Published : 29 May 2025, 02:40 PM
“কেউ বলে ‘র’ কেউ ‘আইএসআই’
আমার মতো বাংলা দালাল একটাও নাই!”...
ঘৃণার প্রতিশব্দ যেন ট্যাগ। এখন নাকি কেউ আর ‘আই ইেইট ইউ’ বলে না, বলে ‘আই ট্যাগ ইউ’। ইংরেজিতে প্রচলিত প্রাচীন একটি প্রবাদ আছে, “গিভ হিম আ ব্যাড নেইম দেন কিল।” বর্তমান সময়ে লিখলে প্রবাদটি, “গিভ হিম আ ট্যাগ দেন কিল” এভাবে লেখা হতো নিশ্চয়ই। ট্যাগ দিয়ে গ্রেপ্তার তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা এবং হত্যা মামলা দেওয়াকেও বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। আর এই ট্যাগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দালাল শব্দটা। আজকাল অবশ্য দোসর শব্দের ব্যবহারও দেখছি।
ঐতিহ্যগতভাবে আমরা দালালদের কীভাবে পেয়েছি, ওই আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা বলে নিই। আসাদাল, মোশাদাল ও ঘনাদাল— এই তিনজনের কাছ থেকে রঙিন শৈশবে আমরা ‘দালাল’ সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান লাভ করেছিলাম। আমাদের পাড়ায় আসাদ নামে এক বয়স্ক লোক ছিলেন, যার কাজ ছিল জমি কেনাবেচা করা। পাড়ায় তার পরিচিতি ছিল জমির দালাল হিসেবে। এক সময় তার নাম হয়ে যায় আসাদাল (আসাদ জমির দালাল, সেখান থেকে আসাদ দালাল, এরপর আরও ছোট হয়ে গেলেন আসাদাল)।
অন্যজন ছিলেন মোশাররফ ওরফে মোশা। তার আত্মীয় বা পরিচিতজনরা তাকে না চেনার ভান করত। মাঝেমধ্যেই পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে গেলেও আত্মীয় বা পরিচিতজনরা মুখ ফিরিয়ে নিত। তিনিও দালালি করতেন, কীসের দালালি সেটা পাঠকরা বুঝে নিয়েন। বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় কেউ কেউ বলে মোশাদাল বেঁচে থাকলে এখন তার অবস্থা আরও রমরমা হতো! সে যাই হোক ঘনা মিঞা ছিলেন গরুর দালাল। তিনি নাকি সীমান্তে গরু চোরাচালানের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। কোরবানি ঈদের দু-একমাস আগে থেকে পাড়ায় ঘনা মিঞার আগমন বেড়ে যেত। ঘনা দালালের নাম সংক্ষিপ্ত হয়ে ঘনাদাল হলেও অনেক সময় মনে হয় আসাদাল বা ঘনাদালদের দরকার আছে!
আসলে দালাল উপাধি দিতে আমরা হয়তো ভালোবাসি। এটা মোগল আমল থেকেই ব্যাপক প্রচলিত। মোগলদের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশের শাসকদের বেশিরভাগ ছিলেন বহিরাগত। এদেশীয় যারা মোগলদের অনুগত ছিলেন তাদের অনেককেই বলা হতো মোগলদের দালাল। বিশেষ বাংলা বারো ভূঁইয়ার আমলে মোগল দালালদের যে ঘৃণা করা হতো এটা ঐতিহাসিক সত্য। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের অনুগত বা দালাল সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। পত্রিকা বা ঐতিহাসিক বইপত্র ঘেঁটে দেখুন এই দালালদের সংখ্যা অনেক।
পক্ষে-বিপক্ষে অনেকের নামই বলা যায়, প্রথমেই যে মানুষটির নাম মনে এল, তার নাম হাল আমলে বলা কঠিন, তার রেখে যাওয়া দলের দৌরাত্ম্যে আমরা এখন ভীতসন্ত্রস্ত। বরং এই বাংলার দু-জনের নাম বলি। একজন হলেন মাস্টারদা সূর্যসেন, অন্যজন মাস্টারদাকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া নেত্র সেন। ১০ হাজার টাকা পুরস্কারের লোভে নেত্র সেন ধরিয়ে দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নায়ক সূর্যসেনকে। অবশ্য ইতিহাস বলে নেত্র সেন ওই পুরস্কার ভোগ করতে পারেননি, তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল সূর্যসেনের অনুসারীদের হাতে।
এবার পাকিস্তান আমলে আসা যাক। পাকিস্তান আমলে ভারতের দালাল শব্দটা রাজনীতিতে জেঁকে বসে। বলা যায় দালাল শব্দটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পায় তখন থেকে। কোনো কাজ বা কথা ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে গেলেই দালাল ট্যাগ দেয়া হতো। সবচেয়ে বড় ট্যাগধারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার বিরুদ্ধে ত্রিপুরায় গিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেয়া হয়েছিল। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগপর্যন্ত শেখ মুজিব পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের কাছে ছিলেন সবচেয়ে বড় ভারতের দালাল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড় গালি হয়ে দাঁড়ায় রাজাকার, আল বদর! এদের নাম পাকাপোক্ত হয়ে যায় পাকিস্তানের দালাল হিসেবে। পাকিস্তান আমলের মতোই বিরোধী মতকে দাবায়ে রাখার জন্য দালাল ট্যাগ দেয়ার ঐতিহ্য বজায় থাকে। পাশাপাশি আইয়ুব-ইয়াহিয়ার দোসর, সাম্রাজ্যবাদের দালাল, পাকিস্তানি ভূত বা প্রেতাত্মা শব্দগুলোও চালু হয় ট্যাগ হিসেবে।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর ভারতীয় দালাল বা রুশ-ভারতের দালাল শব্দটা আবার ফিরে আসে। মূলত আওয়ামী লীগের লোকজনই এই ট্যাগের শিকার হন। রুশ-ভারতের দালাল ট্যাগটা সিপিবির লোকজনের বরাতেও জুটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশদেশীয় দালাল ট্যাগ বিলুপ্ত হলেও ইন্ডিয়া বা পাকিস্তানের দালালমুক্ত হতে পারল না বাংলাদেশ!
এরশাদের জমানায় ভারত ও পাকিস্তানের দালালের সঙ্গে বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের এক নাটকের ডায়ালগ ধুন্ধুমার জনপ্রিয় হয়ে যায়। সেটা হচ্ছে, ‘তুই রাজাকার’। রাজনীতি যা করতে পারেনি তা ওই নাটক কিংবা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মনে-প্রাণে চাওয়া গণআদালতের মাধ্যমে ঘাতক দালাল নির্মূলের আন্দোলন অনেকটাই করে ফেলে। স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি ‘তুই রাজাকার’ ট্যাগ তুমুল জনপ্রিয় হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালের পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই আন্দোলন কুক্ষিগত করে যা মোটেও ভালো কাজ হয়নি।
আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে উঠতে-বসতে জামায়াত-শিবির-রাজাকার ট্যাগ দিলেও তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ২০০৮ সালের পরে এই বিচার শুরু হলেও আওয়ামী সরকারবিরোধী মাত্রেরই নতুন ট্যাগ হয়ে দাঁড়ায় বিএনপি-জামায়াতের দালাল। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান চলাকালে নির্বিচারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে ট্যাগ দেন স্বয়ং শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ উচ্ছেদ হলেও দলটির পতন শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে আগেরবারের একতরফা নির্বাচনের পাপমোচনের একটা সুযোগ পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। অথচ ওই নির্বাচনের ফলাফল ছিল হতবাক হওয়ার মতো। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা ২৮৮টি আসন পায়। আর বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র সাতটি। বাকি তিনটি আসন পায় অন্যরা। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে বলা হয় রাতের ভোট। আসলে ভোট শুরুর আগেই সেবার ভোট হয়ে গিয়েছিল।
২০২৪ সালের নির্বাচনকে বলা হয় ‘আমি ও ডামির নির্বাচন’। এরপর তো করুণ বিদায় নিতে হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারকে। স্বৈরাচারী ওই সরকারের পতনের পর ভারতীয় দালাল শব্দটা দারুণভাবে ফিরে এসেছে, সঙ্গে স্বৈরাচারের দোসর শব্দটিও যুক্ত হয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনে ভূমিকা রেখেছেন এমন মানুষজনও বর্তমান সরকারের সমালোচনা করলে দোসরে পরিণত হচ্ছেন।
ট্যাগ থেকে যেন আমাদের মুক্তি নেই। কী আর করা? শেষমেষ পরিসংখ্যান ও গল্পের রাজ্যে যাই। দালালদের সংখ্যা কী বেড়েছে নাকি কমে গেছে? এটা জানার জন্য নাসিরুদ্দীন হোজ্জা, বীরবল বা গোপাল ভাঁড়ের কাছে যেতে হবে। কারণ শহরে কাকের সংখ্যা কত এই একটা গল্প তিনজনের নামেই প্রচলিত আছে। যাই হোক, আমরা বরং কাকের দালালদের একটা পরিসংখ্যান করতে পারি। যদি দেখা যায়, দেশে দালালর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে, তাহলে ভেবে নিতে হবে আশপাশের দেশগুলো থেকে কিছু দালাল দালালির প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে। আর যদি কমেছে মনে হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, দালালদের কেউ কেউ দেশের বাইরে বেড়াতে গেছে!
এবার দালালির গল্প। এক পিঁপড়া সীমান্তের এপার-ওপারে দালাল হিসেবে পরিচিত। অনেক কিছুই সে এপার-ওপার করে। একবার এক মালিকবিহীন ষাঁড় বলল, পিঁপড়া তুই তো অনেকবার সীমান্তের ওপার গেছিস। আমাকে নিবি একবার? তোকে অনেক এনাম দেব। পিঁপড়া রাজি হলো। সীমান্ত পাড়ি দিতে দেখে ষাঁড়কে গুলি করে মারা হলো। এরপর পিঁপড়াকে নেয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদে, কেন সে ষাঁড়কে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। পিঁপড়া বলল, সে জানত যে ষাঁড় গুলিতে মারা পড়বে। অনেকদিনের জন্য সে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। সঙ্গে করে সে খাবারও নিয়ে এসেছে।
দালাল যত ছোট হোক তাকে নাকি অবজ্ঞা বা অবহেলা করা ঠিক নয়। একাত্তর সালে যাদের বলা হতো দুষ্কৃতকারী বা ভারতের দালাল সেই মুক্তিযোদ্ধারাই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।