Published : 01 Jun 2025, 09:41 PM
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার তিন সপ্তাহের মাথায় যেদিন (রোববার) জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করলেন আপিল বিভাগ, সেদিনই জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) রেজিস্ট্রারের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে প্রসিকিউশন।
সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাড়ে আট হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র আইসিটিতে জমা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা এবং তার দলের শীর্ষ নেতা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার বিচার হচ্ছে এমন একটি ট্রাইব্যুনালে, যেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের অনেক শীর্ষ নেতাকে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আর এই ট্রাইব্যুনালেই মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে গত ২৭ মে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কোনো ব্যক্তির এটিই প্রথম খালাস পাওয়ার ঘটনা। এই ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় জামায়াতের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। সুতরাং, এর কোনো ঘটনাকেই একটি ‘একক’ বা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে পাঠ করার সুযোগ নেই। যদিও বিচার বিভাগ সাংবিধানিকভাবে এবং আইনত স্বাধীন। সে বিষয়ে পরে আসছি। আসা যাক জামায়াতের নিবন্ধন প্রসঙ্গে।
জামায়াত ও নিবন্ধন
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ইসিতে নিবন্ধিত হওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। ওই বিধানের আলোকে দলগুলো আবেদন করে এবং প্রথম দল হিসেবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) নিবন্ধন পায় ২০০৮ সালের ২০ অক্টোবর। ১৪ নম্বর দল হিসেবে জামায়াত নিবন্ধন পায় এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধিত দল হিসেবেই জামায়াত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং দুটি আসনে জয়লাভ করে।
আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক। জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মভিত্তিক দল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর নতুন রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান গৃহীত হয়, তার ৩৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্টত উল্লেখ ছিল: ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সঙ্ঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।’
প্রথমত সংবিধানের এই বিধানের আলোকে, অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী যেহেতু এটি ধর্মভিত্তিক দল বা তার নামের মধ্যেই যেহেতু ধর্মীয় শব্দ রয়েছে সে কারণে এবং মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতার কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর জামায়াতের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। বদলে যায় দেশের সংবিধানও। ধর্মভিত্তিক বা ধর্মীয় নামযুক্ত দলের রাজনীতি করার বাধা অপসারিত হয়।
১৯৭৬ সালের ২৪ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী, ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফতে রব্বানী পার্টির নেতৃবৃন্দ ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন এবং ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি, আওয়ামী লীগ ৩৯টি এবং মুসলিম লীগ ১৪টি আসনে বিজয়ী হয়। ইসলামিক ডেমোক্রেটি লীগ থেকে মনোনীত জামায়াতে ইসলামীর ৬ জন সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদে জামায়াতের এটিই প্রথম উপস্থিতি।
এককভাবে জামায়াত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৮৬ সালে। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ৭৬টি আসনে মনোনয়ন দেয় এবং ১০টিতে জয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিরোধী দলগুলো বর্জন করে। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি এবং ১৯৯৬ সালের ৩টি আসন লাভ করে। ১৯৯৯ সালে বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী মিলে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৭টি আসনে জয়ী হয়। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসনে জয়ী হয়। নিবন্ধন না থাকায় ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচনের তাদের প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তারা অংশ নেয়নি। চাইলেও নিতে পারত না।
নিবন্ধন বাতিল
২০০৮ সালে যে বছর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়, তার পরের বছরই বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাই কোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। ২০১৩ সালের পয়লা অগাস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
ওই রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ অগাস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরপর হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াত। তবে আপিল শুনানিতে জামায়াতের মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় ২০২৩ সালের নভেম্বর ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ বলে আপিল আবেদনটি খারিজের আদেশ দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগ। এতে করে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল থাকে।
গত বছরের ৫ অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। নিবন্ধন ফিরে পেতে তাদের আপিল শুনানি শুরু হয়। গত ১৪ মে শুনানি শেষ হয় এবং ওইদিন আপিল বিভাগ জানান যে, পয়লা জুন এ বিষয়ে রায় দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী পয়লা জুন রবিবার সকালেই জামায়াতের মামলাটি আপিল বিভাগে ওঠে এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করেন।
রায়ে আদালত বলেছেন, দলটির ক্ষেত্রে পেন্ডিং (অনিষ্পন্ন) রেজিস্ট্রেশন ইস্যু এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি থেকে থাকে, তা সাংবিধানিক ম্যান্ডেট (বিচারগত ও আইনগত) পুরোপুরি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দেওয়া হলো। তার মানে জামায়াতের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হলেও কোনো সরকারই, এমনকি আওয়ামী লীগও পরে আর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি। ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, জামায়াত, যুদ্ধাপরাধ—ইত্যাদি শব্দগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ নানাভাবে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানের শেষ মুহূর্তে গত বছরের পয়লা অগাস্ট জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ২০ দিনের মাথায় গত বছরের ২৮ অগাস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে দেয়।
উপরন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমই এখন নিষিদ্ধ। হয়তো ট্রাইব্যুনালের কোনো রায় বা পর্যবেক্ষণের আলোকে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং তার ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশনে তার নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং বড় কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ অনিশ্চিত।
কেন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছিল?
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে সেই আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় মূলত মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। রিটে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চাওয়া হয়েছিল মূলত কয়েকটি যুক্তি দেখিয়ে।
১. জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেইসঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না—যা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।
২. গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজে কর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল।
৩. নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না—এটি স্পষ্টতই বৈষম্যমূক নীতি।
৪. কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকার করে, তাদের জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।
এই যুক্তিগুলো তুলে ধরে দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট একটি রুল জারি করেন। রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১)(বি)(২) ও ৯০(সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না– তা জানতে চাওয়া হয়।
এরই মধ্যে নিবন্ধন বাঁচাতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন আনে জামায়াত। গঠনতন্ত্র থেকে ‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রসুল প্রদর্শিত’ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়। দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করাসহ বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়।
প্রশ্ন হলো, যেসব যুক্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছিল বা যেসব যুক্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই যুক্তিগুলো কি খারিজ হয়ে গেছে? সর্বোচ্চ আদালত নিশ্চয়ই যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কোনো একটি রায় বা সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু জনমনে যে প্রশ্নটি আছে সেটি হলো, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পেছনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কি তার রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়নি? আদালত ও নির্বাচন কমিশন কি নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছিল বা করতে পেরেছিল?
একইভাবে এখন জনমনে এই প্রশ্নও আছে যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ অগাস্টের ঘটনা না ঘটলে কি জামায়াত আইনি বা বিচারিক প্রক্রিয়ার তার নিবন্ধন ফিরে পেত? দেশের আদালত ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যতই স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বলা হোক না কেন, সাধারণ মানুষ এখন তা নিছক কেতাবি কথা হিসেবেই দেখে।
পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও বিচার বিভাগ
জুলাই অভ্যুত্থানের পরে দেশের মানুষের মনে যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার তো বটেই, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিচারালয় পর্যন্ত দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে নির্লজ্জ দলীয়করণের কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে উত্তরণ খুব সহজ নয়। কিন্তু চেষ্টাটা শুরু দরকার।
যখন যারা ক্ষমতায় থাকবে, দেশের আইন-কানুন ও বিচারব্যবস্থা তাদের মর্জিমাফিক চলবে; সরকার পরির্তনের সঙ্গে সঙ্গে আদালতের রায় বদলে যাবে—এটি কোনো সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির লক্ষণ নয়। বরং দেশকে সত্যিই এগিয়ে নিতে হলে প্রথমে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই স্বাধীনতা শুধু কাগজে-কলমে নয়। বস্তুত বিচারকরা যে কোনো ধরনের ভয়-ভীতি ও চাপমুক্ত থেকে রায়, আদেশ ও পর্যবেক্ষণ দিতে পারবেন—এমন একটি পরিবেশ যতক্ষণ পর্যন্ত না গড়ে তোলা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে’ কথাটি প্রবাদবাক্য হিসেবেই মানুষ উচ্চারণ করবে। কার্যত তার কোনো প্রয়োগ থাকবে না।