Published : 15 May 2025, 08:17 PM
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পেছনের দিকে ছোট ছোট পাম গাছের সারি। এই পাম গাছের সারির পাশ দিয়ে রমনা কালী মন্দিরের দিকে যাওয়ার হাঁটাপথের একটি সরু ট্রেইল আছে। এই ট্রেইলের অপর পাশেই ছোট্ট একটি গোল বাউন্ডারি, যার ভেতরে একটি উদীয়মান বটগাছ। এই গোল চত্বরের পাশেই অনেক ভিড়ের মাঝে ঘণ্টারও বেশি সময় চিৎ হয়ে পড়ে ছিল সাম্যের রক্তাক্ত দেহ। অথচ, এখান থেকে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের দূরত্বেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল!
‘এত ভিড়েও, আজও আমি একা’ মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের কনসার্টে আর্টসেলের এই গানের লাইনটি বন্ধুদের সঙ্গে চিৎকার করে গেয়েছিলেন সাম্য। ঠিক কয়েকঘণ্টা পরই এই লাইনটিই তার জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা হয়ে গেল।
পুরো নাম শাহরিয়ার আলম সাম্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও জুলাই-যোদ্ধা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে পাম গাছের সারিটির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই আড্ডা দিতেন সাম্য। ছাত্রদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন, কিন্তু তার বন্ধু তালিকা রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সমৃদ্ধ ও বৈচিতত্র্যময় ছিল। তারুণ্যে ভরপুর সাম্যের জীবন জুড়েই ছিল বন্ধুত্ব, আড্ডা, রাজনীতি আর গান। ক্যাম্পাসে আমরা যাদের বলি, ‘জীবনের তিনটা ডিগ্রি— এসএসসি, এইচএসসি ও টিএসসি’, সাম্য এই মন্ত্রে দীক্ষিত। সাম্যের বড়ভাইও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন আজ থেকে দুই দশক আগে। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তার সমসাময়িকদের কাছে তিনিও বন্ধুবৎসল ও মানবিক মানুষ হিসেবেই পরিচিত।
সাম্য হত্যাকাণ্ডের কতগুলো অ্যাঙ্গেল তৈরি হয়েছে। স্বভাবতই, এই লাশের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যে যার স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। মাঝখান দিয়ে বিপন্ন বিস্ময়ে হতবাক ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আসুন কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা করা যাক।
প্রথমেই অ্যান্টি শিবির অ্যাঙ্গেল। সাম্য তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে সর্বশেষ যে পাবলিক স্ট্যাটাসটি শেয়ার করেছিলেন (১১ মে ২০২৫) তার মূল বক্তব্য ছিল— মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলে, ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর জন্য একই বিচার কেন প্রযোজ্য নয়?
এই কারণে ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই সাম্য হত্যাকাণ্ডে জামাত-শিবিরের গন্ধ পাচ্ছেন।
ছাত্রদল এই ঘটনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরের অবহেলাকে দায়ী করেছে এবং তাদের পদত্যাগ দাবি করছে। ভিসির সঙ্গে ছাত্রনেতাদের উত্তপ্ত ও আবেগপ্রবণ বাক্য বিনিময়ও আমরা দেখেছি।
এবার আসি শিবির অ্যাঙ্গেল নিয়ে। সাম্য হত্যাকাণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সভাপতি এসএম ফরহাদ এই ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের, যারা ক্যাম্পাসকে সবার জন্য উন্মুক্ত করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সাম্য হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি চারটি দাবি তুলেছেন। মোটা দাগে সেগুলো হলো:
ক) হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা।
খ) হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা সবার জন্য উন্মুক্ত করা।
গ) মাদক ও অন্যান্য অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা।
ঘ) ক্যাম্পাসকে স্থায়ীভাবে বহিরাগতমুক্ত করা এবং পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া; এ ব্যাপারে উদারপন্থীদের কথা না শোনা।
চিকন দাগে তিনি একটি কথা বারবার বলেছেন, তা হলো ক্যাম্পাস বহিরাগতদের জন্য পুরো লক করে দেয়া এবং যেসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষক যারা ক্যাম্পাসে সবার উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারের (হীন উদ্দেশ্যে!) পক্ষে কথা বলেন তাদের কথা না শোনা।
এটা শিবিরের পুরোনো স্ট্রাটেজি বলে ভুক্তভোগীরা মনে করেন। এই সংগঠনটি সবকিছু লকড ও কন্ট্রোলড চায়। বিশ্ববিদ্যালয় ওপেন থাকলে, সেখানে মুক্তবুদ্ধি, গান, আড্ডার আনাগোনায় শিবিরের তৎপরতার বিঘ্ন ঘটাতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা রাজনীতি করার চেষ্টা করলেও কখনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি, বিশ্ববিদ্যালয়টির এই উন্মুক্ত স্বভাবের কারণে। প্রথম সুযোগেই তারা এই উন্মুক্ততার ওপর আঘাত করছে।
মধ্যপন্থী দল এনসিপি নেতা সার্জিস আলম স্বভাবসুলভভাবে একটু ডানে ঘেঁষে মাঝখান দিয়ে হেঁটেছেন। তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে উদ্যানের পাশাপাশি টিএসসিকেও টেনে এনেছেন, “একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কখনো একটা শহরের মানুষের চা, পান, সিগারেট খাওয়ার, আড্ডা দেওয়ার কিংবা অবাধ মেলামেশার জায়গা হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য টিএসসির ভিতরের ক্যাফেটেরিয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য যাবতীয় চা, কফি, নাস্তা কিংবা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু সেই ক্যাফেটেরিয়াকে অকার্যকর করে টিএসসিতে প্রায় ৩০টা চা দোকানের আসর বসানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এগুলো বন্ধ করতে যাক, দেখবেন একদল ভণ্ড এবং সো-কল্ড লিবারেল সুশীল শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের বদহজম শুরু হয়েছে।”
সার্জিস নিজেও টিএসসির বাইরের দোকানে আড্ডা দিয়ে, চা খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেছেন। উনি অবশ্যই জানেন টিএসসির চায়ের দোকানগুলোও এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে স্বপন মামা বা অন্য দোকানি স্রেফ সাধারণ দোকানি না, টিএসসির সংস্কৃতির অংশ।
এখন সাম্য খুন হয়েছে বলে দুনিয়ার সবার উদ্যানে ঢোকা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে? কোনো সাবেক বা বহিরাগত বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবে না? এখানে আর কেউ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবে না? টিএসসিতে চা খাবে না? কোনো পিতামাতা একা অথবা সন্তানকে নিয়ে হাঁটতে আসবে না? বসবে না গানের আসর? কেউ শোনাবে না নতুন সিনেমার স্ক্রিপ্ট।
অবশ্যই সবাই আসবে। বরং উদ্যোগ নিতে হবে উদ্যানকে নিরাপদ করার। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে আর কোনো সাম্য যেন মারা না যায়। এই দায়িত্ব পুলিশের। ডিফ্যাক্টো হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। সর্বোপরি ছাত্র সংগঠনগুলোর এবং শিক্ষার্থীদের। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন বড় বড় পদে যাদের বসানো হয়েছে, তাদের প্রত্যেককেই নানাভাবে সরিয়ে দেয়ার একটা চেষ্টা আমরা দেখেছি।বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির মাঝেও তোফাজ্জল থেকে শুরু করে সব ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে অন্য কারও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছি কিনা সেটাও আমলে রাখতে হবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে মতামত দিতে গেলে ওখানকার সংস্কৃতিটা বুঝতে হবে, ওখানে আড্ডার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ব্যক্তিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সবাই নেশা করতে যায় না। এখানে নানা কিসিমের মানুষ আসে, অনেক স্বপ্নের জাল এখানে বোনা হয় তারুণ্যে, আড্ডায়, সঙ্গীতে। আবার ক্রিমিনালরাও আসে। এখানে অনেক তুচ্ছ কারণে গ্যাঞ্জাম হতে দেখেছি। তুচ্ছ ঘটনা অনেকদূর গড়াতে দেখেছি। হিট অফ দ্য মোমেন্টে অনেক কিছুই ঘটে।
তাই, দুটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ:
১. সাম্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। সবাইকে দলীয় লাভের গুড়ের হিসেব বাদ দিয়ে সত্যিকার তদন্তের কথা একসঙ্গে বলতে হবে।
২. উদ্যানকে সবার জন্য উন্মুক্ত, নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে হবে।
নিরাপদ উদ্যানের পূর্বশর্তই হলো একে প্রাচীরহীন, দৃশ্যমান ও উন্মুক্ত করা। যেখানে নির্বিঘ্নে বন্ধু-বান্ধবরা যেমন যাবেন, তেমনি সন্তানরাও যাবেন, পিতামাতারাও যাবেন। উদ্যান হবে উন্মুক্ত। পুলিশ সেখানে নিরাপত্তা দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনে সহায়তা করবে সেখানে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশের রমনা পার্ক ঢাকা শহরের সুন্দরতম স্থানের একটা। নিরিবিলি, নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। সোহরাওয়ার্দীকে বন্ধ করতে গেলেই সেটি বরং একটি পাতাললোকে পরিণত হবে। পাশের সুন্দর উদাহরণটাকেই আমরা গ্রহণ করি। শেষ করি ক্যাম্পাসের অ্যাকটিভিস্ট, গায়ক ও সাম্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজ ঋআজ মোর্শেদের একটি উক্তি দিয়ে “আয়রনি হচ্ছে আজ বেঁচে থাকলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উচ্ছেদ অভিযানে বাঁধা দিতো সাম্য। ওর মধ্যে একটা মানবিক হৃদয় ছিল।”
আমরা সাম্যের মানবিক হৃদয়টাকেই মনে রাখি, ওকে ব্যবহার না করি।