Published : 14 Jun 2025, 12:10 PM
জুন ১৯৭১। দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ধারণা দিয়েছিল যে, দেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না এবং ঢাকা শহরও সম্পূর্ণ শান্ত। কিন্তু ওই ধারণা পাল্টে দিয়ে সারাবিশ্বে খবরে জায়গা করে নেয় ঢাকার গেরিলারা। তারা গ্রেনেড চার্জ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।
ঢাকার ভেতরে প্রথম ওই অপারেশনটিতে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম (বীরপ্রতীক), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীরবিক্রম), বাদল, স্বপন ও জিয়া।
‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হিট অ্যান্ড রান’ নামক ওই অপারেশনটির আদ্যোপান্ত শুনি বীরপ্রতীক হাবিবুল আলমের মুখে। তিনি বললেন যেভাবে, “খবর ছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম ও ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান এসে উঠবেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। পাকিস্তান সরকার তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, ঢাকায় সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে এবং তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। টার্গেট ছিল ওই ধারণাটাই পাল্টে দেওয়ার। জানানো যে, ঢাকা শান্ত নয় এবং পাকিস্তানি সেনাদেরও নিয়ন্ত্রণে নেই।
৯ জুন, ১৯৭১। সিদ্ধেশ্বরীতে বাদল ভাইয়ের বাড়ি থেকে শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে যাব। রওনা দেই মাগরিবের ঠিক আগে। হোটেলের সামনে এখন যে ভাস্কর্যটা আছে সেখানে ছিল একটা বড় গাছ। প্রেসিডেন্ট ভবন (বর্তমান সুগন্ধা) পেছনে ফেলে ওই গাছটির সামনে আসি। আমরা কিন্তু জানি না তারা কখন আসবে। তারা ভেতরে নাকি বাইরে তাও জানা নেই।
হঠাৎ সাইরেন বাজার শব্দ পাই। দেখি পুলিশের এসকর্ট গাড়ি ময়মনসিংহ রোড হয়ে আসছে। পেছনে পুলিশের আরও দুই-তিনটি গাড়ি। শেষে একটি বা দুটো সাদা শেভ্রোলেট গাড়ি নজরে এলো। বুঝে যাই ওই গাড়িতেই রয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের অতিথিরা। গাড়িগুলো আমাদের পাশ দিয়েই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢোকে।
আমরা বাইরে। মেইন রোডে হোটেলের ছোট গেটে এসে আমাদের গাড়ি থামে। দেখি দেওয়ালের ওপরে অনেক মানুষের ভিড়। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিচ্ছে তারা। কিন্তু কেউই আমাদের দিকে খেয়াল করল না।
বাদল ভাইকে বললাম আপনি গাড়ি স্টার্ট করেই রাখেন। স্বপন বের হলো, আমি বাঁ পাশ ও মায়া ডান পাশ থেকে বের হলাম। জিয়াও বের হয়ে আসে। জিয়া, মায়া ও আমার কাছে গ্রেনেড। পিস্তল ছিল স্বপনের কাছে। আমি গ্রেনেডের পিন খুলতেই দেখি জিয়া তার হাতের একটি গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে। সাদা শেভ্রোলেট গাড়িটি উল্টে গেল। আমি দ্বিতীয় গ্রেনেড আর মায়া ছুড়ল তৃতীয় গ্রেনেডটি। এর মধ্যে জিয়া তার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি সদরুদ্দিনের গাড়ির ওপরে ছুড়ে দেয়।
গ্রেনেডটি গাড়ির পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই বিস্ফোরিত হয়। দেখলাম গাড়ির পেছন দিকটা একটু ওপরে উঠেই আবার নিচে পড়ে গেল। মায়া আরেকটি গ্রেনেড ছোড়ে, কিন্তু সেটা হোটেলের প্রবেশ পথে গিয়ে পড়ে।
এরপর কি ঘটল— যদি জানতে চান, কিছুই বলতে পারব না। ভেতরে ছিল পাকিস্তানি পুলিশ ও আর্মি। এটুকু শুধু বলতে পারব বিপদের মধ্যে ছিলাম তখন। কারণ ফায়ারিং শুরু হবে।
এর আগেই দ্রুত গাড়িতে এসে সাকুরা মার্কেটের সামনে থেকে ঘুরে আবার ফেরত আসি। তখন দেখি দেওয়ালের ওপর থাকা পাবলিক একজনও নেই। টেনিস ক্লাব পর্যন্ত রাস্তায় অসংখ্য স্যান্ডেল, লুঙ্গি, টুপি পড়ে আছে।
আমরা দ্রুত কাকরাইল মসজিদ থেকে ডানদিক দিয়ে চলে যাই মর্নিং নিউজের অফিসে। সেখানেও একটি গ্রেনেড চার্জ করলাম। কারণ ওরা পাকিস্তানের পক্ষে উল্টাপাল্টা নিউজ ছাপাচ্ছিল। তারপর শেষ টার্গেট ছিল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবের বাড়ি। রমনা থানার দিকে ছিল বাড়িটি। সেখানেও একটি গ্রেনেড ছুড়েই আত্মগোপনে চলে যাই। পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটেছে অপারেশনের ঘটনাগুলো।
মায়া ও জিয়াকে নিয়ে নির্দেশমতো পরদিনই মতিনগরে ফিরে যাই। ১১ জুন সকালে দেখা হয় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। খুব খুশি হয়েছিলেন। কিছু বলার আগেই বললেন, ‘খবর পেয়ে গেছি’।
তখন জানলাম বিবিসি ওইদিন রাত আটটার নিউজেই খবরটি প্রচার করে। এবিসি, অলইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অব আমেরিকাও খবরটি সম্প্রচার করে। ওই অপারেশনের কারণেই প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান ও তার টিম ভয়ে দ্রুত করাচি ফিরে যায়।”
ওইসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সারাবিশ্বে প্রতিবাদ, পদক্ষেপ ও বিবৃতিগুলো ছিল মূলত বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা মুজিবনগর সরকারের নানামুখী প্রচার ও উদ্যোগের ফসল। কিন্তু তখনও সরকারের অভ্যন্তরেও চলছিল নানা ষড়যন্ত্র। খন্দকার মোশতাক আহমদ গোপনে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের চেষ্টা করেন।
ওই সময়ে মোশতাকের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরী। মুজিবনগর সরকারের ইয়ুথ অ্যান্ড রিসিপশন ক্যাম্প বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন তিনি।
তার বর্ণনায় ওই সময়টা উঠে এসেছে এভাবে, “অলরেডি দুটি গ্রুপ তখন হয়ে গেছে। একটা গ্রুপ চাচ্ছিল কনফেডারেশন, পাকিস্তানের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে এই গ্রুপে ছিল মাহবুব উল আলম চাষী, শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ। দে আর লুকিং ফর সাপোর্ট।
আমি যাওয়ার পর ওরা বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনে সাপোর্ট করব না। ফলে মুজিবনগর সরকারে আমাকে যুক্ত করা নিয়ে তাদের এক ধরনের হেজিটেশনও ছিল। এ কারণেই হেডকোয়ার্টারে আমাকে রাখেনি ওরা।”
মোশতাক গ্রুপটি কী চাচ্ছিল?
“তাদের চিন্তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটো ফেডারেশনের মতো বানিয়ে দেওয়ার। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে কলকাতায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগেরও চেষ্টা করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মোশতাক জাতিসংঘে যাবেন, পাকিস্তান থেকে সেখানে আসবেন শাহ আজিজুর রহমান, ওখানেই তারা কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন। ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স এই খবরটি তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পৌঁছে দিয়ে সাবধান করেন। তখন তিনিই স্ট্যান্ড নেন। খবরটা একেবারেই বাইরে ছড়াতে দেননি। আনঅফিসিয়ালি পরে খন্দকার মোশতাক ও তার গ্রুপটিকে নজরবন্দী করে রাখা হয়। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর এই মোশতাকই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন।”
খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রসঙ্গে তথ্য মেলে প্রয়াত লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খানের (বীরবিক্রম) এর ভাষ্যেও। একাত্তরে কিছুদিন তিনি কলকাতায় আতাউল গণি ওসমানির এডিসি ছিলেন।
একটি ঘটনা তুলে ধরে নুরুন্নবী বলেছিলেন, “একদিন নূরে আলম সিদ্দিকী এসে বলে, ‘নবী ভাই, চলেন খন্দকার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করি। কী অবস্থা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের—একটু জানি।'
মোশতাক সাহেবের কাছে সে জিজ্ঞাসা করে, মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা কী? কী হবে আমাদের?
তিনি বললেন, গোলাগুলি করে জনগণের অধিকার আদায় করতে হবে— এই রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। এগুলো করেও কিছু হবে না।
কী করতে হবে?
কাটছাঁট করে ওরা যদি ৬ দফা মেনে নেয় তাহলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করা উচিত।
নূরে আলম বলেন, ‘আপনি তো প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ব্যাপারে কি কোনো স্টেপ নিয়েছেন?’
মোশতাকের উত্তর, ‘আমি কলকাতায় আমেরিকার এক কনস্যুলেটরের সঙ্গে লিয়াজোঁ মেনটেইন করছি। যোগাযোগ রাখছি দিল্লিতেও। তাহের ঠাকুর ও মাহবুবুর রহমান চাষীকেও কাজে লাগিয়েছি। শেখ মুজিবকে পাকিস্তান যদি জীবিত ফেরত দেয় আর ৬ দফা কাটছাঁট করে মেনে নেয়, তাহলে আমাদের যাওয়া উচিত’।”
মোশতাকের ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে সেই কঠিন সময়েও নানা ষড়যন্ত্র সামাল দিয়ে এগোতে হয়েছে। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর খন্দকার মোশতাকই তার চাতুর্য দিয়ে ধীরে ধীর বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে তার নেতৃত্বেই জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
জুন মাসে আবু সাঈদ চৌধুরীকে ব্রিটেনে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয় মুজিবনগর সরকার। ১৭ জুন তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি পত্র ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে এবং আরেকটি পত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে তুলে দেন।
আন্তর্জাতিক মহলেও তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিবৃতি এবং দেশে দেশে প্রতিবাদ বাড়তে থাকে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত সমর্থন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে। তাই ভারতের মানুষ মোটর শোভাযাত্রা করে দিল্লিতে চীনা অ্যাম্বাসি ঘেরাও করে এবং বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে চীনা উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়।
২৫ জুন পশ্চিমবাংলার বাঙালিরাও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং স্মারকলিপি প্রদান করে। ওইদিন ফেস্টুনে লেখা দাবিগুলো ছিল- ‘Arms aid to Pakistan is abetment of genocide’, ‘Stop The Ship’, প্রভৃতি। সেদিন সবার মুখে উচ্চারিত হয়, ‘বাংলাদেশ থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ— হাত উঠাও, হাত উঠাও’।
১৭ জুন সুইডেন, হল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিসহ বেশ কয়েকটি দেশ ঐক্যমত প্রকাশ করে বলে, “পাকিস্তান পূর্ব বাংলার ওপর একতরফাভাবে কোনো সমাধান চাপিয়ে দিতে পারে না। ইউরোপের এসব দেশ তাদের মিত্র দেশসমূহের সঙ্গে মিলে ইয়াহিয়া সরকারকে তাদের এই মনোভাব জানিয়ে দেবে।”
ওইসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান। এ সময় তাকে শরণার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত করে ইন্দিরা গান্ধী গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কড়া পদক্ষেপ দাবি করেন।
এছাড়া বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দৈনিক আনন্দবাজার প্রভৃতি পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র-দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড, বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস-ফজলুল কাদের কাদরী)
এদিকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর কর্তৃক গণহত্যা সারা দেশেই চলছিল। ১৭ জুন সকালে পাকিস্তানি সেনারা ঝালকাঠির জগদীশপুর, খাজুরা, রামপুর, মিরাখালি ও বেতরা গ্রামে প্রাণের ভয়ে পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়া হিন্দু ধর্মালম্বীদের আটক করে পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। পরে জগদীশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে তাদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। এতে শহীদ হন প্রায় ৬০ জন নিরীহ মানুষ। এমন গণহত্যা চলে সারাদেশেই। (তথ্যসূত্র: গণহত্যা’৭১-তপন কুমার দে)
তবে জুন মাস থেকেই পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণের মুখোমুখিও হতে থাকে। চট্টগ্রামের চাঁদগাজীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল গোলাগুলি চলে। এতে হানাদার বাহিনীর ৪৫ জন সৈন্য নিহত হয়।
২২ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে করাচি হয়ে সংক্ষিপ্ত সফরে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা পর্যবেক্ষণে আসেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার ও কনজারভেটিভ দলের চার সদস্য— আর্থার বটমলি, বব প্রেন্টিস, জেমস র্যামসডেন ও টবি জেসেল। ২৪ জুন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের লবিতে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তারা। ওইসময় তিনজন গেরিলা হোটেলের বারান্দায় দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র-নবম খণ্ড, মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স-খালেদ মোশাররফ)
অন্যদিকে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আরও সক্রিয়ভাবে সহযোগিতায় ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে শান্তিকমিটি ও তৎকালীন জামায়াতে ইসলামের নেতারা। ২১ জুন ১৯৭১। পাকিস্তানের লাহোরে ফাতেমা জিন্নাহ রোডে অবস্থিত জামায়াত অফিসে কর্মীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাতে থেকে রক্ষা করার অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না।” (দৈনিক সংগ্রাম, ২২ জুন ১৯৭১)
২২ জুন করাচির এক হোটেলে আয়োজিত সাংবাদ সম্মেলনে ভাষণদানকালে গোলাম আযম বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সব সময়ই তাদের পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের সাথে একত্রে বসবাস করবে।”
তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তানের আদর্শ গোটা জাতির জন্য পথ-নির্দেশক এবং একমাত্র ইসলামই দেশের দুই অংশকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে পারে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।”
যেসব দল খোলাখুলিভাবে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু করেছিল এবং স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য জনগণকে উত্তেজিত করেছিল, ওইসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান। যে নীতি দেশের উভয় অংশকে এখনও পরস্পর ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম সে সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া ও কাজ করার জন্য জামায়াত নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, এক্ষণে সকল ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে কার্যকরী সহযোগিতার সাথে কাজ করতে হবে এবং কর্তৃপক্ষের সাথেও সহযোগিতা করতে হবে।
তিনি আরও জানান, পিণ্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎকালে তিনি প্রেসিডেন্টকে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। (দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ জুন ১৯৭১)
পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবেলায় মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি একাত্তরে আরেকটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়। বাহিনীটিকে প্রথমে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, সংক্ষেপে বিএলএফ বলা হলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সেটির নামকরণ হয়— মুজিব বাহিনী। মূলত দেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এস এস উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় এ বাহিনী।
মুজিব বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্যকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তারাই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ ও রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত করে সাংগঠনিক কাঠামো বৃদ্ধি করবে— এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কেন্দ্রীয়, পূর্বাঞ্চলীয়, দক্ষিণাঞ্চলীয়, উত্তরাঞ্চলীয়— এই চারটি সেক্টরে ভাগ করে এ বাহিনী যুদ্ধ পরিচালনা করে।
বিএলএফ-এর ধলেশ্বরী হেডকোয়ার্টারের জোনাল কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল হক। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। জুনের মাঝামাঝি সীমান্ত পার হয়ে চলে যান ভারতে, মহারাজা বীর বিক্রম কলেজ ক্যাম্পে। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের।
ওই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘রব ভাই নিয়ে গেলেন আগরতলায় ‘শ্রীধর ভিলা' নামের এক বাড়িতে, (শেখ ফজলুল হক) মনি ভাইয়ের কাছে। উনি বললেন, ‘একটা বাহিনী করতেছি। তুই, ছেলে কালেকশন করে দিবি’। জানলাম ওটা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব আমি। পরদিন তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমাকে আগে ট্রেনিংয়ে পাঠান। এরপর আপনি যা বলবেন তাই করব।’ মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘তুই কালই ট্রেনিংয়ে যাবি’।
আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের দেরাদুন মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে। বিএলএফের ফার্স্ট ব্যাচে ছিলাম ৪৯৬ জন। ট্রেনিং হয় দেড় মাস। ইন্ডিয়ান আর্মির মেজর মালহোত্রা ছিলেন ক্যাম্পে। সিলেটের একজন রিটায়ার্ড বাঙালিও ছিলেন, নাম কর্নেল পুরকায়াস্থ প্রকাশ। যুদ্ধকালীন আমাদের সরাসরি কমান্ড করতেন বিএলএফ-এর অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি। তোফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকও ছিলেন এই বাহিনীর যৌথ অধিনায়ক। মনি ভাইয়ের স্বাক্ষরিত ও হাতে লেখা নির্দেশনা মেনেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি।’’
সিরাজুল হকের মতে, ‘‘বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী ছিল পলিটিকো ওয়ার গ্রুপ। মুক্তিযুদ্ধের পরে বামপন্থিরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে, তাই আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপ থাকা প্রয়োজন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে যারা পালিটিক্যালি ক্ষমতা দখলে রাখবে— এটাই ছিল উদ্দেশ্য।’’
কিন্ত মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় এবং নেতৃত্বেও কোনো সংকট তৈরি না হওয়ায় বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর বিকাশটা তেমন ঘটেনি। তবে একাত্তরে সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়াও ছোটখাট বহু অপারেশন করেছেন এ বাহিনীর যোদ্ধারা। শহীদ আর আহতও হয়েছেন অনেকেই।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরোপুরি একটি জনযুদ্ধ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সেখানে যুক্ত ছিলেন সাধারণ মানুষও। একাত্তরে ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে স্বাধীনতার পক্ষে দুঃসাহসিক কিছু কাজে যুক্ত ছিলেন ফেরদৌসী হক লিনু, শিরীন আখতারসহ কয়েকজন স্কুল ও কলেজপড়ুয়া মেয়ে।
অজানা ওই ইতিহাস শোনা যাক ফেরদৌসী হক লিনুর মুখেই, ‘‘ওখানে অনেক পরিবার ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। তাদের চিঠি লিখলাম৷ লাল চিঠি। লেখা থাকত, ‘তোমরা যে পাকিস্তানের দালালি করছ, এ খবর চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তোমাদের শায়েস্তা করা হবে।’ শিরীন আপার ছোট বোন বেবী ও ভাই নিলুসহ বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেটারবক্সে চিঠি ফেলে আসতাম। পরদিন সকালবেলা নানা অজুহাতে ওইসব বাসায় ঘুরতে গিয়ে দেখতাম মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে তাদের রান্না হয়নি, নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিত। এভাবেই শুরুটা হয়।’’
আজিমপুর কলোনির বেশিরভাগই তখন সচিবালয়ে চাকরি করেন। বাড়ি বাড়ি লিফলেট পৌঁছাতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগের খবরগুলো দ্রুত সচিবালয় হয়ে পাকিস্তান সরকারের কানে পৌঁছাবে। এমন চিন্তা থেকে তারা তখন লিফলেটও বিতরণ করেছিলেন।
লিনু বলেন, ‘‘গেরিলা সানু ভাই টিচার্স ট্রেনিং কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারীকে দিয়ে সাইক্লোস্টাইল করে লিফলেট বানিয়ে আনেন। কলোনির কাছের বিল্ডিংগুলোতে বেবী ও নিলু আর দূরের বাড়িগুলোতে আমি, লিটু আর শিরীন আপা সন্ধ্যায় হাঁটার নাম করে দরজার নীচ দিয়ে লিফলেট ফেলে আসতাম।
একবার পরিকল্পনা করি আজিমপুরের রাস্তায় পোস্টারিং করার। ফৌজিয়া খালার পরামর্শে রঙ-তুলি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি এঁকে পোস্টারে লেখা হয়, ‘পাক আর্মি সারেন্ডার করো'। তারপর আমি আর শিরীন আপা ফজরের আজানের পরপরই আটা দিয়ে আঠা তৈরি করে পোস্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।’’
পোস্টারিং হওয়ার কিছুদিন পরই আজিমপুর কলোনির রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে পাকিস্তানি আর্মিরা তল্লাশি চালায়। ওরাও বুঝে যায়, কলোনির ভেতর থেকেই কেউ এটা করছে। কিন্তু কেউ চিন্তাও করেনি, এগুলো কলোনির মেয়েদেরই কাজ। স্বাধীনতালাভের পর ওই পোস্টারের একটি কপি বাংলা একাডেমির আর্কাইভে জমা ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ফেরদৌসী হক লিনুরা একাত্তরে যা করেছেন, তা অন্যরকম এক যুদ্ধ। ঢাকার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে জানান দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে সাহসী করে তোলার কাজটি তারা করেছিলেন গেরিলা দলের মতোই। এ কাজে জীবনের ঝুঁকি ছিল অনেক। তবু বুকের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করে এমন যুদ্ধ তারা চালিয়ে গেছেন। সারাদেশে সাহসী মানুষদের এমন উদ্যোগগুলোই স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিল।