Published : 31 May 2025, 06:28 PM
মানুষ কেন বাঁচে? একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকার প্রেরণা তার জীবন, তার পরিবার। সমাজের মানুষ বাঁচে সামাজিক জীব হিসেবে। আর যূথবদ্ধ মানুষ বাঁচে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রব্যবস্থার শুরুতেই মানুষ সীমানা নির্ধারণ করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছিল। এই সীমানা শুধু ভৌগোলিক ভাবলে ভুল হবে। এর পেছনে থাকে জাতির ইতিহাস আর সংস্কৃতি। তবে মূল বিষয় হলো ভাষা। ভাষাভিত্তিক ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কথা বলতে পারে, লিখতে পারে। এই কারণে সে সংস্কৃতিনির্ভর। যে দেশ বা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি নেই, তার বেঁচে থাকার আনন্দ কম। জীবনধারণ আর জীবনযাপনের পার্থক্য এখান থেকেই বোঝা যায়।
এখন প্রশ্ন, বাঙালি কি শুধু বাঁচবে, নাকি জীবনযাপন ও উদযাপনে বাঁচবে? এতদিন এ নিয়ে সংশয় থাকলেও প্রশ্ন ছিল কম। বরং মনে করা হতো বাঙালি বাঁচতে শিখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার আনন্দ ক্রমশ কমছে। এর মূল কারণ মব। মবকে কেন কালচার বলা হয় জানি না। সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের দৌরাত্ম্য কখনো সংস্কৃতি হতে পারে না। উদ্বেগের বিষয়, এটা বাড়ছে এবং আমাদের সমাজকে ধ্বংস করছে।
যে বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম, তা পাইনি। আশার রেখা আবার জাগবে বলে আশা করছে মানুষ। যদিও হঠাৎ দমকা হাওয়ায় বাঙালি সংস্কৃতি নিভু নিভু। অথচ অনেকে অবাক হন, কেন প্রতিরোধ নেই। যারা প্রতিরোধের শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছেন, তারা বিদেশে আরামে থাকলেও দেশের সাধারণ মানুষ তাদের কারণে অস্বস্তিতে। প্রতিরোধের কথা বলছিলাম। অচলায়তন বানিয়ে নিজেদের কিছুকাল আরামে রাখা গেলেও সময় ছেড়ে কথা বলে না। আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি সংস্কৃতির দুর্ভোগ থেকে উত্তরণ সহজ হবে না।
একটি ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলি। তৈলনিমজ্জিত সময়ে এক প্রবীণ বুদ্ধিজীবী জানিয়েছিলেন, এক সভায় মহামান্যের কৃপা পাওয়ার আশায় আমার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ভাষণ দিয়েছেন, কিন্তু লেখকের নাম বলেননি। আমি প্রতিবাদ করতে পারি ভেবে তিনি বলেছিলেন, ভাষণটি ছাপা হলে সৌজন্যে আমার নাম লেখা হবে। কিন্তু তা কখনো হয়নি, হওয়ার কথাও ছিল না। এই ঘটনা বললাম কারণ বয়োবৃদ্ধ এই মানুষেরা পরের মাথায় কাঁঠাল রেখে তারুণ্যকে অবহেলা করতেন। ‘ধর্মে আছি, জিরাফেও আছি’– টাইপের লোকজন এখন উধাও। কারণ এখন মাঠে যারা, তারা সংঘবদ্ধ।
একসময় দেশে ছোটখাটো অনাচার বা অন্যায় হলেও সংস্কৃতির মাধ্যমেই তা প্রতিরোধ করা যেত। প্রতিবাদের বন্যায় অন্যায় ভাসিয়ে দিত। কিন্তু তাদের বিষহীন করে ফেলা হয়েছিল। পদ, পদক আর প্রলোভনে মত্ত এরা কর্তব্য ভুলে তৈলমর্দনে ব্যস্ত থাকায় খেলা হাতছাড়া হয়ে গেছে। আজ বলতে পারি, একমুখী করার নামে যে অন্যায় ও অপমান, তার জবাব পেতে হবে—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অযোগ্য, অপদার্থ আর অন্ধ মানুষের ভিড় বাড়তে বাড়তে খাঁটি মানুষেরা হারিয়ে গেছেন। এখন দূরবিন দিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে কি আমাদের উদ্ধার নেই? মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক বিষয়গুলোর ধার আগেই ভোঁতা হয়েছিল। ‘আমি আমি’ করতে করতে ‘আমর ‘ শব্দটাই হারিয়ে গেছে। চেতনা এখন হাস্যকর। এই হাস্যকর বিষয় বানানোর কারিগরেরা কাঁদলেও মানুষ আর বিশ্বাস করে না। এমনকি সংঘবদ্ধ প্রতিবাদও দেখা যায় না। এমনটা পঁচাত্তরেও হয়নি। যখন রাজনীতি কঠিন সময় পার করছিল, দেশের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি চলছিল, তখন সংস্কৃতি কর্মীরা পথে নামত। শুধু পথে নামা নয়, অভাবনীয় শক্তি যোগাত। তখন রাজনীতি সংস্কৃতির পেছনে আশ্রয় নিত। একে একে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের সময় যারা ভেবেছিল এগুলো আর লাগবে না, তারাই এখন কাঁদছে।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাসন রাজারা কতবার আক্রান্ত হয়েছেন, তার হিসাব নেই। কিন্তু তারা মনে করতেন ডাণ্ডার জোরে সব চাপিয়ে রাখা যায়। অথচ এরা শিশু-কিশোর সংগঠনসহ যুবকদের স্বপ্ন ধ্বংসে কসুর করেননি। রাজনীতির হাতে সংস্কৃতির অপমান চলত প্রতিদিন। প্রতি বছর হাস্যকর পুরস্কার আর পদে ভূষিত মানুষগুলো এখন উধাও। অথচ যারা তাদের চোখে বন্ধু ছিল না, তারাই রয়ে গেছেন। যাদের তারা দুশমন মনে করত, তারাই কথা বলছেন।
পরিবর্তন জীবনের চিহ্ন। পরিবর্তন যুগে যুগে মানুষকে বদলেছে, বদলাবে। কিন্তু নেতিবাচক পরিবর্তন মোকাবেলার শক্তিকে কখনো দুর্বল করা উচিত নয়। করলে কী হয়, তার ফল বাংলাদেশ হাতেনাতে পাচ্ছে।
সংস্কৃতি হোক বা জীবন, প্রথম শর্ত নিরাপত্তা। যারা এটা বোঝেন, তারা বারবার দেশ ও সমাজকে অনিরাপদ করতে ব্যস্ত থাকবেন। কারণ তা না করলে তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে না। বাংলাদেশের শেষ ভরসা মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। মুক্তবুদ্ধিকে পিঞ্জরে বন্দি করে যারা আনন্দ পেত, তারা এখন চাইলেও দুয়ার খুলে তাকে আকাশে উড়াতে পারবে না। মুক্তবুদ্ধির ওপর চেপে বসছে নানা সংস্কার।
বাকি রইল মানুষ। তারা এখন চুপ। চুপ থাকতেই পারে। বারবার জীবন বিসর্জন দিয়েও তারা প্রতিকার পায়নি। তারা মনে করতেই পারে, “যা হবে হোক, আমার তাতে কী?” অথচ সংস্কৃতি না জাগলে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, গণজাগরণ বা জুলাইয়ের উল্লাসও টিকবে না। বাংলা-বাঙালি কবে শিকড়ে ফিরবে, কে জানে? সময় চলছে তার নিজস্ব নিয়মে। সংস্কৃতি কি ঘুমিয়েই থাকবে?