Published : 08 Jun 2025, 07:39 PM
ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করতে গেলে কিছু মুসল্লি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ‘স্যার, ৫ বছর; দালালদের কথা শুনবেন না।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো বটেই, মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশ পেয়েছে সেদিনই।কোনো সংবাদমাধ্যম আলাদা শিরোনাম করেছে, কোনোটি আবার ঈদ জামায়াতের খবরের ভেতরেই রেখেছে প্রসঙ্গটি।
এবারই প্রথম নয়, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ আদায় করতে গেলেও একই রকমভাবে কিছু মুসল্লি মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকতে দাবি করেছিলেন। কেউ কেউ রীতিমতন মিছিল করার অবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন। এর ওপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে, দেশের জনগণ অধ্যাপক ইউনূসকে কমপক্ষে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চান।
রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে প্রধান উপদেষ্টার এমন ঘোষণার পরদিন ঈদ জামাতে ওই দাবি করা হয়।
বক্তব্যটিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলা যেতে পারে, ওই সকল ‘জনগণ’ চান দেশে যেন আগামী পাঁচ বছর কোনো নির্বাচন না হয় এবং ড. ইউনূস কমপক্ষে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকেন।
এই বক্তব্য অনেকটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু নেতার মতো যারা পরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামক দল গঠন করেছেন। যারা এই দাবি তুলেছেন তারা এনসিপি নেতাকর্মী সেটি না হলেও তাদের সমমনা একথা বলা যায়। বাংলাদেশের দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রতি বিরক্ত কিছু সাধারণ আবেগী মানুষও সেখানে থাকতে পারেন।
মুখে নির্বাচনের কথা বললেও এনসিপি বার বার নির্বাচনের সঙ্গে ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘না হলে’, ‘করতে হবে’ ইত্যাদি শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এই কথার অর্থ হতে পারে, নির্বাচন তাদের প্রাধান্য নয়।
‘দালালদের কথা শুনবেন না’—এই উক্তির আরেকটি শব্দ ‘দালাল’ শব্দটি সরলীকরণ করলে দাঁড়ায়, এই দালাল হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং অন্যান্য সমমনা দল যারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় বিএনপির এক নেতা নির্বাচনের দাবি করায় এনসিপির এক শীর্ষ নেতা অভিযোগ করেন, তিনি ভারতের সুরে কথা বলছেন। জবাবে বিএনপি নেতা বলেছেন, তাহলে যারা নির্বাচন চাচ্ছে না তারা কি আমেরিকা ও চীনের সুরে কথা বলছে!
রাজনৈতিক দল ছাড়াও আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে ‘দালাল’ হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে চিহ্নিত করা হয়েছে: সেটি হলো বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে যিনি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছেন।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক দল এবং অন্যরা কার দালাল? ‘স্যার, ৫ বছর’ গ্রুপের কথায় তারা ভারতের দালাল। যদিও এই ভারতীয় দালালের মধ্যে আর কারা আছে জানতে চাইলে ইউনূস-অনুরাগীরা আওয়ামী লীগের দালাল, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দোসরকেও সামনে আনবে।বাস্তবতা হচ্ছে, এই দলটির নেতারা হয় পলাতক, নয় জেলে।কর্মী-সমর্থকরা ভীতসন্ত্রস্ত।নির্বাচন নিয়ে ভাববার সাহস ও সুযোগ তাদের নেই।
বাংলাদেশে এখন নির্বাচন অথবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বললেই বলা হচ্ছে ভারতের দালাল। কারণ ইউনূস সরকারকে আস্থায় না নিয়ে বিভিন্ন প্রকার চাপে রাখছে ভারত। দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে বলে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চায়।
শেখ হাসিনার আমলে এমন অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবি আসত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য পশ্চিমা ও সমমনা দেশ এবং জাতিসংঘের কাছ থেকে।
এই দাবি করলেই তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হতো, মার্কিন এজেন্ট, যে তকমা আমি নিজেও পেয়েছি তখন।
শেখ হাসিনার পতনের পর পরিস্থিতি ঠিক উল্টো, পশ্চিমারা এখন আর জোরেশোরে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলছেন না। বলছেন, সংস্কার তো করতে হবে। সময় লাগবে।
কেন বলছেন না? কারণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলা হলেই আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সামনে আসবে এবং বলা হবে, আওয়ামী লীগ ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।
কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের আবাসিক এক কর্মকর্তা বললেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক মানে দল নয়। জনগণ অংশ নিলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। অর্থাৎ সুর পরিবর্তন। তখন বলতেন সকল দলের অংশগ্রহন। এখন বলছেন, জনগণ থাকলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক। কিন্তু রাজনৈতিক দল ছাড়া জনগণের অন্তর্ভুক্তি একটি বিতর্কিত বিষয়।
আওয়ামী লীগের আমলে ‘দল নয়, জনগণের অংশগ্রহন’ আছে দেখিয়েই ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের একতরফা, প্রহসনমূলক নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। তখন ভারতও বলত, সাংবিধানিক বৈধতার কথা। জনগণের অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনের কথা।
অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের অবস্থান যেন অদলবদল হয়েছে।যাই হোক ফিরে আসা যাক মূল কথায়: যারা নির্বাচন চাচ্ছেন তারা কি সত্যি কারোর দালাল?
একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলো সাংবিধানিক ব্যবস্থার আওতায় অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিবন্ধকতাবিহীন এবং সকল আগ্রহী দল ও ব্যক্তির অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবি করবে রাজনৈতিক দল ও আপামর জনসাধারণ, এটিই স্বাভাবিক। এটি অন্যায় কিছু নয়। বরং এটিই গণতান্ত্রিক আচরণ। যে দেশে সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হয় না সেই দেশকে কোনভাবেই ন্যূনতম গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
‘স্যার, ৫ বছর’ দাবি করণেওয়ালারা কোনো সাধারণ মানুষ নন। এরা পরিকল্পনা করেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সংবাদমাধ্যমে কাভারেজ নিয়েছে বলে সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এরা একটি চিহ্নিত দলীয় দালাল অথবা এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী।
তারা মুহাম্মদ ইউনূসের ভালো চান না। অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে বেইজ্জত হলে তাদের কোনো ক্ষতি নেই। তারা চান, যতদিন পারা যায়, ইউনূসকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দলীয় এবং গোষ্ঠীগত সুবিধা আদায় করতে। নিষ্ক্রিয় পুলিশের সুযোগ নিয়ে মব জাস্টিসের মাধ্যমে তাদের সুবিধা ভালোভাবেই আদায় হচ্ছে।
এখন ছোট-খাটো দল থেকে শুরু করে সবাই নেতা। সবাই প্রতাপশালী। সেটি হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা সেই আতঙ্ক থেকেই এমন দাবি।
কিন্তু নির্বাচন হলে তাদের সমর্থিত দল হেরে যাবে। তাদের নেতাদের কোনো হদিস মিলবে না। জয়ী দল সরকার গঠন করে পুলিশসহ সকল নির্বাহী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেবে। তখন তাদের প্রভাব থাকবে না। সুবিধাও হবে না। অবস্থা হবে রান্নায় ব্যবহৃত তেজপাতা ও এলাচের মতো।
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের নেতা এবং জনপ্রতিনিধি নির্ধারণের একমাত্র পথ হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিবন্ধকতাবিহীন নির্বাচন। এখানে আবেগের কোন স্থান নেই। এই ব্যবস্থাকে ঠাঁই দিলে পরবর্তী সরকারগুলোও ঈদের নামাজ অথবা কোন গণজমায়েতে এভাবে ৫ বছর, ১০ বছর থাকার দাবি জানিয়ে যাবে। এগুলো অসভ্যতা। গণতান্ত্রিকতা নয়। জনগণের ম্যান্ডেটও নয়।
শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখনও আমরা দেখতাম তার দল, অঙ্গ সংগঠনের নেতা এবং কিছু প্রতিষ্ঠিত দলবাজরা স্লোগান দিত ‘শেখ হাসিনার সরকার, বার বার দরকার।’ সেই স্লোগান দেয়ালে দেয়ালে স্থান পায়নি দেশের এমন কোনো স্থান নেই।
তাদের কথা ছিল, শেখ হাসিনা দেশের জন্য ছিলেন অপরিহার্য। তিনি ছাড়া বাংলাদেশ অচল হয়ে যাবে। টিকবে না।
এই স্লোগানগুলো দিয়ে শেখ হাসিনাকে হয়তো তৈল-মর্দন করা গেছে। কিছু সুবিধা নেওয়া গেছে। কিন্তু তাকে রক্ষা করা যায়নি।
এই স্লোগান শুনে শেখ হাসিনা হয়তো আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেই হয়েছেন বেইজ্জত।
শেখ হাসিনা ভারতে চলে গেছেন। বারবার তাকে দেখতে চেয়ে স্লোগান দেওয়া লোকগুলোও আর দৃশ্যপটে নেই। সেই স্লোগানের ওপরে স্থান পেয়েছে, ‘শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই’ স্লোগান ও দেওয়াল লিখন।
অধ্যাপক ইউনূসকেও কিছু মানুষ শেখ হাসিনার স্তরে নিজে যেতে চাচ্ছেন এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনিও হয়তো এই সকল ধান্দাবাজ, মতলবাজ তোষামোদকারীদের খপ্পরে পড়ে থাকতে পারেন। সেই কারণেই তিনি নির্বাচন নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলছেন। বিভিন্ন বিতর্কিত এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছেন।
ড. ইউনূসও যদি নিজেকে অপরিহার্য মনে করে ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘায়িত করতে চান তাহলে সেটি হবে মস্ত ভুল। কারণ রাজনীতি এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এক জিনিস নয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভুল হলে অর্থের বিনিময়ে সেটি হয়তো সংশোধন করা যায়। কিন্তু রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতিতে তা চলে না। একবার ভুল হয়ে গেলে এর খেসারত দিতে হয় নিজের যাবতীয় অর্জন এবং কখনও কখনও জীবন দিয়ে।
মুহাম্মদ ইউনূসের উচিত হবে, তোষামোদকারীদের কথা না শুনে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শক্রমে যৌক্তিক সময়ে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে একটি সম্মানজনক বিদায় নিশ্চিত করা। সবশেষে একটি প্রচলিত কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, ‘তোমার শত্রুকে ভয় পাবে না। ভয় পাবে যারা তোমাকে তোষামোদ করে তাদের।’