Published : 25 May 2025, 03:57 PM
শুধু যেন ক্ষতের ওপর ক্ষত। ফের সেই ক্ষত দগদগে ঘা হয়ে প্রকাশ পেল প্রশান্ত হালদারদের পোড়াবাড়িতে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের রঘুনাথপুরে প্রশান্ত হালদারের পৈতৃক ভিটেমাটি। মঞ্চাভিনেতা, কথাশিল্পী, নাট্যকার প্রশান্ত হালদারের বাড়িটি কোনো দুর্ঘটনায় পুড়ে গেলো নাকি পুড়িয়ে দেওয়া হলো? সংবাদমাধ্য়মের সূত্র ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। রক্তস্নাত এ দেশের বহু পুরানো মর্মস্পর্শী খেলার নাম 'উচ্ছেদ-উচ্ছেদ খেলা’। আর কেউ উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানেই অন্য কারোর দখলবাজি।
প্রশান্ত হালদারদের যৌথ পরিবারটি কি এই মর্মস্পর্শিতারই শিকার? যতটুকু জেনেছি রঘুনাথপুর গ্রামে এই একটি মাত্র হিন্দু পরিবার এখনও টিকে আছে, যাদের যথেষ্ট জোতজমি আছে। সহজ প্রশ্ন কারা এই পরিবারটিকে রাখালগাছি থেকে বিতাড়িত করতে চায়? এমন প্রশ্ন আছে অনেক, যেন প্রশ্নের পাহাড় কিন্তু নেই কোনো সদুত্তর!
দায়িত্বশীলদের ফের উচ্চারণ এর যথাযথ বিহিত হবে; অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এমন অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ভুক্তভোগীরা শুধু শুনেই আসছেন কিন্তু কয়জন প্রতিকার-প্রতিবিধানের আলো দেখেছেন? প্রশ্নটির উত্তর প্রীতিকর নয়।
প্রশান্ত হালদারদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। ৫৪ বছরের এই বাংলাদেশে অনেক প্রশান্ত হালদারের স্বপ্নের পাঁজর ভেঙেছে, অনেক শেফালী, অনেক পূর্ণিমার সম্ভ্রম গেছে; প্রতিবিধান মিলেনি বহু ক্ষেত্রেই। পূর্ণিমার মতো যারা টিকে আছেন, তারা নিজের মনের জোরেই আছেন। শেফালীর কথা মনে আছে আপনাদের? ভোলার লর্ডহার্ডিঞ্জের পঙ্গু শেফালী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২০০১ সালের নির্বাচনের পরদিন। শেফালী এখন ভারতে তিস্তা চরের গজলডোবায়। শাশুড়ি-পুত্রবধূ সুজাতা আর বিষ্ণুপ্রিয়াও লর্ডহার্ডিঞ্জে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন একই রাতে। তারাও আর বাংলাদেশে নেই। এমন না থাকার গল্প অনেক এবং গল্পটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
রাজনীতি ও ভোটের সমীকরণে অনেক অপরাধ চিহ্ন মুছে গেছে। ২২ মে দিবাগত রাতে রঘুনাথপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন প্রশান্ত হালদার। তিনি ঢাকার নাট্যদল 'অনুস্বর'-এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। প্রায় চার দশক ধরে তিনি নাট্যচর্চায় যুক্ত। নাট্যকার ও অভিনেতা হিসেবেও তার যথেষ্ট পরিচিতি আছে। তার বোন বোন শ্রাবণী রাখী এবং শ্রাবণীর স্বামী মনোজ দে সাংবাদিকতা করেন।
ফলে তাদের বাড়িতে আগুনের ঘটনায় প্রতিবাদ হচ্ছে। আরও সব প্রশান্তদের খবর আমরা কতটা রেখেছি। প্রশান্ত হালদারের বাড়িতে হামলায় প্রতিবাদ জানিয়েছে নাট্যদল 'অনুস্বর' এবং থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’। কিন্তু আইনি প্রতিবিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব যাদের তারা কি দৃষ্টান্তযোগ্য নজির স্থাপন করতে পারবেন? এমন জিজ্ঞাসা-প্রত্যাশার সদুত্তরের অপেক্ষা এ পর্যন্ত সময়ের গর্ভে কম বিলীন হয়ে যায়নি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দেওয়া প্রশান্ত হালদারের ভাষ্য, “বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আগুন লাগে। মূল বাসভবন দোতালার পেছনে প্রাচীর সংলগ্ন একটি খোলা টিনের চালায় বিচালিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর লাগোয়া খড়ির গাদায় এবং ক্রমান্বয়ে টিনের স্টোররুম ও গোয়াল ঘরেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকজন ও কালীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।”
আগুন লাগার ঘটনায় ‘নানা রকম সন্দেহ’র কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “এর আগেও অজ্ঞাতনামা কেউ রাতের বেলায় আমাদের রান্নাঘরে জানালায় ৩/৪ বার মানুষের মল মাখিয়ে রেখে যায়। একাধিকবার আমাদের টিনের ঘরের চালে ও দোতলা ঘর লক্ষ্য করে আধলা ইট ও ঢিল নিক্ষেপ করে। বিষয়টি নিয়ে আমরা স্থানীয়ভাবে আলোচনা করি।” রঘুনাথপুরে হালদারদের যে বাড়িটিতে বারবার উৎপীড়নের তীর ছোড়া হয়েছে এর পেছনে উচ্ছেদ আর দখলের মর্মন্তুদ অপখেলার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ মনে হয় নিশ্চয় কম।
খবরটা জানার পর থেকে কি লিখব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিলাম। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন রেখেছি– এই অগ্নিদগ্ধ, এই রক্তস্নাত মাটি আমার দেশের মাটি হতে পারে না। এই মাটিকে যারা দ্বগ্ধ-রক্তস্নাত করেছে, করছে তারা জনশত্রু, মানচিত্রের শত্রু। আমরা কি এসব ঘটনার পৌনঃপুনিকতা থেকে কোনোদিনই আর বের হতে পারব না? কে বা কাদের অপ-তৎপরতায় প্রশান্ত হালদারদের ভিটেমাটি ধুলায় মিশে যায় বারবার? এটাই কি আমাদের নিয়তি? না, তা তো হতে পারে না।
একাত্তরেই তো এটা শেষ হতে পারত, যখন শামসুর রাহমান লিখেছেন, আর কত খাণ্ডবদাহন দেখতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্বের অন্যতম মূল প্রত্যয়-অঙ্গীকার ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রটি হবে সর্বজনের। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪ বছর পরও রাষ্ট্র তো সর্বজনের হয়ইনি,উপরন্তু সেই প্রত্যয়-অঙ্গীকার ক্রমেই রাজনীতির নাম অপরাজনীতির অপছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। আগেও বলেছি এবং আবারো বলি, সব কিছুর শেষ আছে কিন্তু মানুষের অধিকারের শেষ নেই— এই সত্যটুকু শাসক কিংবা রাষ্ট্র পরিচালকরা ভুলে যান! স্বাধীনতা-উত্তর প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলেই জনঅধিকার কম-বেশি শাসকদের পদদলিত হয়েছে। কোনো কোনো অরাজনৈতিক সরকারের শাসনামলও এর বাইরে নয়। অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দ্বিচারিতা-হীনস্বার্থবাদিতা-স্বেচ্ছাচারিতা-লুণ্ঠনসহ অজস্র নেতিবাচক কর্মকাণ্ডই তো দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার ও মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে।
আমরা দেখেছি প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক মেরুকরণের পেছনে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের সমীকরণ হয়েছে। এমন গুরুতর ব্যাধি যে দেশের রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে গেছে সে দেশে সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করা কি এত সহজ? আমাদের রাজনীতিকদের অনেকের দেশপ্রেম নিয়ে নানা কথা আছে এবং সেসব কথা যে অমূলক নয় এও, অনস্বীকার্য। মনে রাখা জরুরি, নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তার অনিবার্য শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকতা। এর অর্থ হলো, গণতান্ত্রিক সরকারে জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের স্বার্থের অনুকূলে পরিচালিত সরকার। রেমন্ড গারফিল্ড গেটেল, অধ্যাপক গেটেল নামে সমধিক পরিচিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, “যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র।” কিন্তু আমাদের দেশে দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে এরও ব্যত্যয় ঘটেছে বার বার। রাষ্ট্র সর্বজনের হওয়ার ক্ষেত্রে এও অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর দায় কি রাজনীতিকরা এড়াতে পারেন? অগ্নিদগ্ধ-রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত এই বাংলাদেশের মাটিতে প্রশান্ত হালদারদের তালিকা দীর্ঘ হওয়ার দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না।
প্রশান্ত হালদারের ভিটেমাটিতে যে ক্ষতচিহ্ন আবারও প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে, আর কত দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন? আর কত হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর মুছে যাবে? এমন মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেই চলবে আর এর বিপরীতে রাষ্ট্রশক্তি ও প্রশাসনের দায়িত্বশীল ও রাজনীতিকরা শুধু উচ্চারণ করে যাবেন, 'এমনটি বরদাস্ত করা হবে না' তা তো হতে পারে না। 'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে' এই চিরসত্য যেন নাগরিক সমাজের রক্ষাকর্তারা ভুলে না যান।
নাট্যশিল্পী প্রশান্ত হালদারের বাড়িতে আগুনের ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা