সমস্যা—যদি না তাদের মধ্যে কোনো একজন আনুষ্ঠানিকভাবে যৌন হয়রানি বা অন্য কোনো অভিযোগ আনেন? ধরা যাক, আপনি আরেকজনের সঙ্গে ফোনে এমন কিছু কথা বললেন যা গোপনীয়, কিন্তু যার সঙ্গে বললেন তিনি যদি এটা গোপন রাখেন, রাখতে চান, তাহলে তৃতীয় আরেকজন কেন সেই কথাটি ফাঁস করবেন? তবে এটা ঠিক যে রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কোনো কিছুই গোপনীয় নয় বা তাদের গোপনীয়তা ফাঁস হলে সেটিও ‘সংবাদ’ বা সেটিরও সংবাদমূল্য আছে। যে কারণে সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদেরকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়।
রাজনীতিবিদসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনকল যে রেকর্ড হয়, সেটি সবার জানা। যে কারণে এখন রাজনৈতিক নেতারা সাধারণত সরাসরি ফোনে কথা বলেন না বা খুব কম বলেন। তারা কথা বলেন হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল ও টেলিগ্রামের মতো অ্যাপে। বলা হয়, এসব মাধ্যমে কথা বললে তা রেকর্ড করা যায় না। সারোয়ার তুষার এবং ওই নারীটি কি তাহলে সরাসরি মোবাইল ফোনে কথা বলেছিলেন?
তারা এখন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। তাদের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও অনেক। জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে তাদের শত্রুর সংখ্যাও অনেক। এমনকি দলের ভেতরে কোন্দল এবং ব্যক্তিগত রেষারেষিও অস্বাভাবিক নয়। এরকম বাস্তবতায় সারোয়ার তুষার এবং দলের আরেকজন নেত্রী তাদের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে ফোনে কথা বলার সাহস করলেন কেন? তারা কি জানতেন না যে তাদের ফোনকল রেকর্ড হতে পারে বা কোনো না কোনো সময়ে এটা কেউ না কেউ ফাঁস করে দিতে পারে? আর তারা যদি সত্যিই সরাসরি ফোনে কথা না বলে কোনো অ্যাপে বলে থাকেন, তাহলে যেসব অ্যাপে কথা বলাকে মানুষ নিরাপদ মনে করে, সেগুলোর সুরক্ষা ও গোপনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। অবশ্য তুষারের সঙ্গে নারীটির আলাপচারিতা শুনে মনে হচ্ছে কোনো একপক্ষ ফোনটি লাউড করে রেখে অন্য কোনো ডিভাইসে কথোপকথনটি রেকর্ড করেছেন।
২.
ধরা যাক, দুজন ব্যক্তির মধ্যে সত্যিই প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কের সুবাদে তারা ফোনে অনেক গোপন কথা বললেন। যেহেতু তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, অতএব ধরা যাক তাদের কল রেকর্ডও করা হলো। কিন্তু তারপরও কি সেই কথা ফাঁস করে দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য? যদি তাদের মধ্যে কোনো একজন যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন, সেজন্য দেশের প্রচলিত আইন রয়েছে। এমনকি তিনি চাইলে মামলাও করতে পারেন। যদি এরকম ঘটনা ঘটে, তখন সেটি নিয়ে সংবাদ হতে পারে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কারো একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, যার সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা বা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই; যেগুলো দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, সেসব বিষয় সোশ্যাল মিডিয়ায় বা সংবাদমাধ্যমে আনার কী প্রয়োজন?
প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও গোপনীয়তার অধিকার সংবিধান-স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’ অর্থাৎ নাগরিকরা চিঠিপত্র এবং যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম যেমন ফোন, ই-ইমেল ইত্যাদির মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলে রাষ্ট্র তার গোপনীয়তা রক্ষা করবে।
১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর আর্টিকেলে বলা হয়েছে: “No one shall be subjected to arbitrary interference with his privacy, family, home or correspondence, nor to attacks upon his honor and reputation. Everyone has the right to the protection of the law against such interference or attacks.” অর্থাৎ, কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও যোগাযোগের ব্যাপারে খেয়াল খুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা যাবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
ফোনে আড়ি পাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে দেশের কোনো আইনে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে টেলিযোগাযোগ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, নিরাপত্তা সংস্থা যদি প্রয়োজন মনে করে, তদন্তের স্বার্থে বা মামলার স্বার্থে হতে পারে, তাহলে টেলিফোন সেবাদাতা সংস্থা তাদের সব রকমের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তারা যে কারো ফোনে আড়ি পাততে পারবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
কিন্তু তারপরও আমরা দেখি যে, প্রায়ই নানা লোকের ফোনকল ফাঁস হয়। কোথা থেকে এগুলো ফাঁস হয়, সেটি অনেকেই জানেন। এর পেছনে কী রাজনীতি কাজ করে, সেটি নিয়েও নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু এগুলো খুব বিপজ্জনক প্রবণতা। ফোনকল ফাঁস যে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল, এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কেননা, এটি যতটা না রাজনীতির, তার চেয়ে বেশি নৈতিকতা ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। এখানেই একজন সংবেদনশীল মানুষের ‘এসিড টেস্ট’ যে, আমরা কি আমাদের প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মানবাধিকার সুরক্ষায়ও যথেষ্ট আন্তরিক, নাকি প্রতিপক্ষ বলে তার মানবাধিকারের বিরোধী?
এটা ঠিক, ফোনালাপ ফাঁস অনেক সময় বড় কোনো ঘটনারও জন্ম দেয় বা বড় ধরনের অপরাধের হাত থেকে দেশকে বাঁচিয়ে দেয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফোনালাপ ফাঁস করা হয় মূলত কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা কাউকে ঘায়েল করার জন্য। ফলে কার ফোনালাপ ফাঁস হলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর প্রক্রিয়া ও প্রবণতা। আজ যিনি ফোনালাপ ফাঁসে খুশি, কাল যেন তাকে বেজার হতে না হয়, সেরকম একটি আইনি কাঠামো গড়ে তোলা এবং একটি মানবিক ও সহনশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলাই দায়িত্ববানদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
৩.
সারোয়ার তুষারের সঙ্গে ফোনালাপের ঘটনায় এনসিপির যে নেত্রীর নাম এসেছে, তিনি ফেইসবুকে একাধিকবার পোস্ট দিয়ে দাবি করেছেন যে, তুষারের সঙ্গে যে নারীর কথোপকথন ফাঁস হয়েছে, সেই নারীটি তিনি নন। যদি তাই হয়, অর্থাৎ তুষারের ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠস্বরটি যদি এই নারীটির না হয়ে থাকে, তাহলে তাকে ভিকটিম করা হচ্ছে কেন? তিনি হলেও তো এটি তার সম্মতি ব্যতিরেকে কেউ প্রকাশ করতে পারেন না। ভুক্তভোগী নারীটির দাবি তিনি এই ঘটনায় সম্পৃক্ত নন, তারপরও তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে ট্রল করা হচ্ছে, তাতে তার মানসিক অবস্থাটা কী দাঁড়াচ্ছে?
তিনি লিখেছেন: ‘ফাঁসকৃত অডিওর কণ্ঠ আমার না। সংশ্লিষ্ট সকলে সেটা বারবার নিশ্চিত করে বলছেন কণ্ঠ অন্য নারীর। এই পুরো ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই।’
আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেছেন: ‘রাজনীতিতে আসার ৩ মাসের মধ্যে আমি যে লড়াইটা দিচ্ছি অনেক কষ্টের, অনেক বোঝার। জুলাইকে কাছ থেকে দেখার পর শুধু আর শুধু এই দেশের টানে আমি আমার ব্যক্তিগত পরিসর ছেড়ে রাজনীতিতে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, এই মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বলেন। নারীদের রাজনীতিতে আসতে এভাবে বাধা দিয়েন না।’ তার মানে নারীটিকে ভিকটিম করা হচ্ছে তিনি রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন বলে?
সারোয়ার তুষারও সাম্প্রতিক সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলেন। টেলিভিশনের টকশোতে প্রতিনিয়ত সমসাময়িক ইস্যুতে অনেকের চেয়ে যুক্তিপূর্ণ কথা বলছিলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরুতেই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হওয়ার পথে। তুষার অবশ্য পুরুষ কণ্ঠটি যে তারই সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন। মঙ্গলবার এ বিষয়ে তিনি ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি মানুষ হিসেবে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি কোনো অপরাধ করি নাই। এ ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল ও ব্যাশিং আমি ডিজার্ভ করি না। কোনো মানুষই করেন না। এই স্মিয়ার ক্যাম্পেইন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার দলের কেন্দ্রীয় একজন যুগ্ম আহবায়ক নারী সহকর্মীকে যেভাবে অপমান করা হচ্ছে, তার সাথে আমার ছবি জুড়ে দিয়ে, জঘন্য কুৎসিত কথাবার্তা লিখে, ভিডিও বানিয়ে আমার আর তার নামে প্রচার করা হচ্ছে। যারা এই কুৎসিত কাজগুলো করছেন, দয়া করে করবেন না। রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে রাখার আহবান জানাই।’
দুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত কথোপকথন বিনা অনুমতিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া জঘন্য কাজ উল্লেখ করে তুষার লিখেছেন, ‘আমি ভুলের ঊর্ধে না। কিন্তু আমার তিন মাস আগের ব্যক্তিগত কথোপকথন কাটছাঁট করে পরিপ্রেক্ষিতহীনভাবে অনলাইনে ছেড়ে দিয়ে আমাকে অপদস্থ করার মধ্যে কোনো গৌরব নাই।’
তুষার তো স্বীকার করেই নিলেন, ফোনালাপের পুরুষটি তিনি এবং এনসিপির যে নারী নেত্রী এই জন্য হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, ফোনালাপের অপরপ্রান্তে নারীটি তিনি নন। তাহলে বলা যায় ঘটনায় অন্য কোনো নারী আড়ালে রয়ে গেছেন।
ফোনালাপটি যারা শুনেছেন, তাদের বলে দিতে হবে না যে নারীটি কিছু কথা তুষারকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতে চেয়েছেন। আগেই বলেছি, কোনো একপক্ষ কথোপকথনটি রেকর্ড করেছেন। যুক্তির খাতিরে যদি মেনে নিই, ওই নারীটি এই রেকর্ড করেছেন, তাহলেও সারোয়ার তুষারের অপরাধ লাঘব হয়ে যায় না।
নারীটি তুষারকে দিয়ে প্রস্তাবের যে ভাষাটি স্বীকার করিয়ে নিয়েছেন, এটি অত্যন্ত কুরুচিকর। কেউ কেউ বলছেন, নারীটি এনসিপির কেউ নন। নারীটি যদি সত্যি এনসিপির কেউ না হয়ে থাকেন, তাহলেও দলগতভাবে তুষারকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই এই রাজনৈতিক দলটির।
সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে অবশ্য নারীকে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ২০২০ সালে যখন অভিযোগ ওঠেছিল তখন তুষার ছিলেন রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম সংগঠক।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম সংগঠক সারোয়ার তুষারের বিষয়ে ওই নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে সংগঠনটি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানাকে আহ্বায়ক করে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (পরবর্তী সময়ে জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার স্থানে আইনজীবী সাদিয়া আরমান) ও গবেষক দিলশানা পারুলের সমন্বয়ে গঠিত ৫ সদস্যের কমিটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন।
গত মে মাসে সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের ওই অভিযোগের তখন গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি হয়নি বলে ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম ফেইসবুকে দেওয়া বিবৃতিতে সবাইকে অবহিত করেন। শহিদুল আলমের সঙ্গে মির্জা তাসলিমা সুলতানা এবং সামিনা লুৎফাও ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, তারা ৩০ জানুয়ারি ২০২১ থেকে এক বছর কাজ করেন এবং ৩০ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে সর্বসম্মতিক্রমে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
৪.
যৌনতার স্বাধীনতা পৃথিবীর একেক দেশে একেকরকম। যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বেলায় শাস্তি সর্বত্রই প্রযোজ্য। বাংলাদেশের যে সামাজিক কাঠামো, মানুষের যে বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি অনুরাগ—তাতে এখানে বিবাহ-বহির্ভূত যৌ সম্পর্ক একটি অপরাধ। সুতরাং কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ উঠলে মানুষ সেটির প্রতিক্রিয়া জানাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও কি এই দেশে পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক হয় না? হয়। অসংখ্য পরিবারে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আছে। কিন্তু যতক্ষণ না এটা প্রকাশিত হয়, জানাজানি হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ প্রতিক্রিয়া জানায় না।
সারোয়ার তুষার যদি সত্যিই ক্ষমতা দেখিয়ে দলের কোনো নেত্রীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন, সেটি ভয়াবহ অপরাধ। ফলে সত্যিই কী ঘটেছে, সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসুক।
পরিশেষে,বলতে চাই কারো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষোদ্গার কোনো উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না। পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। মানুষ এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কথা বলে। সেখানে দুজন মানুষ মোবাইল ফোনে ব্যক্তিগত পরিসরে কী কথা বললেন না বললেন, তা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর মানেই হলো, আমাদের আসলে কাজ নেই। আমাদের কাজ দরকার।